মুহম্মদ নূরুল ইসলাম:
পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে।
সকল প্রশংসা সেই সত্তার যার হাতের মুঠোয় আমার জীবন-মৃত্যু। সকল প্রশংসা তাঁরই যিনি আমাকে অসংখ্য নিয়ামত দান করেছেন, শোকরিয়া প্রকাশ করছি রাব্বুল আলামিনের যিনি আমার কলমকে সচল রেখেছেন। সে রবের কাছে লাখো-কোটি শোকরিয়া যিনি আমাকে ইসলাম ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে কিছু লেখার জন্য সাহায্য করেছেন, দিয়েছেন জ্ঞান।
অসংখ্য দরূদ ও সালাম বিশ^মানবতার মুক্তির দূত, মহান শিক্ষক সাইয়্যিদুল মুরসালিন হযরত মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি, যিনি আল্লাহ্র দীনকে বিজয়ী আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন। যিনি পৃথিবীর ইতিহাসে এক ঘোরতর জাহেলিয়াতের যুগে আবির্ভূত হয়ে ইসলামের দাওয়াতের মাধ্যমে জাহেলিয়াতের পংকিলতায় নিমজ্জিত জাতিকে তাওহীদী চেতনায় উদ্ভাসিত ও আলোকিত করেছেন।
ভূমিকা
ইসলামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাগার এই মক্কা লাইব্রেরি। সাফা-মারওয়ার সা’ঈর স্থান থেকে পূর্ব পাশের্^ শেবে আবু তালিবের সূচনায় পাহাড়ের পাদদেশে হলুদ বর্ণের দ্বিতল ভবনটিই ‘মক্কা লাইব্রেরি’। দালানের জানালাগুলো কাঠের তৈরি। বাড়িটিকে ঘিরে দর্শনার্থীদের ভিড়। বাড়ির সামনে সাইনবোর্ডে লেখা ‘মাকতাবা মক্কা আল মোকাররমা’। এটি মক্কা লাইব্রেরি বলে খ্যাত। বলা হয়ে থাকে, এখানে পাঠক কম, দর্শনার্থী বেশি। ঐতিহাসিকদের মতে, এখানেই জন্মেছিলেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। ১৬০ হিজরিতে আব্বাসী খলিফা মাহদীর শাসনামলে ভবনটির আমূল সংস্কার হয়। শাইখ আব্বাস কাত্তান ১৩৭০ হিজরী তথা ১৯৫০ সালে এই লাইব্রেরিটি নির্মাণ করেন।
১৩৫৭ হিজরিতে বাদশাহ আবদুল আজিজের শাসনামলে প্রথম এর নামকরণ করা হয় ‘মাকতাবা মক্কা আল মোকাররমা’। লাইব্রেরিটি রাজকীয় সৌদি সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয় তত্ত্বাবধান কারি। এতে রয়েছে বহু মূল্যবান গ্রন্থ, পাণ্ডুলিপি ও ঐতিহাসিক অমূল্য ভাণ্ডার।
প্রথমে এটি হারাম শরিফের একটি গম্বুজের অংশবিশেষ থাকলেও পরবর্তীতে গ্রন্থাগারটি হারাম শরিফের বাইরে স্থানান্তর করা হয়। বর্তমানে এর সংগ্রহে আছে ৫ লক্ষাধিক বই। এর মধ্যে ৮ হাজারের অধিক মুদ্রিত-অমুদ্রিত পাণ্ডুলিপি রয়েছে। দুর্লভ পাণ্ডুলিপি আছে প্রায় ৫ হাজারের মতো। এখানে থাকা ইবনে নাদিমের (মৃত্যু ৪৩৮ হিজরি) ‘আল-ফিহরিস্ত’, আল্লামা হায়ছামির ‘মাজমাউল বাহরাইন’ গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ পাণ্ডুলিপি পৃথিবীতে এই একটিই। মক্কা লাইব্রেরির বেশ কয়েকটি বিভাগ রয়েছে। এর পরিষেবা বিভাগটি সাধারণ পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত। পাঠাগারের বিশাল হলরুমে আছে একলাখেরও বেশি সংকলন। যে কোনো আগ্রহী পাঠক লাইব্রেরির মনোরম পরিবেশে এসে অধ্যয়ন করতে পারেন। লাইব্রেরির পাণ্ডুলিপি বিভাগ নির্ধারিত করা হয়েছে গবেষক ও বিশ্লেষকদের জন্য। গবেষণার জন্য এখানে আছে প্রায় ৬,৮৪৭টি মূল পাণ্ডুলিপি। সেই সঙ্গে ৩৫৮টি অনারবি এবং ২,৩১৪ টি ফটো পাণ্ডুলিপিও রয়েছে। এ ছাড়াও এখানে রয়েছে প্রশিক্ষণ বিভাগ, ইলেকট্রনিক লাইব্রেরি বিভাগ, মাইক্রোফিল্ম বিভাগ, ফটো মাইক্রোফিল্ম বিভাগ, হারামাইন স্টল, নারী বিভাগসহ অনেক সুবিধা।
