অনলাইন ডেস্ক: বিজ্ঞাপনসহ অনুষ্ঠান প্রচার করে-এমন বিদেশি টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার বাংলাদেশে বন্ধ রয়েছে। গতকাল ক্যাবল অপারেটররা বাংলাদেশে এসব চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, যেসব বিদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপনসহ অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়, সেগুলো বাংলাদেশে দেখানো যাবে না। ক্যাবল অপারেটররা বলছেন, বিজ্ঞাপনসহ অনুষ্ঠান প্রচার করে- এমন বিদেশি চ্যানেলগুলো থেকে বিজ্ঞাপন কেটে বাদ দিয়ে সম্পচার করা এই মুহুর্তে সম্ভব নয়। এ কারণে তারা চ্যানেলগুলো দেখানোই বাদ দিয়ে দিয়েছেন। ক্লিন ফিড বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল। গতকাল রাতে এ রিপোর্ট লেখার সময় বাংলাদেশের ক্যাবল নেটওয়ার্কে কোনো বিদেশি চ্যানেল সম্প্রচারে ছিল না। তবে ওটিটি এবং আইপি প্ল্যাটফরমে বিদেশি চ্যানেলগুলো দর্শকরা দেখতে পাচ্ছিলেন।

বিজ্ঞাপনবিহীন টেলিভিশন চ্যানেলের সম্প্রচার কার্যক্রমকে ক্লিনফিড বলা হয়ে থাকে। বিদেশি চ্যানেলগুলোর ক্লিনফিড বাস্তবায়নে গত ২রা সেপ্টেম্বর সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। বৈঠকের আলোকে ১৩ই সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি চিঠি ইস্যু করা হয়। চিঠিতে বলা হয়- ৩০শে সেপ্টেম্বরের পর ক্লিন ফিড ছাড়া কোনো বিদেশি চ্যানেল সম্প্রচার করা যাবে না। ক্যাবল অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য তাদের সদস্যদের কাছে নির্দেশনা পাঠায়। গতকাল তারা এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেছে। ফলে একযোগে সব বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। ক্যাবল অপারেটররা বলছেন, বিদেশি চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার বন্ধ থাকায় সাধারণ দর্শকরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অনেকেই ক্যাবল অপারেটরদের ফোন করে জানতে চাচ্ছেন কবে নাগাদ চ্যানেলগুলো চালু হবে। ক্যাবল অপারেটররা বলছেন, গৃহিনী, বৃদ্ধ ও শিশু এই তিন শ্রেণীর মানুষ এসব চ্যানেলের প্রধান দর্শক। হঠাৎ করে সম্প্রচার বন্ধ হওয়ায় তাদের অনেকেই অস্থিরতায় ভুগছেন। বিশেষ করে যারা টিভি সিরিয়াল দেখেন তারা নাটকের পর্ব মিস করছেন। ক্যাবল অপারেটরদের অনেকেই ফোন বন্ধ রেখেছেন। ক্লিন বাস্তবায়ন ডিস্ট্রিবিউটর বা ক্যাবল অপারেটরদের পক্ষে সম্ভব না। এটা বাস্তবায়ন করতে পারে ব্রডকাস্টাররা। তারা চ্যানেলগুলো আপলিংক করার সময় ক্লিন ফিড করে আপ করতে পারে। পরবর্তীতে চ্যানেলগুলো ক্যাবল অপারেটররা তাদের রিসিভারে ক্লিন ফিডসহ রিসিভ করবে। কিন্তু বাংলাদেশের যে মার্কেট সাইজ রয়েছে তার জন্য পুরো প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে আলাদা স্যাটেলাইট প্রয়োজন। এছাড়া ক্যাবল অপারেটরদের রিসিভারগুলোও পরিবর্তন করতে হবে। বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছিল ডিস্ট্রিবিউটররা। তারা জানিয়েছিল, এই বিপুলসংখ্যক রিসিভার পরিবর্তন করা সময় সাপেক্ষ। করোনা মহামারির কারণে রিসিভার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যাপ্ত উৎপাদন করতে পারেনি। তাই বাজারে রিসিভারের সংকট আছে। পুরো প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়নে ব্রডকাস্টাররা ডিস্ট্রিবিউটরদের কাছে ১৮ মাস সময় চেয়েছে। ক্যাবল অপারেটরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (কোয়াব) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এস এম আনোয়ার পারভেজ বলেন, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী বিজ্ঞাপনসহ অনুষ্ঠান প্রচার করে-এমন বিদেশি চ্যানেল বাংলাদেশে দেখানো যাবে না। তাই তা তারা দেখানো বন্ধ রেখেছেন। সরকার পরবর্তী সময়ে নতুন কোনো নির্দেশনা দিলে বা পদক্ষেপ নিলে, তারা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন। তবে ওটিটি ও আইপি প্ল্যাটফর্মে বিদেশি চ্যানেলগুলো চালু রয়েছে বলে জানান আনোয়ার পারভেজ। তিনি বলেন, আইপি চ্যানেলগুলোতে বিজ্ঞাপনসহ অনুষ্ঠান প্রচার হচ্ছে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচারের সুযোগ রয়েছে। সিদ্ধান্তটি সবার বেলায় প্রযোজ্য হলে আমাদের আপত্তি থাকবে না। তথ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠির প্রেক্ষিতে