আবুল কাসেম আশরাফ :
যিনি শিক্ষা দান করেন, তিনিই শিক্ষক। কিন্তু সবাই আদর্শ শিক্ষক হন না। একজন আদর্শ শিক্ষকের মাঝে কি কি মৌলিক গুণাবলী থাকা দরকার সেটাই আলোচ্য নিবন্ধে উপস্থাপন করা হল।-
আদর্শ শিক্ষকের পরিচয় :
শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত মানুষকে আমরা শিক্ষক বলে জানি। আনুষ্ঠানিক, উপানুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক ইত্যাদি নানানভাবে শিক্ষাদানের কাজ চলছে। তবে মক্তব, মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যারা শিক্ষাদানে জড়িত তাদেরই সাধারণত শিক্ষক বলা হয়। আদর্শ শব্দের অর্থ অনুকরণযোগ্য, শ্রেষ্ঠ, নমুনা, দৃষ্টান্ত, আয়না, দর্পণ ইত্যাদি।আদর্শ বিদ্যালয়,যে বিদ্যালয়ে চরিত্র গঠন ও জীবনমান উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন বিষয়ে উন্নত ধরনের শিক্ষা দেওয়া হয়।
আদর্শ শিক্ষক তিনি, যার অনুকরণের মাধ্যমে চরিত্র গঠন করা যায় এবং জীবনের মানোন্নয়নের জন্য বিভিন্ন বিষয়ে উন্নত ধরনের শিক্ষা লাভ করা যায়। আদর্শ শিক্ষকের সঙ্গে জড়িয়ে আছে শ্রেণীকক্ষে পাঠদান এবং শ্রেণীকক্ষের বাইরের জীবন।
শ্রেণীকক্ষে তিনি থাকেন তার শিক্ষার্থীদের সাথে, আর শ্রেণীকক্ষের বাইরে কাটে তার ছাত্র-শিক্ষকসহ বৃহত্তর মানব সমাজের সাথে। তার বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী সর্বত্রই প্রস্ফুটিত হওয়াই স্বাভাবিক।
সবার আদর্শ যিনি :
এই ধরণীতে সবার আদর্শ শিক্ষক হলেন,আল্লাহর রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ)। তাঁর রিসালাতের অনেক দায়িত্বের একটি অংশও ছিল শিক্ষাদান।
রাসূল (সঃ) বলেছেন,আমি শিক্ষক হিসাবে প্রেরিত হয়েছি’।মু‘আবিয়া বিন হাকাম আস-সুলামী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ) সম্পর্কে বলেন,আমি তাঁর পূর্বে ও পরে তাঁর চেয়ে সুন্দর শিক্ষাদানকারী শিক্ষক আর দেখিনি। আল্লাহর কসম! তিনি আমাকে বকাবকি করেননি, মারেননি এবং গালমন্দও করেননি’।
আদর্শ শিক্ষকের চরিত্র :
বলা হয়, চরিত্র মানব জীবনের রাজমুকুট। চরিত্রহীন ব্যক্তি পশুর সমান। দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য।
তাই আদর্শ শিক্ষক সচ্চরিত্রের গুণাবলী অর্জন ও চর্চায় কোন আপোষ করেন না। সত্যবাদিতা, শালীনতা, শিষ্টাচারিতা, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ,কর্তব্যপরায়ণতা, মিতব্যয়িতা, পরোপকারিতা,পরিচ্ছন্ন বেশভূষা ইত্যাদি সৎগুণ গুলো তার চরিত্রের ভূষণ।
পক্ষান্তরে মিথ্যা বলা, প্রতারণা, যুলুম, অহংকার, হিংসা, কৃপণতা, অপব্যয়, ধূমপান, মাদকাসক্তি, দুর্নীতি,নকলে সহযোগিতা, প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাৎ, সূদ-ঘুষ,উদাসীনতা,কর্তব্যে অবহেলা ইত্যাদি মন্দ স্বভাব-চরিত্র থেকে তিনি বেঁচে থাকেন।
হাশরের ময়দানে চরিত্রই হবে মীযানে সবচেয়ে ভারী।কাজেই একজন আদর্শ শিক্ষক নিজে যেমন চরিত্র সুন্দর রাখতে চেষ্টা করেন তেমনি তার শিক্ষার্থীদের সহ অন্যদের চরিত্রও সুন্দর করতে চেষ্টা করেন।
আদর্শ শিক্ষকের ব্যবহার :
