আবদুর রহমান খান
আফগানিস্তানে তালিবান শাসন প্রতিষ্ঠার পর এবার মধ্য এশিয়ায়ার দেশগুলির সার্বিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যত নিয়ে নতুন উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
বিশ্বের দীর্ঘতম টানা দু’দশকদের যুদ্ধে পরাজির আমেরিকা, তাদের ইউরোপিয়ান ন্যাটো মিত্র এবং দক্ষিণ এশিয়ার আশাহত সহযোগী ভারত ইতোমধ্যেই “আফ-পাক” অঞ্চলে অধিকতর ইসলামি উগ্রবাদের সম্ভাব্য উত্থান নিয়ে আশংকা ব্যক্ত করতে শুরু করেছে।
মধ্য এশিয়ার নতুন নিরাপত্তা বিন্যাস নিয়ে ইউরেশিয়া রিভিউ ম্যাগাজিন আজ (১১ সেপ্টেম্বর) এক পর্যালোচনা প্রতিবেদন প্রকাশ করে তাদের উদ্বেগদের কথা তুলে ধরেছে।
প্রতিবেদনের লেখক আইজাজ ওয়ানী আশংকা প্রকাশ করেছেন, মধ্য এশিয়ার দেশগুলিতে সক্রিয় আল-কায়দাপন্থী বিভিন্ন ইসলামি সন্ত্রাসী গ্রুপ এবার তালেবানদের বিজয়ে উৎসাহী হয়ে নতুন উদ্যমে তাদের তৎপরতা জোরদার করবে।
তালেবান শক্তির পুরুত্থানে আফগানিস্তানের উত্তর সীমান্তে লাগোয়া সেন্ট্রাল এশিয়ান রিপাবলিক(সিএআর)ভুক্ত দেশগুলির স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা, ভূরাজনীতি এবং আঞ্চলিক ভূকৌলগত বিষয়গুলি গুরুতর প্রশ্নের মুখে পড়বে। এমনটাই মনে করছেন অবজারভার রিসার্স ফাউন্ডেশনের এ গবেষক ।
জানিসংঘের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মধ্য এশিয়া, চীনের উইঘর অঞ্চল এবং পাকিস্তানের দশ হাজারের বেশী ইসলামিক যোদ্ধা আফগান তালেবানদের সাথে রয়েছে। এরা মূলত আলকায়দা এবং ইসলামিক স্টেট অফ খোরাসান প্রভিন্স বা আইএসকেপি-এর মতো অধিকতর উগ্রবাদী গ্রুপের সদস্য। এ ছাড়া রয়েছে ইসলামিক মুভমেন্ট অফ উজবেকিস্তান (আইএমিউ), ইসলামিক জিহাদ মুভমেন্ট (আইজেএম), জামাত আনসারুল্লাহ এবং এরকম আরও কিছু উগ্র ইসলামিক গ্রুপ। এরা আফগানিস্তানের সীমান্ত গলিয়ে সেওন্ত্রাল এশিয়ার দেশগুলিতে অনুপ্রবেশের আশঙ্কা প্রবল।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙ্গে যাবার পর সৃষ্টি হয় মধ্য এশিয়ার নতুন দেশ – কাজাকিস্তান, কিরগিজস্তান, তুরকমেনিস্তান, তাজিকিস্তান এবং উজবেকিস্তান। আফ-পাক অঞ্চলে তালেবানী তৎপরতা বৃদ্ধি পেতে থাকলে তার প্রভাব পরে মধ্য এশিয়ার দেশগুলির মুসলমানদের মধ্যে।
মধ্য এশিয়ার কয়েক হাজার ইসলামিক যোদ্ধা ২০১৩ সাল নাগাদ আফপাক অঞ্চলে তাদের ঘাটি গেড়ে তালেবানদের সহযোগী হয়ে আধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের প্রশিক্ষণ নেয়। তারা এসময় আল-কায়দাপন্থী অন্যান্যদল বিশেষকরে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)’র সঙ্গে মিলে মধ্য এশিয়ার দেশগুলিতে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাতে থাকে। আফগান সীমান্তের ওপারে উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, ও কাজাকিস্তান – এ তিনটি দেশে ২০০৮ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে দশবছরে
বিশটির মতো সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে এসব জঙ্গী গোষ্ঠী। এসব হামলায় প্রায় দেড়শ মানুষের জীবনহানি হয়েছে।