লাইব্রেরির হাকীকত বা রহস্য
হলুদ বর্ণের দ্বিতল ভবনেই শিশু মুহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেছেন। ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে যখন তিনি জন্মগ্রহণ করেন তখন কিন্তু সেই ভবনের আকৃতি বা অবকাঠামো কি রকম ছিলো তা কেউ বলতে পারেনি। শিশু-কিশোর-যৌবনকাল পেরিয়ে আল-মদিনা আল-মুনাওয়ারায় হিজরত করার আগ পর্যন্ত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই বাড়িতেই অতিবাহিত করেছেন।
আকীল ইবনে আবু তালিব রা. যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল-মদিনা আল-মুনাওয়ারায় হিজরত করেন তখন তিনি তা গ্রহণ করেন এবং তার বংশধরদের হাতেই মুহাম্মদ ইবন ইউসূফ আস-সাকাফী (হাজ্জাজের ভাই) তা ক্রয় করা পর্যন্ত থেকে যায়। অতঃপর তিনি তা তার সেই বাড়ির অন্তর্ভুক্ত করেন যা ‘দারুল বায়দ্বা’ নামে পরিচিত ছিলো। হারুনুর রশিদের মাতা আল-খাইযুরান যখন ৭১ হিজরিতে হজ্জ করেন, তখন তিনি সেটিকে মসজিদ বানিয়ে দেন যাতে সালাত আদায় করা যায়।” ১
প্রকৃতপক্ষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্মের নির্দিষ্ট স্থানের ব্যাপারে নিশ্চিত কোনো সহীহ দলিল নেই, এজন্য আলেম ও ঐতিহাসিকগণ তাঁর জন্মস্থান নির্দিষ্ট করার ব্যাপারে মতভেদ করেছেন।” ২
পর্যটক আবু সালেম আল আইয়্যামী (মৃত. ১০৯০ হিজরি) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্মস্থানের বিশুদ্ধতা অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হন ও এক্ষেত্রে আলিমদের মতভেদ উল্লেখ করে মানুষের মাঝে যে উক্তিটি প্রসিদ্ধ তার পর্যালোচনা করেন এবং বলেন, ‘আশ্চর্যের বিষয় হলো’ দার-গৃহের শয়ন কক্ষ পরিমাণকে তারা নির্ধারণ করেন বলেন, “এটি হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্মস্থান। আমার নিকট কোনো সহীহ ও দুর্বল সূত্রে এর নির্দিষ্টতা প্রমাণ হওয়া তো বড় দূরের কথা হিসেবে বিবেচিত। কেননা ইতোপূর্বে যে সব মতভেদের কথা উল্লেখ হয়েছে, তা মক্কা বা অন্য কোথায়। একমত অনুযায়ী তাঁর জন্মস্থান সেখানে, তবে সেখানের কোন অংশে? অন্য মতানুযায়ী এই শেবে-ঘাটিতে, তবে কোন গৃহে?… বস্তুত গৃহের নির্দিষ্ট স্থানের সম্ভাবনা সুদূর পরাহত; কেননা এর মধ্যে অতিবাহিত হয়ে গেছে বহুকাল ও জামানা এবং চিহ্ন ও আলামতও বিচ্ছিন্ন ও বিলুপ্ত হয়ে গেছে।”