অন্য মানুষের সঙ্গে যে আচার-আচরণ করা হয় তাই ব্যবহার। সদ্ব্যবহার সচ্চরিত্রের অংশ। হাদীসে এসেছে, ‘সুন্দর ব্যবহারই সচ্চরিত্র’। একজন ভাল শিক্ষক নিজের শিক্ষার্থী সহ অন্য কাউকে কষ্ট দেন না। শিক্ষার্থীদের পড়া বুঝিয়ে দিতে রাগ-ক্ষোভ প্রকাশ করেন না। উচ্চ মেধার শিক্ষার্থী,স্বল্প মেধার শিক্ষার্থী,ধনীর দুলাল, গরীবের সন্তান, ক্ষমতাধর ও ক্ষমতাশূন্য সকলকে তিনি এক মনে করে শিক্ষা দেন। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টান জৈন, পার্সীতে কোন ভেদাভেদ করেন না। শিক্ষার্থীরা তার সম্বন্ধে ভাবে, আমার শিক্ষক আমাকেই বেশী ভালোবাসেন।
শিক্ষার্থীদের কেউ অসুস্থ হলে তিনি তাকে দেখতে যান। তাদের কারও আর্থিক সমস্যা থাকলে তা দূর করতে চেষ্টা করেন। বিদ্যা শিক্ষা সংক্রান্ত তাদের কোন কৌতূহল বা জিজ্ঞাসা থাকলে তা যথাসাধ্য মিটাতে চেষ্টা করেন। শিক্ষার্থীদের দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, আত্মিক, ধর্মীয় ও নৈতিক বিকাশে নিজের মেধা ও যোগ্যতা যথাসাধ্য ব্যয় করেন। কেউ সাক্ষাৎ করতে এলে হাসিমুখে তার সাথে নম্র ভাষায় কথা বলেন। কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে বিলম্ব হেতু বিচলিত হন না, বরং ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেন। কারও প্রয়োজন পূরণে অক্ষম হলে বিনয়ের সঙ্গে নিজের অপারগতা প্রকাশ করেন। কারও অসদাচরণের জন্য গালমন্দ করেন না। রূঢ় আচরণ ও কর্কশ ভাষায় কথা বলা থেকে দূরে থাকেন।
কেউ তার সঙ্গে রূঢ় আচরণ করলে তিনি তার সঙ্গে কোমল আচরণ করেন এবং ধৈর্য ধরেন। কথা বললে বুদ্ধিদীপ্ত কথা বলেন। বাজে তামাশা কিংবা কারও মনে আঘাত লাগে এমন কথা বলা থেকে বিরত থাকেন। এমন কথা বলেন না, যাতে ব্যক্তিত্ব খর্ব হয় এবং মূর্খতা প্রকাশ পায়। তিনি খুব গুরুগম্ভীর নন, বরং সহজ-সরল হন।যে কেউ সহজেই তার সঙ্গে মিশতে পারে।
কোন জিজ্ঞাসার তাৎক্ষণিক উত্তর দিতে না পারলে তিনি শিক্ষার্থীদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন না, কিংবা নিজের অক্ষমতা ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা চালান না। বরং যারা আরও বেশী জানেন তাদের থেকে জেনে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেন। নিজের বিষয় জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য তিনি নতুন ও পুরাতন লেখকদের বই অধ্যয়ন করেন।আধুনিক কালে ইন্টারনেট ও ইউটিউবে প্রচুর বই-পুস্তক ও লেকচার পাওয়া যায়। একজন উত্তম শিক্ষক এগুলো ব্যবহারের কলাকৌশল জেনে তার মাধ্যমে নিজের প্রয়োজনীয় জ্ঞান আহরণ করেন। অনেক ভাল শিক্ষকের পাঠদান পদ্ধতিও অনুসরণ করেন। শিক্ষক শিক্ষালয়ের পাঠাগার তো ব্যবহার করেনই, উপরন্তু তার নিজেরও একটা সমৃদ্ধ লাইব্রেরী থাকে। শিক্ষাদান পদ্ধতির মানোন্নয়নে তার পক্ষে যেসব প্রশিক্ষণ গ্রহণ সম্ভব তা তিনি আগ্রহের সাথে গ্রহণ করেন। শিক্ষার কারিকুলাম, সিলেবাস, পরীক্ষা পদ্ধতি, নম্বর বণ্টন ইত্যাদি সম্পর্কে তার সম্যক জ্ঞান থাকে। শিক্ষার্থীদের তিনি তা অবহিত করেন এবং তার আলোকে পাঠদান করেন। তার পাঠদান ফলপ্রসূ হচ্ছে কিনা তা তিনি চূড়ান্ত মূল্যায়নের আগে অনেকবার গাঠনিকভাবে মূল্যায়ন করেন। তার পাঠদানকালে শিক্ষার্থীরা নিষ্ক্রিয় থাকে না, বরং তিনি তাদের সক্রিয় করে তোলেন। অন্যান্য সহকর্মীদের সাথেও তিনি পাঠ্য বিষয় আলোচনা করেন। তিনি সময়ের খুব দাম দেন। সময়ের কাজ সময়ে করা তার অভ্যাস। তিনি অলস সময় নষ্ট করেন না। প্রকাশ ক্ষমতাও শিক্ষকের অন্যতম গুণ। অনেক শিক্ষক ভাল জানেন বটে, কিন্তু উপস্থাপনার দোষে শিক্ষার্থীরা তার পাঠদানে অতৃপ্তি বোধ করে। আসলে শিক্ষকের সার্থকতা শিক্ষাদানে নয়, বরং শিক্ষার্থীদের পাঠ আয়ত্ত করতে সক্ষম করার মধ্যে।