এ সময় মধ্য এশিয়ার দেশগুলিতে ইসলামপন্থীদের উপর ধারাবাহিক দমন- নির্যাতনের ফলে উগ্রবাদী চেতনা আরও সক্রিয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে মধ্য এশিয়ার দেশগুলি থেকে চার হাজারের মত ইসলামিক যোদ্ধা সিরিয়া এবং ইরাকে ইসলামিক এস্টেট ও জাহবাত ফাতেহ নামের উগ্রগোষ্ঠীর সাথে যোগ দেয়। পশ্চিমা সামরিক গোয়েন্দাদের ধারনা, ২০১৮ সাল নাগাদ ইসলামি বিপ্লবের ডাকে এক ভিডিও বার্তার আহবানে সাড়া দিয়ে চার হাজার আইএস এবং ফাতেহ যোদ্ধা ইসলামিক স্টেট অফ খোরাসান প্রভিন্স বা আইএসকেপি’ র দলে যোগ দিয়েছে।
এবছর তালেবানরা মার্কিন-ন্যাটো বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের সামরিক তৎপরতা বৃদ্ধি করার পর থেকে অনেক আফগান সামরিক বাহিনীর অনেক যোদ্ধা জীবন বাঁচাতে সীমান্ত গলিয়ে মধ্য এশিয়ায় পালিয়ে গেছে। এটাও এখন মধ্য এশিয়ার জন্য বাড়তি সামরিক ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে।
তালেবানদের হাতে আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রন আসন্ন উঠলে মধ্য এশিয়ার দেশগুলি তাদের নিরাপত্তা সংকট নিয়ে আলোচনার জন্য গত ৫ আগস্ট তুরকেমিনস্তানে বৈঠকে বসে । বৈঠকে তাজিকিস্তান বিশেষ করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে “তাজিক তালেবান”দের নিয়ে। এদেরকে কৌশলগত গুরুতপুর্ণ উত্তর সীমন্তে নিয়োগ করে রেখেছে আফগান তালেবানরা
এদিকে, উজবেকিস্তান ও তুরকেমিনস্তান তাদের সীমান্ত দিয়ে তালেবান যোদ্ধাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সামরিক যৌথ সামরিক মহড়ার চালিয়েছে। অপরদিকে, বিজয়ী তালেবান প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠকও করেছে। এ দুটি দেশের ভু-রাজনৈতিক স্বার্থেই একটি স্থিতিশীল আফগানিস্তান খুব গুরুত্বপুর্ণ । মধ্য এশিয়ার দেশগুলির ব্যাবসা-বানিজ্য এবং ভৌগোলিক যোগাযোগের স্বার্থে বিশেষভাবে এটা দরকার।
সামনে নতুন চালেঞ্জ
খ্রিষ্টীয় পশ্চিমা পর্যবেক্ষদের আশংকা হচ্ছে- মধ্য এশিয়ার ইসলামি গ্রুপগুলি আফগান তালেবনদের সাথে মিলে অদূর ভবিষ্যতে আফগানিস্তান থেকে ইউরোপের সীমান্ত পর্যন্ত খিলাফত প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হবে। আফগানিস্তানে শরিয়া আইন চালুর ঘোষণা নিয়েও উদ্বিগ্ন আমেরিকা এবং ইউরোপীয় দেশসমুহ।
মধ্য এশিয়ার দেশগুলিতে বিরাজমান দারিদ্র, দুর্নীতি এবং ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন কারণে উগ্রবাদী চেতনা দ্রুত ছড়িয়ে পরার আশংকা করছেন পশ্চিমা বিশ্লেষকগণ। এ ছাড়া আফগানিস্তানে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর ফেলে যাওয়া যতসব আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র এ অঞ্চলের সন্ত্রাসীদের হাতে পরে বিপদ আরও বাড়িয়ে দেবে বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকমহল। ।
এ অবস্থায় মধ্য এশিয়ার কর্তৃত্ববাদি সরকারগুলি রাশিয়া ও চীনের প্রতি আরও বেশী নির্ভরশীল হয়ে পরবে- এটাই পশ্চিমা শক্তির ভয়।
তবে, তালেবানরা ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, আফগানিস্তানের মাটি ব্যাবহার করে কোনও সন্ত্রাসী গ্রুপকে সীমান্তের ওপারে কোন রকম তৎপরতা চালাতে দেবেনা। তারা অন্য দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাগ গলাবে না । সকল দেশের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে দেশ পরিচালনা করবে।
(সেপ্টেম্বর ১১ )
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।