অতঃপর তিনি (রহ.) বলেন, জন্মস্থান নির্ধারিত হওয়ার বিশুদ্ধতা একেবারেই অসম্ভব; “কেননা তিনি জন্মগ্রহণ করেন জাহেলী যুগে। এমন কেউ তখন ছিলো না, যে স্থানগুলো সংরক্ষণ করে রাখবে। বিশেষ করে তাদের এ ব্যাপারে কোনো লক্ষ্য বা চিন্তাও ছিলো না। পক্ষান্তরে ইসলামের আগমনের পর, সাহাবী ও তাবে তাবে’ঈনদের অবস্থা অবলোকন করে বুঝা যায় যে, শরীয়াত যেসব বিষয়ে গুরুত্ব দেয় না, তেমন স্থানের ব্যাপারে তাঁদেরও গুরুত্ব ছিলো না। কেননা এতে করে যা কিছু গুরুত্বপূর্ণ তা থেকে বিমুখতার ভয় করতেন তারা এবং শরীয়াতকেই তারা হাতিয়ার ও জবান দ্বারা হিফাজত করতেন।” ৩
আধুনিক যুগের বিখ্যাত ঐতিহাসিক হামাদ আল-জাসের বলেন, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন স্থানে জন্মগ্রহণ করেছেন এ মতভেদ থাকা সত্বেও ঐ মতের নিশ্চয়তা যা জনসাধারণের নিকট নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্মস্থান নামের পরিচিত, তা কোনো ঐতিহাসিক সঠিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়।” ৪
জন্মস্থানের নির্দিষ্টতায় উলামা ও ঐতিহাসিকগণের মতভেদ হওয়া দ্বারা নিঃসন্দেহে এটা প্রমাণিত হয় যে, সে বিষয়ে সম্মানিত সাহাবীগণের কোনো গুরুত্ব ছিলো না। কেননা তার সাথে শরীয়াতের আমলের কোনো সম্পর্ক নেই নতুবা অবশ্যই কোনো স্থানের ব্যাপারে তাদের ঐক্যমত বর্ণনা হত যদি তা নির্ধারিত ও প্রসিদ্ধ থাকত। যেমন, হজ্জের নির্দশনাবলী সর্বজনবিদিত ও সর্বজ্ঞাত।
লাইব্রেরি যিয়ারত ও তা থেকে বরকত নেওয়া কি শরীয়াত সম্মত?
ইবাদত ও সওয়াবের জন্য উক্ত লাইব্রেরি যিয়ারত করা বৈধ নয়। কেননা এ ব্যাপারে কোনো দলীল নেই। প্রথমত: ইবাদতের সূত্র হলো, দলীল না থাকলে বিরত থাকা এবং দ্বিতীয়ত: ইতোপূর্বে যা বর্ণনা করা হয়েছে তার ভিত্তিতে বুঝা যায় তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জন্মস্থানকে নির্ধারণ করা বিশুদ্ধ নয়।
তর্কের খাতিরে যদি তার বিশুদ্ধতা ধরে নেওয়া যায় তবুও সেখান থেকে কোনোভাবেই বরকত গ্রহণ করা জায়েয নয়। কেননা তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে সকল স্থানে বসেছেন, অবস্থান করেছেন, সালাত আদায় করেছেন ইত্যাদি যে স্থানগত নিদর্শন বা চিহ্ন রয়েছে, তৎমধ্যে জন্মস্থানও একটি। এসব ক্ষেত্রে বরকত গ্রহণের বৈধতার কোনো দলীল নেই।
নবী সা.-এর চলার পথে কাঁটা:
‘নবী করিম হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন নামাজ পড়তে যাচ্ছেন মসজিদে। মসজিদের পাশেই রয়েছে এক বুড়ির বাড়ি। বুড়ির বাড়ির পাশ দিয়ে মসজিদে যাওয়ার সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পায়ে একদিন অকস্মাৎ কাঁটা বিঁধে গেল। এতে তিনি ব্যথা পেলেও পায়ের পাতা থেকে কাঁটা ফেলে দিয়ে মসজিদে নামাজ পড়তে চলে যান। এরপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিদিনই বুড়ির বাড়ির পাশ দিয়ে মসজিদে নামাজে যাওয়ার সময় পায়ে কাঁটা বিঁধে যেত। একদিন স্বয়ং নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখতে পেলেন বুড়ি রাস্তায় কাঁটা ফেলে রাখছেন। আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে প্রতিদিন পায়ের কাঁটা ফেলে দিয়ে নামাজে যাওয়া-আসা করতেন। সেই বুড়ি ছিল অমুসলিম, মুশরিক। