মুহাম্মদ রিদোয়ান হক

মোহাম্মদ ছাইফুল্লাহ খালেদ। সহকারী শিক্ষক উত্তর লেমশীখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। একটি বিদ্যালয়ের প্রতি একজন শিক্ষকের কতটুকু দায়িত্বশীল মনোভাব এবং শিক্ষার্থীদের প্রতি কি পরিমাণ মায়া, মমতা, দরদ থাকলে দিনরাত পরিশ্রম করতে পারেন তা স্যারকে না দেখলে বুঝার কোনো উপায় নেই।

একটি শিক্ষা প্রজেক্টে কাজ করার সুবাদে স্যারের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়। সেই ২০১৮ সালে।স্যারের বিদ্যালয়ে নিয়মিত আমার ভিজিট এবং কাজ পরিচালনা করার জন্য স্যারের সাথে নিয়মিত বিদ্যালয়ের সার্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতাম।

এক সময় স্যার বলতেন, “আমি আমার পরিবারের চেয়ে এই বিদ্যালয়কে বেশি ভালোবাসি। কারণ আমি এই বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেছি এবং উচ্চ শিক্ষা শেষ করার পর আমি একই বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছি। এই বিদ্যালয়ের সাথে আমার শৈশব, আমার বেড়ে ওঠা, আমার শিক্ষার সূচনাসহ অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে।

বর্তমানে আমার নিজের ২ জন ছেলে-মেয়ে আর আত্মীয় স্বজনের সকল ছেলে-মেয়ে এই বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছে। তাই এই বিদ্যালয়ের প্রতি আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য বেশি বলে মনে করি।”

ঐ দিন স্যারের দরদ মাখা এবং আবেগঘন কথাগুলো শোনে আমি বলেছিলাম, “একদিন এই বিদ্যালয় পুরো কুতুবদিয়া তথা চট্টগ্রামে বিভাগের মডেল স্কুল হবে।”

সত্যি! স্যার ২০১৮ সালে কুতুবদিয়ার শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক মনোনীত হলেন। এরপর স্যারের কাজের গতি আরও বেশি বেড়ে গেল। বিদ্যালয়কে নিয়ে চিন্তা বেড়েছে। সব সময় দেখা হলে বলতেন,” কোনো নতুন কাজ আছে নাকি এবং আর কি কি করতে হবে।” স্যারের নতুন নতুন কাজের প্রতি এত স্পৃহা ও আকাঙ্খা দেখে আমি মাঝে মাঝে অভিভূত হয়ে যেতাম।

ছাইফুল্লাহ স্যার একাধারে কুতুবদিয়া উপজেলার বাংলা মাষ্টার ট্রেইনার। কুতুবদিয়া উপজেলা অনলাইন প্রাইমারি স্কুল কর্তৃক ধূরুং ক্লাস্টার করোনা কালীন পাঠদান পরিচালনাকারী এবং করোনা কালীন বিদ্যালয় থেকে নিয়মিত গুগলমীটে নিজ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাঠ পরিচালনা করতেন।

এছাড়া ‘রুম টু রীড়’ এর বাংলা মাষ্টার ট্রেইনার, কম্পিউটারের একজন দক্ষ প্রশিক্ষক। নিয়মিত প্রথম শ্রেণির বাংলা শিক্ষক এবং প্রথম শ্রেণির এস.আর.এম বা (পড়ার ঘন্টা শিক্ষক)। বিদ্যালয়ের এমন কোনো কাজ নেই। যা তিনি নিজ দায়িত্ব নিয়ে করেননি। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ভর্তি থেকে শুরু করে ঝড়ে পড়া, অনুপস্থিতি শিক্ষার্থী, কে কত দিন বিদ্যালয়ে আসেনি প্রভৃতি স্যারের নখদর্পনে হিসাব।

বিদ্যালয়ে ডাটা এম.আই.ই.এসে পোস্টিং দেওয়া থেকে শুরু করে অনলাইনের প্রতিটি কার্যক্রম তিনি স্বযত্নে অন্যান্য বিদ্যালয়ের আগেই শেষ করে ফেলতেন। বিদ্যালয়ে যতগুলো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কাজ করে (যেমন: ইউএসডিএ(USDA), ডাব্লিউএফপি(World Food programme), রুম টু রীড, রিক, ইপসা,সেইভ দ্যা সিলড্রেন) সে সব প্রতিষ্ঠানের সাথে সমন্বয় করে কাজ করার জন্য সদাপ্রস্তুত থাকতেন।

প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে বিদ্যালয়ের স্বার্থে সহযোগিতা করতেন। তিনি বলতেন,” কোনো বিদ্যালয় যদি রুম টু রিড়ের কার্যক্রমের যদি শ্রেণিকক্ষে ৫০-৬০% কার্যকর করে তাহলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কোনো শিক্ষার্থী বর্ণ, শব্দ, বাক্য ও রিডিং না পড়ে থাকতে পারে না।” ‘রুম টু রীড ‘ প্রতিটি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর পড়ার দক্ষতা ও স্বাধীন পাঠক তৈরি করার জন্য কাজ করেন। স্যার প্রথম দিন থেকেই ‘রুম টু রীড’ এর কার্যক্রমকে স্বাগতম জানিয়ে গ্রহণ করেছেন।

এছাড়াও বিদ্যালয়ের দুর্বল এবং অমনোযোগী শিক্ষার্থীদের জন্য অতিরিক্ত সহায়তা প্রদান করার জন্য নিজ উদ্যোগে সহায়তা ক্যাম্প চালু করেছেন। এমনকি অসহায় ও হতদরিদ্র শিক্ষার্থীদের নিজের ক্ষুদ্র তহবিল থেকে ড্রেস ও শিক্ষা উপকরণ সহায়তা প্রদান করে যাচ্ছেন।

নিয়মিত অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের বাড়ি ভিজিটিং সহ অসুস্থ শিক্ষার্থীদের খোঁজখবর রাখেন। যথাযথ সময়ে অভিভাবকদের নিয়ে উঠান বৈঠক ও অভিভাবক সমাবেশ, মা সমাবেশ চালু রেখেছেন এবং সকল অভিভাবকদের শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে উদ্বুদ্ধ করেন। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বুক ক্যাপ্টেন, ক্ষুদে ডাক্তার, ক্ষুদে কৃষকের কার্যক্রম চালু সহ নিয়মিত হাতে কলমে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন।

ছাইফুল্লাহ স্যারের বিদ্যালয় নিয়ে এতো স্বপ্ন এবং এতো উদ্যম ছিল, সেটা কি কেউ জানতো? এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ -২০২২ সাল পর্যন্ত পিইসিই ( প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনি পরীক্ষা) ফলাফলে কুতুবদিয়া দ্বীপে প্রথম স্থান অর্জন করে যাচ্ছে উত্তর লেমশীখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং সর্বোচ্চ বৃত্তি লাভ করে অত্র বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

সেই সাথে সারা বাংলাদশে প্রাথমিক শিক্ষা পদক ২০২৩ এ ২য় স্থান অর্জন করে কক্সবাজার জেলায় সাড়া জাগিয়ে দেয়।পুরো দ্বীপ তথা কক্সবাজার জেলার প্রাথমিক শিক্ষা পরিবারে আলোড়ন সৃষ্টি হয়।

এই স্যারের কার্যক্রম যতই দেখি ততই মুগ্ধ হই। এই ধরনের শিক্ষক যেকোনো প্রতিষ্ঠান তথা এলাকারবাসীর জন্য সম্পদ। কুতুবদিয়া দ্বীপের ৫৯ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক ছাইফুল্লাহ স্যারের অবদান একবাক্যে স্বীকার করেন।প্রতিটি বিদ্যালয়ের প্রত্যেক জন শিক্ষক যদি ছাইফুল্লাহ স্যারের মতো চিন্তা করেন তাহলে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা একদিন জাতীয় মডেলে পরিণত হবে।

এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন বেশি দূরে নয়। তখন গ্রাম আর শহরের শিক্ষার মাঝে কোনো পার্থক্য থাকবে না। এই ধরনের শিক্ষক, আমাদের মাঝে হাজার হাজার বছর বেঁচে থাকুক এবং ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিক। স্যারের উত্তর উত্তর শুভ কামনা।


প্যাক্টিসিয়ান আইনজীবী ও উন্নয়ন কর্মী
রুম টু রিড বাংলাদেশ।