জে. জাহেদ, চট্টগ্রাম প্রতিনিধি:
বন্য হাতির আক্রমণে কেউ মরলে ৩ লাখ টাকা ও আহত হয়ে বেঁচে গেলে ১ লাখ এবং ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হলে ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন বন বিভাগ। চট্টগ্রাম বন সংরক্ষকের কার্যালয় আরও জানিয়েছেন, একইভাবে খেত, ঘরবাড়ি কিংবা অন্য সহায় সম্পদের ক্ষতিসাধন করলেও বন বিভাগ ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দেবেন। তবুও প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে উঠা করিডোর থেকে হাতি তাড়ানো সম্ভব নয় বলে জানান বন বিভাগ।
যদিও চট্টগ্রাম জেলার কর্ণফুলী ও আনোয়ারা উপজেলায় গত ১০ বছরে বন্যহাতির আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন ১১ জনেরও অধিক। হাতির আক্রমণে লোকালয়ে একের পর এক মানুষের প্রাণহানি হলেও অতীতে বন বিভাগ কার্যত কোন ব্যবস্থা নেয়নি।
চট্টগ্রাম বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, জঙ্গল ও পাহাড় কেটে সাবাড় করে ফেলায় বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। আবাসস্থল ও বিচরণক্ষেত্র হারিয়ে পাগলপ্রায় বন্য হাতি। ফলে, কিছুদিন পরপর চট্টগ্রামের আনোয়ারা-কর্ণফুলী উপজেলার লোকালয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে একাধিক বন্যহাতি। বন্য হাতির আক্রমণে আহত-নিহত ও বসতবাড়ি ভাঙচুর নিত্যদিনের ঘটনা।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠান, দোলতপুর, দক্ষিণ শাহমীরপুর এবং আনোয়ারার গুয়াপঞ্চক, বৈরাগ, মোহাম্মদপুর, ফকিরখিল, বটতলী, হাজিগাঁও, গুচ্ছগ্রামে বিগত বছরগুলোতে তিনশতাধিক পরিবারের বসতঘর ভাঙচুর ও হাতির পায়ে পৃষ্ট হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন।
এদের মধ্যে বড়উঠান খিলপাড়া গ্রামের জালাল আহমদ (৭২), ২০১২ সালে মরিয়ম আশ্রম এলাকায় জুয়েল দাশ, একই বছরের ১৩ জুলাই আনোয়ারা বৈরাগ ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর গ্রামের আবদুর রহমান (৭০), একই বছরের ২৬ জুন পুরাতন গুচ্ছগ্রামের মোমেনা খাতুন (৬৫), ১৪ জুলাই বৈরাগ ইউনিয়নের মো. আকতার হোসেন চৌধুরী (৫০), ১৭ আগস্ট তৈলারদ্বীপ এলাকার মো. আবদুল মোতালেব বাবুল (৬৮) ও বরুমছড়া গ্রামের এক মহিলা হাতির আক্রমণে নিহত হন। সর্বশেষ কর্ণফুলীতে বন্য হাতির তাণ্ডবে গার্মেন্টস শ্রমিক মো. এনাম (২২) ও সজিব (২০) গুরুত্বর আহত হন।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে এ বছরের ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত মারা গেছে ৪৩ টি হাতি। যার মধ্যে ১৬টি চট্টগ্রামে এবং বাকিগুলো বান্দরবান ও কক্সবাজারে। এসব হাতির মধ্যে ১৯টি অসুস্থতাজনিত, পাঁচটি বার্ধক্যজনিত এবং এবং অন্যগুলোর মৃত্যু হয়েছে মানবসৃষ্ট কারণে।
এ ছাড়া পানিতে ডুবে কিংবা পাহাড় থেকে পড়েও বেশকিছু হাতি আহত হয়েছে। বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, গত তিন বছরে ৯টি হাতি মারা হয়েছে। যার মধ্যে চারটি চট্টগ্রামে একটি বান্দরবানের লামায়, বাকি চারটি হাতি হত্যা করা হয়েছে কক্সবাজারে।
আইইউসিএন জরিপ অনুযায়ী, ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বন্যহাতির সংখ্যা ছিল ২৬৮টি। এ ছাড়া ব্যক্তিমালিকানাধীন ৮২টি, চিড়িয়াখানায় তিনটি ও দেশের দুটি সাফারি পার্কে ১১টি হাতি রয়েছে। এর সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে কিছু হাতির প্রজনন হয়েছে বলে মনে করেন বন বিভাগের কর্মকর্তারা। এমন প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য উল্লেখ করে হাতির করিডোর রক্ষায় হাইকোর্টে রিটও হয়েছে।
বড়উঠান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ দিদারুল আলম বলেন, ‘সারাদিন পরিশ্রম করে রান্নাঘরে ভাত খেতে বসলেই গ্রামবাসীর হাকডাক আসে ‘হাতি আসতেছে। এই হাতির আক্রমণে একে একে নিহত হচ্ছে মানুষ। ঘরবাড়ি ভেঙে দিচ্ছে হাতি। আমি বন বিভাগকে বারবার বলেছি বড়উঠানের গ্রামবাসীকে হাতির আক্রমণ থেকে বাঁচাতে।’
কেইপিজেডের প্রশাসন ও মানবসম্পদ উন্নয়ন বিভাগের সহকারী ব্যবস্থাপক মঈনুল আহসান জানান, ‘বন্য হাতি প্রায় সময় গাছপালা উপড়ে ফেলছে, স্থাপনা ভাঙছে। এখানকার ২৩টি কারখানায় কাজ করেন আনোয়ারা-কর্ণফুলী ও আশপাশের এলাকার প্রায় ২২ হাজার শ্রমিক। সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার জন্য বের হতেই তাঁরা হাতি আতঙ্কে থাকেন।’
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মামুনুর রশীদ বলেন, ‘মানুষের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি যাতে না হয় সেজন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। এরপরও অনেকের ক্ষতিসাধন হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি নির্ধারিত ফরম পূরণ করে আবেদন করলে বনবিভাগ থেকে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হয়।’
চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘হাতির আক্রমণে কেউ মারা গেলে সরকার তিন লাখ টাকা করে দিচ্ছেন। আবার কেউ আহত হলে এক লাখ টাকা করে দেবেন। একইভাবে খেত-ফসল, ঘরবাড়ি কিংবা অন্যকিছু ক্ষয়ক্ষতি হলে দেওয়া হচ্ছে ক্ষতিপূরণ।’
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।