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওখানে আল্লাহ্ তা’আলার প্রিয় ইসলাম ধর্ম প্রচার করছিলেন। বুড়ি অমুসলিম মূর্তি পুজক হিসেবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেননি। ফলে আল্লাহর ধর্ম প্রচার করা বুড়ির পছন্দ হয়নি বলেই আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট দেওয়া এবং ইসলাম প্রচার থেকে বিরত রাখার জন্য রাস্তায় কাঁটা ফেলে রাখতেন। কিন্তু একদিন আল্লাহ্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখতে পেলেন যে রাস্তায় কাঁটা নেই। এতে তিনি মনে মনে সন্দেহ পোষণ করলেন যে, নিশ্চয়ই বুড়ির কিছু একটা হয়েছে। এই ভেবে নামাজ শেষে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানব, যাঁর সৃষ্টি রহস্যের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির রহস্য, আল্লাহ্র পিয়ারা হাবিব হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মনের মধ্যে বিন্দু মাত্রও হিংসা বা বিদ্বেষ না রেখে বুড়িকে দেখতে গেলেন। আল্লাহ্র নবী গিয়ে দেখলেন, বুড়ি বিছানায় শুয়ে আছেন। বুড়ির শরীর গরমে পুঁড়ে যাচ্ছে। প্রচণ্ড জ্বরে বুড়ির মুখ থেকে গো গো আওয়াজ বের হচ্ছে। দয়ার সাগর আল্লাহ্র রাসূল সা. বুড়ির শারিরীক অবস্থা দেখে বিচলিত হলেন এবং তাঁকে সেবা শুশ্রুষা করে সুস্থ করে তুললেন। আল্লাহ্র নবী ইচ্ছে করলে বুড়ি তাঁর প্রতি যে আচরণ করেছেন প্রতিশোধ হিসেবে তিনি বুড়ির সেবা না দিলেও বলার কেউ ছিল না। কিন্তু তিনি তো আল্লাহ্র নবী, দয়ার সাগর, ইসলাম প্রচারক, আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ, মহামানব।’
উপরে বর্ণিত গল্পটি বিগত শতকের ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা বোর্ডের মাধ্যমিক স্তরে বিদ্যালয়ের পাঠ্য বইয়ের একটি জনপ্রিয় গল্প। এই গল্পটি তৎকালীন সময়ের বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পড়েছেন। ফলে বুড়ির প্রতি একটি বিদ্বেষ মনে মনে পোষণ করতেন শিক্ষার্থীরা। শিশু মনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মহানুভবতার শিক্ষা দেওয়ার জন্য এই গল্প। গল্প মানে গল্প বা কল্পকাহিনী বা কাহিনী। তবে অনেক সময় বাস্তবতাকে কেন্দ্র করেই গল্প লিখা হয়। অনেক গল্প লেখক বাস্তবভিত্তিক গল্প লিখেছেন। আবার অনেকেই গল্পের জন্য গল্প লিখেছেন।
তারা আল্লাহর রাসূল সা.কে যেভাবে কষ্ট দিতো
ইসলামের ইতিহাসে আল্লাহ্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চলাচলের পথে কাঁটা দেওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। ইসলামের ইতিহাসে রয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্মস্থান পবিত্র মক্কা মুয়াজ্জামার বায়তুল্লাহর পাশেই রাসূল সা.