রশীদ আহমেদ চৌধুরী

আয়কর আইনজীবী।

সম্প্রতি সরকারদলীয় সাংসদ জনাব কবিরুল হক বলেছেন, “স্বীকার করতেই হবে যে দেশে দুর্নীতি প্রাতিস্ঠানিক রুপ পেয়েছে।” (প্রথম আলো- ২৬-৬-২০২৪)
মাননীয় সাংসদের এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে দুর্নীতির স্বরুপ উম্মোচনে নতুন কনসেপ্ট “প্রাতিস্ঠানিক দুর্নীতি ” সম্পর্কে ব্যাখ্যার নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। এতোদিন আমরা একক ব্যাক্তির দুর্নীতির ধারনা সম্পর্কে অবহিত ছিলাম। প্রাতিস্ঠানিক দুর্নীতির কনসেপ্ট সম্পর্কে আমাদের ধারনা ছিলো অস্পষ্ট,ধোঁয়াচ্ছন্ন। মিডিয়ায় কোন দুর্নীতির খবর বেরুলে তা কোন একক ব্যাক্তির অপরাধ কর্ম হিসেবে আন্দাজ করা হতো । একক ব্যাক্তির পক্ষে হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি একার পক্ষে করা অসম্ভব। সে ক্ষেত্রে কোন প্রতিস্ঠানে সর্বস্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীদের পারস্পরিক যোগসাজশে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এ সকল বড়ো দুর্নীতি গুলো সংঘটিত হয়ে থাকে। সিস্টেমের কারনে নির্দিস্ট কোন প্রতিস্ঠানে কোন সামস্টিক কাজ একক ব্যাক্তির মাধ্যমে পুরো প্রক্রিয়া সম্পাদন করা অসম্ভব।বিভিন্ন দপ্তরে একাধিক কর্মকর্তার যৌথ অনুমোদনের মাধ্যমে গোটা কাজটি সম্পাদিত হয়। এ কৌশলগত সীমাবদ্ধতার কারনে দুর্বৃত্তরা প্রতিস্ঠানে দুর্নীতির সিন্ডিকেট গড়ে তুলে। দুর্নীতিবাজদের এ “সিন্ডিকেট”, সেবা গ্রহিতা, ঘূষপ্রদানকারীকে, সম্পূর্ন কাজের অনুমোদন ওয়ানস্টপে যৌথ সহযোগিতায় পাইয়ে দিতে সাহায্য করে । সবাই এ কাজের সাথে পদ্ধতিগতভাবে সম্পৃক্ত হয়ে যায় বলে তাদের মধ্যে বুঝাপড়া বাড়ে,বন্ধুত্ব বাড়ে, শক্তি বাড়ে , অপকর্ম ফাঁসের ঝুঁকি কমে, ফাঁস হলে সতীর্থদের সাপোর্ট বাড়ে, সাহস বাড়ে, মিডিয়া ভীতি কমে, কন্ফিডেনস বাড়ে। অপকর্ম তখন স্বাভাবিক কর্মে রুপ নেয়।ভাগবাটোয়ারা কাজটি নির্বিঘ্ন , নিরাপদ ও নিশ্চিত হয়। প্রতিস্ঠানে নতুন নিয়োগ প্রাপ্তরা অর্থের বিনিময়ে কাজে ঢুকে, তাই সহজে তাদেরকে সিন্ডিকেটের সদস্য করা যায়। বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরৎ উঠানোর তাগিত তাকে যেকোন অপকর্মে নিয়োজিত হতে তাড়িত করে। শুরুতেই অধ:পতিত নৈতিকতা তাকে অপরাধী চক্রের সদস্য হতে প্রনোদনা যোগায়। এভাবে সকলের যোগসাজশে প্রতিস্ঠানিক দুর্নীতির যাত্রা শুরু হয় । প্রতিস্ঠানিক এ দুর্নীতিই হলো অন্ধকারের কালো বিড়াল। তার অস্তিত্ব আছে,কার্যকারিতা আছে, কিন্তু দৃশ্যমান নয়। আমরা সবাই কালো বিড়াল ধরতে হাতড়াই, কিন্তু ধরতে পারি না। ধরলেও সিস্টেমের কারনে ফসকে যায়। একক ব্যাক্তিক দুর্নীতির তুলনায় এই প্রতিস্ঠানিক দুর্নীতি অনেক শক্তিশালী ও বিধ্বংসী। এ ধরনের যোগসাজশী দুর্নীতি রাস্ট্রের সাংগঠনিক ও আদর্শিক কাঠামোকে ঘুনপোকার মত তলে তলে খেয়ে ফোকরা করে ফেলে।স্বৈরাচারী রাস্ট্র ব্যবস্থায় যোগসাজশী দুর্নীতি সিন্ডিকেট থেকে মাফিয়া স্তরে উন্নিত হয়। এ ব্যবস্থায় মন্ত্রী, আমলা, ব্যবসায়ী ও জনপ্রতিনিধি একাকার হয়ে যায় । গণতান্ত্রিক রাস্ট্র ব্যবস্থায় এ সুযোগ সীমিত। মাফিয়া হলো বড় কালো বিড়াল। এ ক্ষেত্রে রাস্ট্রে কোন ফরমাল সিস্টেম কাজ করে না।