ক্যাবল অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন একটি সাধারণ বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। প্রতিটি বিদেশি চ্যানেল ক্লিক করলেই বিজ্ঞপ্তিটি ভেসে ওঠে। এতে বলা হয়েছে- সম্মানিত দর্শকবৃন্দ তথ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ৩০শে সেপ্টেম্বরের পর ক্লিন ফিড ছাড়া কোনো বিদেশি চ্যানেল সম্প্রচার করা যাবে না। সরকারের এই সিদ্ধান্ত মোতাবেক রাষ্ট্রের সুনাগরিক হিসেবে ক্যাবল নেটওয়ার্কে আমরা ক্লিন ফিড বিহীন বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার থেকে বিরত থাকবো। এর ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট অসুবিধার জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। বাংলাদেশে বিদেশি চ্যানেলের ডিস্ট্রিবিউটর ওয়ান এ্যালাইন্স লিমিটেডের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর সাইফুল হাসান বলেন, অবাধ তথ্য প্রযুক্তির যুগে চ্যানেল বন্ধ রেখে ক্লিন ফিড বাস্তবায়ন সম্ভব না। মানুষ ক্যাবল নেটওয়ার্কে বিদেশি চ্যানেল না পেলে বিকল্প মাধ্যমে যাবে। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ক্যাবল অপারেটররা। বাংলাদেশে প্রায় ৩ হাজার ২০০ বৈধ লাইসেন্সধারী অপারেটর রয়েছেন। এদের মাধ্যমে প্রায় দেড় কোটি মানুষ বিদেশি চ্যানেল দেখার সুযোগ পেতেন। দেশে সম্প্রচারে থাকা বিদেশি চ্যানেলের সংখ্যা প্রায় ৮৫। এর মধ্যে প্রায় ৬০-৬৫টি ভারতীয় চ্যানেল। সরকারের এই সিদ্ধান্তের কারণে প্রোগ্রাম চ্যানেলের পাশাপাশি বন্ধ হয়ে গেছে বিবিসি, সিএনএন, আল-জাজিরাসহ আন্তর্জাতিক সব সংবাদ চ্যানেলও। এদিকে ক্লিনফিড না চলার কারণে দেশের অর্থনীতি, শিল্পী, শিল্প, সংস্কৃতি ও মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। গতকাল ইমপ্রেস গ্রুপের কার্যালয়ে চ্যানেল আই টেলিভিশন সম্প্রচারের ২৩তম বর্ষে পদার্পণ অনুষ্ঠানে মন্ত্রী এ মন্তব্য করেন। আইনানুসারে বিদেশি টিভি চ্যানেলের বিজ্ঞাপনমুক্ত বা ক্লিনফিড সম্প্রচার বাস্তবায়নে শুক্রবার থেকে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, বিদেশি টিভি ক্লিনফিড না চালানোর প্রেক্ষিতে কয়েক হাজার কোটি টাকা, যা দেশে লগ্নী হতো, তা বিদেশের চ্যানেলে লগ্নী হয়। আইনভঙ্গ করে বিদেশি চ্যানেলে যদি বিজ্ঞাপন না দেখানো হতো, তবে দেশের মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি লাভবান হতো, অর্থাৎ দেশের অর্থনীতি লাভবান হতো। ক্লিনফিড না চলার কারণে দেশের অর্থনীতি, শিল্পী, শিল্প, সংস্কৃতি ও মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সেকারণেই আমরা এ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। ওটিটি প্ল্যাটফরম নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তথ্যমন্ত্রী বলেন, ওটিটি প্ল্যাটফরম নিয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়নের কাজ চলছে, খসড়া সম্পন্ন হয়েছে। নীতিমালা পাশ হলে, প্ল্যাটফরমগুলোকে তা অনুসরণ করতে হবে এবং কোনো বাত্যয় হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদিকে বিদেশি টিভি চ্যানেলের বিজ্ঞাপনমুক্ত বা ক্লিনফিড সম্প্রচার বাস্তবায়নের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে দেশের টিভি চ্যানেল মালিকদের সংগঠন এসোসিয়েশন অফ টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্স-এ্যাটকো এবং টিভি চ্যানেলগুলোতে কর্মরত সাংবাদিকবৃন্দের সংগঠন ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার-বিজেসি। দেশের সকল টিভিতে মন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে স্ক্রল প্রচারের পাশাপাশি বিজেসি এ নিয়ে লিখিত বিবৃতি দিয়েছে। বিজেস্থির বিবৃতিতে বলা হয়, ২০০৬ সালের ক্যাবল নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইনে এ বিধান থাকলেও এর আগে কখোনই এটি কার্যকর করার উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বর্তমান তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রীর সাহসী পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার-বিজেসি। এতে দেশি টেলিভিশন চ্যানেল শিল্পের আর্থিক সংকট কমবে এবং উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি সম্প্রচারকর্মীরাও এর সুফল পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
-মানবজমিন