-এর হাঁটার পথে কাঁটা দেওয়া হতো। গল্পের মধ্যে যদিও বুড়ির কথা বলা হয়েছে তবে বাস্তবে আল্লাহ্ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চলাচলের পথে কাঁটা দিতো তাঁর আপন চাচী। তার নাম উম্মে জামিলা। বিষয়টি ইতিহাসবিদ ও সীরাতকাররা এভাবে বর্র্ণনা করেছেন,- “মক্কায় আবু লাহাব ছিলো সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকটতম প্রতিবেশি। উভয়ের ঘরের মাঝখানে ছিল একটি প্রাচীর। এছাড়াও হাকাম ইবনে আস (মারওয়ানের বাপ), উকবা ইবনে আবু মুঈত, আদী ইবনে হামরা ও উবনুল আসদায়েল হুযালীও তাঁর প্রতিবেশি ছিল। এরাও বাড়িতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিশ্চিন্তে থাকতে দিত না। তিনি যখন নামায পড়তেন, এরা তখন ওপর থেকে ছাগলের নাড়িভূড়ি তাঁর গায়ে নিক্ষেপ করতো। কখনো তাঁর বাড়ির আঙিনায় রান্নাবান্না হতো এরা হাঁড়ির মধ্যে ময়লা ছুঁড়ে দিতো। রাসূলুল্লাহ সা. বাইরে এসে তাদেরকে বলতেন, “হে বনী আবদে মান্নাফ! এ কেমন প্রতিবেশি সূলভ আচরণ?” আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীল (আবু সুফিয়ানের বোন) প্রতি রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ঘরের দরজার সামনে কাঁটাগাছের ডাল পালা ছড়িয়েছিটিয়ে রেখে দিতো। এটা ছিলো তার প্রতিদিনের স্থায়ী আচরণ। যাতে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা তাঁর শিশু সন্তানরা বাইরে বের হলে তাদের পায়ে কাঁটা বিঁধে যায়। (বায়হাকী, ইবনে আবী হাতেম, ইবনে জারীর, ইবনে আসাকির ও ইবনে হিসাম)।” ৫
ইসলামের শত্রু, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শত্রু, আল্লাহ্ তা’আলার অবাধ্য আবু লাহাব। এই আবু লাহাব ইসলাম ধর্মকে পৃথিবী থেকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করতে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করেছে। আবু লাহাব আল্লাহ্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল। “আবু লাহাবের আসল নাম ছিল আবদুল উয্যা। সে ছিল আবদুল মোত্তালিবের অন্যতম সন্তান। গৌরবর্ণের কারণে তার ডাক নাম হয়ে যায় আবু লাহাব। কুরআন করিম তার আসল নাম কর্তন করেছে। কারণ, সেটা মুশরিকী নাম। এছাড়া আবু লাহাব নামের মধ্যে জাহান্নামের সাথে বেশ মিলও রয়েছে। সে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কট্টর শত্রু ও ইসলামের ঘোর বিরোধী ছিল। সে নানাভাবে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট দেয়ার প্রয়াস পেত। তিনি যখন মানুষকে ঈমানের দাওয়াত দিতেন, তখন সে সাথে সাথে গিয়ে তাঁকে (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মিথ্যাবাদী বলে প্রচার করত। (ইবনে-কাসীর)।” ৬
“আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামিলের আসল নাম ছিল আবওয়া (তবে তাফহীমুল কুরআনের আমপারা খণ্ডের সূরা আল লাহাবের আলোচনায় তার আসল নাম লেখা হয়েছে “আরদা”)। সে ছিল হারব ইবনে উমাইয়্যার মেয়ে এবং আবু সুফিয়ানের ভগ্নি। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি শত্রুতার ক্ষেত্রে সে তার স্বামী অপেক্ষা কোন অংশে কম ছিল না। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে পথে যাতায়াত করতেন, ঐ পথে এবং তাঁর দরজায় সে কাঁটা বিছিয়ে রাখত। এ নোংরা মহিলা ছিল অত্যন্ত অশ্লীল ভাষী এবং ঝগড়াটে। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গালাগাল দেয়া এবং কুটনামি, নানা ছুতোয় ঝগড়া, ফেতনা- ফাসাদ সৃষ্টি এবং সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করা ছিল তার কাজ। এ কারণে পবিত্র কুরআন করিমে আল্লাহ্ সুবহানুতালা সূরা আল লাহাব-এর ৪ নম্বর আয়াতে এরশাদ করেছেন এভাবে, وَامْرَاَتُهُ حَمَّالَةَ الْحَطَبِ (۴)
