– অধ্যাপক সুলতান আহমদ
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দীর্ঘ নয় মাসের অপরিমেয় রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। ব্রিটিশ শাসন পরবর্তী ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত দীর্ঘ চব্বিশ বছর বর্তমান বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাছে পরাধীন অবস্থায়। অবশ্য ৪৭ এ বর্তমান বাংলাদেশ স্বেচ্ছায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাছে অধীনস্থ হয়েছিল ধর্ম ভিত্তিক জাতীয় পরিচয়ে। চব্বিশ বছরের শাসনামলে পূর্ব-পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশ পশ্চিম-পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হাতে ন্যায্য তো কিছুই পায়নি, বরং দিনের পর দিন প্রহসন, বঞ্চনা, প্রতারণা, শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। এর পরিমাণ এতবেশি হয়েছিল যে, যার পরিণামের বাস্তবতায় স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম।
কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্তের পরও বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডে বাংলাদেশী নাগরিকত্ব নিয়ে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে ত্রিবিধ বা তিন-ধারার বিভক্তি স্পষ্টভাবে বিদ্যমান। এই তিন ধারার একদল বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে অম্লান বদনে মাতৃভূমি হিসেবে ভালবাসে; অপরদল এখনও পূর্ব-জাতিরাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানকে ভালবাসে এবং তৃতীয়দল পাশ্ববর্তী বড় বা মোড়ল রাষ্ট্র হিসেবে ভারতকে ভালবাসে। এক্ষণে এই তিন-ধারার বিস্তারিত তুলে ধরছি।
প্রথমত, যেহেতু আমরা পাকিস্তানি রাষ্ট্রের অধীন ছিলাম, তাই কিছু ঘোরতর পাকিস্তানি-পন্থি লোক বাংলাদেশী নাগরিকত্ব অধিকার ও ভোগ করার পরও পাকিস্তানি মানসিকতায় দৃঢ়বদ্ধ আস্থাশীল। তারা বাংলাদেশে বসবাস করেও পাকিস্তানের প্রতি ভালবাসা একবিন্দু পরিমাণও কমাতে পারেনি তাদের মন থেকে। এক্ষণে যদি আবারও বর্তমান বাংলাদেশ ’৪৭-এর মতো পাকিস্তানের অংশ হয়ে যায় এরা সর্বোচ্চ পরিমাণ আনন্দিত ও গর্বিত হবে। যেমন আমরা একেবারেই সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ করলাম : বাংলাদেশ-পাকিস্তান ক্রিকেট খেলায় মিরপুরের খেলার মাঠে বাংলাদেশী ক্রীড়াপ্রেমী মানুষ, যারা পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা হাতে মাঠে স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে পাকিস্তানি ক্রিকেট দলকে উৎসাহিত করতে। এদের আমরা স্পষ্টভাবে ব্যক্তি শনাক্ত না করেও তাদের সংখ্যা শনাক্ত করা রাষ্ট্রের জন্য জরুরি বলে মনে করি।
দ্বিতীয়ত, একইভাবে যেহেতু ১৯৭১ এ প্রতিবেশি বন্ধু রাষ্ট্র ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভে সর্বোচ্চ পরিমাণ সহায়তা করেছিল; কতক পরিমাণ বাংলাদেশী নাগরিক বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডে বসবাস করে, বাংলাদেশী নাগরিকত্ব অধিকার ও ভোগ করার পরেও ভারত-প্রীতি মনে পোষণ করে দৃঢ়বদ্ধ আস্থাশীলতায়। তারা হয়ত একাত্তরেও কল্পনা করেছিল বাংলাদেশকে স্বাধীনতার প্রলোভন দিয়ে ভারত যেন অধিকৃত রাজ্য-হিসেবে দখল করে নেয়। এদের ভারত-প্রীতি এতবেশি যে, তাদের আর্থিক মুদ্রামানের ধন-সম্পদ বাংলাদেশ থেকে আয় করে ভারতের ব্যাংক-একাউন্টে জমা করে। অথবা, সেখানে অবস্থা্নরত তাদের আত্মীয়-স্বজনের কাছে পাঠিয়ে দেয়। এরা এখনও স্বপ্ন দেখে- বাংলাদেশকে ভারত দখল করুক, তবেই এরা গর্বিত ও আনন্দিত হবে। এদেরও স্পষ্টভাবে ব্যক্তি শনাক্ত না করেও সংখ্যা শনাক্ত করা জরুরি বলে মনে করছি।