আদর্শ শিক্ষকের ভাষা :
আদর্শ শিক্ষক প্রমিত বা আদর্শ উচ্চারণে কথা বলেন। ঘরোয়া পরিবেশে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বললেও জনসমক্ষে তিনি শুদ্ধ ভাষা ব্যবহার করেন। মার্জিত ও শুদ্ধ উচ্চারণ ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তোলায় ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
শিক্ষার্থীর চরিত্র ও মানস গঠনে শিক্ষক :
শিক্ষার্থীরা মাতা-পিতা ও পরিবারের আদর্শ যতখানি না অনুসরণ করে, তার থেকেও বেশী অনুসরণ করে শিক্ষককে।অবচেতন মনেই তাদের মাঝে এ মানসিকতা গড়ে ওঠে। ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন শিক্ষক কোন কিছু না বললেও শিক্ষার্থীদের মাঝে তার চারিত্রিক ও ব্যবহারিক প্রভাব সঞ্চারিত হয়।
শ্রেণীকক্ষে আদর্শ পাঠদান :
যারা শিক্ষাগ্রহণ করে তারা শিক্ষার্থী বা ছাত্র। শিক্ষা একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। তাদের বাড়ির কাজ দেওয়া ও পরীক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি আগামী দিনে যা পড়াবেন আগের দিন নিজে তার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেন, নোট নেন, প্রয়োজনীয় উপকরণ যোগাড় করেন এবং শিক্ষার্থীদেরও আগের দিন তা বাড়ি থেকে ভালোভাবে পড়ে আসতে বলেন। এর ফলে শিক্ষার্থী কোন জায়গায় পড়া বুঝতে পারছে না তা চিহ্নিত করতে পারে এবং শিক্ষকের পড়ানোর সময় মনোযোগ দিয়ে তা বুঝে নিতে পারে। তিনি একার মত একা বক্তৃতা দিচ্ছেন আর শিক্ষার্থীরা যার যার মত কথা বলছে কিংবা ভিন্ন কিছু ভাবছে এমনটা তার ক্লাসে হয় না। বরং তার পাঠদানে এমন কারিশ্মাটিক ভাব থাকে যা শিক্ষার্থীদের তার সঙ্গে পাঠে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। পাঠদান শেষে তিনি শিক্ষার্থীদের গ্রুপ স্টাডি বা পুনরালোচনা করতে বলেন এবং তা মনিটরিং করেন। এর ফলে সবল-দুর্বল সকল শিক্ষার্থীই তার পাঠে উপকৃত হয়। তিনি শিক্ষার্থীদের শ্রেণী পরীক্ষা ও বাড়ির কাজের মূল্যায়নে নম্বর প্রদান করেন। এর ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের মান বুঝতে পারে এবং উত্তরোত্তর উন্নতির চেষ্টা করে।শ্রেণীতে পাঠদান কালে ভাল,খুব ভাল, চেষ্টা চালিয়ে যাও, ভাল ফল করবে ইত্যাদি বলে শিক্ষার্থীদের ধন্যবাদ জানান।
মোটকথা,তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে পঠন-পাঠনের কাজ করেন এবং নিজের কর্তব্যে ফাঁকি দেন না। শিক্ষা একটি জটিল প্রক্রিয়াও বটে। অনেকে তাই বলেন যে, শিক্ষাকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। শিক্ষা কেউ কাউকে দিতে পারে না। শিক্ষার্থী নিজের চেষ্টায় শিক্ষা অর্জন করে। শিক্ষক এক্ষেত্রে একজন সহযোগিতাকারী মাত্র।
শেষকথা :
আদর্শ শিক্ষক বিষয়টি মূলতঃ আপেক্ষিক। উপরে বর্ণিত আদর্শ শিক্ষকের গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্যাবলি চূড়ান্ত কিছু নয়। অনেক শিক্ষকের মধ্যে এর চেয়ে বেশি গুণাবলী থাকতে পারে। আবার অনেকের ক্ষেত্রে এরচেয়েও কম থাকে। সকল শিক্ষক যদি দুনিয়ার সবচাইতে মর্যাদাবান পেশাটি যথাযথভাবে পালন করলে একটি আদর্শ জাতি ও সমৃদ্ধশালী দেশে পরিণত হবে বলে দৃঢ় আশা করা যায়।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।