যার বাংলা অর্থ- “এবং তার স্ত্রীও, সে ইন্ধন বহন করে।”
আবু লাহাবের স্ত্রী যখন জানতে পারল যে, তার এবং তার স্বামীর নিন্দা করে আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে, তখন সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে খুঁজতে খুঁজতে বায়তুল্লাহর নিকটে এল। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে সময় বায়তুল্লাহর অভ্যন্তরে অবস্থান করছিলেন। তাঁর সাথে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা.ও ছিলেন। আবু লাহাবের স্ত্রীর হাতে এক মুষ্ঠি পাথর ছিল। আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছুলে আল্লাহ্ তা’আলা তার দৃষ্টি কেড়ে নেন, সে আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখতে পায়নি, হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা.-কে দেখতে পাচ্ছিল। হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর সামনে গিয়ে সে জিজ্ঞেস করল যে, তোমার সাথী কোথায়? আমি শুনেছি, তিনি আমার নামে নিন্দা করছেন। আল্লাহ্র কসম, আমি তাকে পেয়ে গেলে তার মুখে এ পাথর ছুঁড়ে মারব।” ৭
তাদের উপর আল্লাহ্র লানত
এসব ঘটনার অল্পকিছুদিন যেতে না যেতেই আবু লাহাব, আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামিলা, ওকবা ইবনে রবিয়া, শায়বা ইবনে রবিয়া, ওলীদ ইবনে ওতবা, উমাইয়া ইবনে খালফ, হাকাম ইবনে আস (মারওয়ানের বাপ), আদী ইবনে হামরা ও উবনুল আসদায়েল হুযালীও এবং উকবা ইবনে আবু মুঈতসহ আরো কতেক ব্যক্তির লাশ পড়েছিল।
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বসতবাড়ি এবং বায়তুল্লাহ্র মাঝখানে রয়েছে হাম্মাম। কয়েকতলা বিশিষ্ট এই হাম্মামটির কিছু অংশ রয়েছে ভূ-গর্ভে। আরবি শব্দ হাম্মাম অর্থ টয়লেট। যারা আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট দিয়েছিলো বর্তমানের তাদের বসত ভিটির উপরেই এই হাম্মাম নির্মিত হয়েছে।
উপসংহার
আল্লাহ্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাড়িটিকে বর্তমান সৌদি সরকার তথা মসজিদুল হারাম ও মসজিদুন নব্বী’র তত্ত্বাবধায়ক পাঠাগারে রূপান্তর করেছেন। এটা খুবই ভাল সিদ্ধান্ত। তবে আল্লাহ্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর স্মৃতি বিজড়িত উক্ত বাড়িটিকে আরো আকর্ষণীয় ও দৃৃষ্টি নন্দন করা যেতো। কিন্তু সৌদি আরব সরকার কেনো যে বাড়িটির প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করছে তা অন্তত আমার বোধগম্য নয়। শুধু কি তাই, আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাড়ির চৌহদ্দি নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয় না। সৌদি সরকারের এই অবহেলা ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে।