তৃতীয়-দল সম্পর্কে বিস্তারিত লিখার দরকার আছে বলে মনে করছি না। তবু সাধারণ কথায়- এরা মনে প্রাণে বাঙালি বললেও খুশি, বাংলাদেশী বললেও খুশি, বাংলাদেশ রাষ্ট্র তাদের কাছে আজন্ম বিস্ময়কর অহংকার। বাংলাদেশের প্রতিটি ভূমি-কণা তাদের কাছে শ্রদ্ধার্ঘ, মাতৃভূমি, মাতৃভাষা সবকিছু পবিত্র-জ্ঞানে ভালবাসেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিবর্গ তাদের কাছে সবকিছুর উর্ধ্বে ভালবাসার প্রতিমা।
এবারে আসি ভিন্নধর্মী জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গে।
এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী নেই, মারামারি নেই, টাকার দাপট নেই, ব্যক্তিগত লাভালাভ নেই, হিংসা নেই, জয়-পরাজয়ের হিসাব-নিকাশ নেই। আছে শুধুমাত্র বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের অক্ষুণ্ন সার্বভৌমত্বের নিশ্চয়তা, প্রায় সময় বিপন্নতার মুখোমুখি হতে যাওয়া স্বাধীনতার নিরাপদ দৃঢ়স্তম্ভ প্রতিষ্ঠা। যারা বাংলাদেশী নাগরিকত্ব নিয়ে পাকিস্তান ও ভারতের প্রতি ভালবাসা বা দেশপ্রেম মনে পোষণ করে, লালন করে তাদের দ্বারাই কিন্তু প্রায়সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার অস্তিত্ব বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়।
ভোট হবে একদিনেই। যার যার ভোট, সেই দেবে স্বাধীনভাবে। ভোট-ব্যালটে মার্কা হবে তিনটি রাষ্ট্রের পতাকার ওপর : বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারত। যারা মনে প্রাণে বাংলাদেশকে ভালবাসে, তারা বাংলাদেশের পতাকার ওপর। যারা ভেতরে ভেতরে পাকিস্তানকে ভালবাসে, তারা পাকিস্তানের পতাকার ওপর। এবং যারা একইভাবে অন্তরে ভারতের প্রতি ভালবাসা অনুভব করে, তারা ভারতের পতাকার ওপর। আবারও বলছি, ব্যক্তিগতভাবে তাদের শনাক্ত করার দরকার নেই, কিন্তু তাদের সংখ্যা বা পরিমাণ শনাক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ।
পুরো বাংলাদেশের ওয়ার্ড ভিত্তিক ভোট হতে হবে। ওয়ার্ডের ফলাফল ওয়ার্ডের কেন্দ্রে, ইউনিয়ন পরিষদ বোর্ডের নোটিশ বোর্ডে এবং উপজেলা পরিষদের নোটিশ বোর্ডে সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করতে হবে। যারা ভোট দানে বিরত থাকবে, কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ পরবর্তী তালিকা থেকে অথবা ভোটের ব্যালটের মুণ্ডায় লিখিত ভোট নাম্বার থেকে তাদের চিহ্নিত করতে হবে। এদেরকে সরাসরি পাকিস্তানি অথবা ভারতী মানসিকতার ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করতে হবে।
এ ভোট আয়োজনে রাষ্ট্রকে বড় বেশি কাঠখড় পোড়াতে হবে না। বিশাল পরিমাণে খরচ, নিরাপত্তা বাহিনী দিয়ে নির্বাচন নির্বিঘ্ন করার দরকার হবে না। নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের পেছনে সম্মানি-বাবদ বেশি টাকা খরচ করার দরকার নেই; যেহেতু এই নির্বাচনটি ঝুঁকিপূর্ণ নয়।
রাষ্ট্রের পরবর্তী কার্যক্রম হবে সুপরিকল্পিত। ওয়ার্ড ভিত্তিক শনাক্ত সংখ্যার ওপরে পাকিস্তান ও ভারতীয় মানসিকতার ব্যক্তিদের ব্রেনওয়াশের ব্যবস্থা নিয়ে তাদের মাথা থেকে পাকিস্তানি ও ভারতীয় ভুত দূর করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য তৈরির ব্যবস্থা করা। অথবা তারা যেন বাংলাদেশ ভূখণ্ড ছেড়ে, বাংলাদেশী নাগরিকত্ব বর্জন করে অগস্ত-যাত্রার মতো করে পাকিস্তান অথবা ভারতে চলে যায় সেই ব্যবস্থা করা। তাহলেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব চিরদিন স্থায়ীভাবে নিরাপদ ও অক্ষুণ্ন থাকবে বলে আশা করা যায়।
(এখানে ব্যক্ত মতামত লেখকের একান্ত নিজস্ব-সিবিএন)
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।