উক্ত ভবনটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্মস্থান অন্তরে পোষণ করে কতিপয় হাজী মক্কা লাইব্রেরিতে বিভিন্নভাবে সুন্নাহ পরিপন্থী কর্মে লিপ্ত থাকে। কেননা তারা সে স্থানের পবিত্রতা ও বিশেষ বৈশিষ্ট্যেও বিশ্বাসী। যার ভ্রান্ততা ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যেন হাজীগণ সে সব বিদয়াত থেকে নিজেদেরকে হেফাজত করেন। নিম্নে তার কিছু অংশের প্রতি ইঙ্গিত করা হলো :
১। লাইব্রেরিটি ইবাদাত-সওয়াবের নিয়তে যিয়ারত, তাঁর পবিত্রতা ও বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে বলে বিশ্বাস করা।
২। সেখানে আল্লাহ ব্যতিত অন্যের নিকট দোয়া করা এবং তার থেকে প্রয়োজনে পূরণ কামনা করা।
৩। তার চারিপাশে তাওয়াফ করা।
৪। তার দিকে ফিরে সালাত আদায় করা।
৫। সেখানে বেশি বেশি দোয়া করা ও তিলাওয়াত করা।
৬। তার দেওয়াল ও ধুলা-বালি দ্বারা বরকত গ্রহণ করা।
৭। তার উপর লেখা-লেখি করা।
৮। তার দরজা ও দেওয়ালে আতর মাখান।
৯। তার সাথে কোনো চিহ্ন যেমন কাগজ, ম্যাসেজ ও চুল স্থাপন করা।
তথ্যসূত্র :
আল-ফাসির শেফাউল গারাম বি আখবারিল বালাদিল হারাম : ১/২৬৯ প্রভৃতি গ্রন্থ।
পূর্বোক্ত।
রেহলাতু আইয়্যাশিয়াহ : ১/২২৫
আসার ইসলামী, মাজাল্লাতুল আরাব, ৩ ও ৪ খণ্ড, রমজান ১৪০২ হিজরী।
তাফহীমুল কুরআন, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, অনুবাদ : আবদুল মান্নান তালিব, প্রকাশক : আধুনিক প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা, ২৩তম প্রকাশ, রবিউস সানি ১৪৩১, চৈত্র ১৪১৬, মার্চ ২০১০, পৃষ্ঠা-২৯৪।
পবিত্র কোরআনুল করীম (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তফসীর), মূল : তফসীর মাআরেফুল ক্বোরআন হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শাফী’ (রহ.), অনুবাদ ও সম্পাদনা : মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, সউদী আরবের মহামান্য শাসক-হারামাইনিশ্ শরীফাইন বাদশাহ ফাহ্দ ইবনে আবদুল আজিজের নির্দ্দেশে ও পৃষ্ঠপোষকতায় পবিত্র কোরআনের এ তরজমা ও সংক্ষিপ্ত তফসীর মুদ্রিত হলো। মুদ্রণ স্বত্ব : খাদেমুল- হারামাইন শরীফাইন বাদশাহ ফাহদ কোরআন মুদ্রণ প্রকল্প, কর্তৃক সংরক্ষিত। পো: বক্স নং-৩৫৬১ মদীনা মোনাওয়ারা। পৃষ্টা-১৪৮২।
আর রাহীকুল মাখতুম (রাসূলুল্লাহ্ (ছ.) এর অনন্য সীরাত গ্রন্থ)-আল্লামা ছফিউর রহমান মোবারকপুরী, অনুবাদ-মাওলানা ওবায়েদুর রহমান ইবনে আবদুল্লাহ এম এম হাদীস ও ফিকাহ্, ফাযেলে দারুল উলুম মইনুল ইসলাম, চট্টগ্রাম। প্রকাশক-মীনা বুক হাউস, ৪৫,বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০. তৃতীয় মুদ্রণ-মার্চ ২০১০। পৃষ্টা-৯৩।
-মুহম্মদ নূরুল ইসলাম
লেখক, গবেষক।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।