ধীরে ধীরে রাস্ট্রর বিভিন্ন বিভাগ তার কার্যকারিতা হারায়। স্বাভাবিক পন্থায় জনগন রাস্ট্রীয় সেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়। অস্বাভাবিক ঘুষের মাধ্যমে সেবা প্রাপ্তির বিষয়টি তখন স্বাভাবিকতায় রুপ নেয়। অঘোষিত ফরমান হয়ে যায়। এক্ষেত্রে প্রতিস্ঠানিক দুর্নীতিকে, ব্যাক্তি দুর্নীতি হিসাবে চিন্হিত করে তার বিচার তদন্ত করা হলে সেক্ষেত্রে দুর্নীতি নির্মুল না হয়ে বরং তা ঢালপালা গজিয়ে মহিরুহ হিসেবে বিস্তৃত হয়। দুদকের তদন্ত মতে, আর্থিক খাত, ভুমি, শিক্ষাসহ রাস্ট্রের অন্যান্য খাতের হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি গুলো প্রতিস্ঠানিক দুর্নীতি, ব্যাক্তি খাতের নয়। বড় সাইজের প্রতিস্ঠানিক দুর্নীতি যে গুলি সামপ্রতিক সময়ে আলোচিত সমালোচিত সে গুলি পর্যালোচনা করলে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে। সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজির আহমেদের বিরুদ্ধে আনিত বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত চলমান।এ অপকর্মের জন্য সিনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে তার মূল দায় থাকলেও দুর্নীতি গুলো করতে গিয়ে তিনি আরো যাদের সহযোগিতা পেয়েছেন এবং বিনিময়ে তাদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধে দিয়েছেন অভিযোগে তাদের নাম তেমন আসছে না। এক্ষেত্রে সিন্ডিকেট পর্দার আডালে থেকে যাচ্ছে। বিচারে বেনজিরের শাস্তি হলেও সিস্টেম ভাংগবেনা। সিন্ডিকেট বহাল তবিয়তে থাকবে। বিভাগের দুর্নীতি বন্ধ হবে না। কালো বিড়াল হয়ে অন্ধকার ঘরে ঘাপটি মেরে বসে থাকবে। একইভাবে ছাগল কান্ডে সমালোচিত রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য মতিউরের দুর্নীতির তদন্ত শুরু হলেও যাদের সহযোগিতা ও পৃস্ঠপোষকতা নিয়ে তিনি দিনের পর দিন এ দুর্নীতি করেছেন তাদের যোগসাজশি কর্ম কান্ড নেপথ্যে রয়ে গেছে। ব্যাক্তি মতিউরের বিচার শাস্তি হলেও দুর্নীতি থামবে না। কারন যে সিস্টেমে অপকর্ম সংঘটিত হয়েছে সে সিস্টেম অক্ষুণ্ণ রয়ে যাচ্ছে । যেমন ওয়াসার পানির বিল দুর্নীতিতে বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীদের পারস্পরিক যোগসাজশ রয়েছে। একক ব্যাক্তির পক্ষে পুরোপ্রক্রিয়ার সব কার্য সম্পাদন করা সম্ভব নয়। এ দুর্নীতির মধ্যে রয়েছে বাণিজ্যিক ভবনকে আবাসিক ভবন হিসেবে দেখানো,ভবন নির্মানের সময় পানির বিল না করা,মিটার খুলে রেখে বিল কমিয়ে দেয়া,গভির নলকুপের সংখ্যা গোপন করা ইত্যাদি ইত্যাদি। ওয়াসার মিটার রিডারদের একার পক্ষে দুর্নীতির এ গোটা প্রক্রিয়া সম্পাদন করা অসম্ভব। এ জন্য ভবনমালিক,মিটার রিডার, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা, সিনিয়র কর্মকর্তা সকলের যৌথ যোগসাজশে গোটা প্রক্রিয়াটি সম্পাদিত হয়। ( মিটার রিডারদের হাতে বিলের চোরাচাবি, সমকাল- ১৯-৩-২০২৪) এ ক্ষেত্রে আমার একটি দু:খজনক অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই, মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ীতে আমার অল্প জমি, ১২০০ মেঘাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প অধিগ্রহণ করেছিলো। ভূয়া মালিকানা দেখিয়ে ক্ষতিপূরণের টাকা আত্মসাতের জন্য এখানে একটি বড়ো ধরণের দুর্নীতি হয়। এ বিষয়ে দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনে ২৩ উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাসহ(ডিসি, এডিসি ) মোট ৪৪ জন সরকারি কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতার প্রমান পাওয়াতে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়। ওই দুর্নীতির সহযোগী হিসেবে আরো ৭ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, ৫ সাংবাদিক, ৮ আইনজীবী, ২ জন পদস্থ ব্যাংকারের সংশ্লিষ্টতার প্রমান মেলে। ( ভুমি অধিগ্রহণের দুর্নীতির তদন্তে নেমে বিপদে তিনি, প্রথমআলো – ১৮-২-২০২২) বাংলাদেশ রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার পশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে পিএসসির ২ জন উপপরিচালক, ১ জন সহকারী পরিচালক সহ মোট ১৭ জনকে আটক করে সিআইডি। ( প্রশ্নপত্র ফাঁস : পিএসসির ২ জন উপপরিচালক সহ আরো ১৭জন গ্রেপ্তার,প্রথম আলো : ৮-৭-২০২৪) ব্যাংক থেকে ঋণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুন্ঠনের দুর্নীতির ঘটনা কোন একক ব্যাক্তির একার অপকর্মের ফসল নয়। এ প্রক্রিযার সাথে ব্যাংকের সর্বস্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীদের যোগসাজশ জড়িত থাকে। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদস্থ কর্মকর্তা পর্যন্ত এ চক্রে জড়িত থাকার প্রমান মেলে। পিকে হাওলাদার দেশের ৪ ব্যাংক থেকে ৩.৫ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের সাথে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে পলাতক রয়েছে।একা পিকের পক্ষে এতো বড়ো আর্থিক দুর্নীতি করা অসম্ভব ছিলো।এ অপরাধী কাজের সাথে ওই সকল ব্যাংকের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা যেমন যুক্ত ছিল তেমনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর, মহাব্যবস্থাপক,নির্বাহী পরিচালক ও জড়িত থাকার প্রমান মেলেছে।( পিকে হালদারের অর্থ আত্মসাৎ : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরো কর্মকর্তাদের নাম বলেছেন শাহ আলম ও সুর চৌধুরী, প্রথমআলো : ২৯-৩-২০২২) সড়ক মহাসড়কে পুলিশের চাদাঁবাজির অভিযোগ প্রায় সময় আলোচিত। একজন পুলিশ একার পক্ষে হয় এ ধরনের চাঁদা বাজি অসম্ভব। মহা সড়কের অনেক জাগায় টোকেন দিয়ে , কার্ড দিয়ে মেবাইল ব্যাংকিংমাধ্যমে মাসিক ভিত্তিতে ট্রাক প্রতি চাদাঁ আদায় করা হয। মহা সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে ট্রাক থামানো হলে কার্ড দেখালে ট্রাক ছেড়ে দেয়া হয়। ( পণ্যবাহি ট্রাকে চাদাঁবাজি, সমকাল: ১৬-২-২০২৪) এখানে একটি সুসংঘটিত সিস্টেম সুশৃঙ্খলভাবে কার্যকর আছে।একই ভাবে রাজনৈতিক নেতা, প্রকৌশলী ও ঠিকাদার যোগসাজসে গঠিত সিন্ডিকেট সড়ক ও জনপদ বিভাগের প্রকল্পের কাজের ঠিকাদারী তাদের আপনজনকে পাইয়ে দিতে সহযেগিতা করে। ( সড়কের অধিকাংশ কাজ পায় প্রভাবশালিদের ঘনিস্ঠ ঠিকাদার, প্রথমআলো : ১৪-১০-২০২৩)এ ধরনের প্রাতিস্ঠানিক দুর্নীতির হাজারো নজির আছে। বাংলাদেশ রাস্ট্রের এমন কোন বিভাগ নেই যেখানে প্রতিস্টানিক দুর্নীত নেই। উল্লেখিত প্রতিস্ঠানিক দুর্নীতির উদারণ থেকে আমরা বুঝতে পারি এসব অপকর্মে প্রথমে একজন ব্যাক্তিকে দায়ী করে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে একা তাকেই অভিযুক্ত করা হয। শুধু একক ব্যাক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত করে শাস্তির বিধান করা হলে প্রতিস্ঠানিক দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব নয়। এ সিন্ডিকেটে যারা জড়িত তাদের সকলকে আইনের আওতায় এনে নজির সৃস্টিকারী শাস্তিবিধান করা হলে দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব। দুর্নীতির সূতিকাগার সিন্ডিকেট ও মাফিয়া চক্রকে সমুলে উৎপাটনের জন্য রাস্ট্রকে কঠোর ভুমিকায় অবতীর্ণ হবার কোন বিকল্প নেই। রাস্ট্র এ রকম কঠোরতার নীতি অবলম্বন করতে পারলে তখন দেশে ঋণখেলাপী,অর্থ পাচার, শেয়ার কেলেংকারী, কালোবাজারি, আন্ডার ইনভয়েসিং,ওভারইনভয়েসিংসহ বিভিন্ন বিভাগের দুর্নীতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাবে।দেশে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা আসবে, দেশ হয়ে যাবে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। যে দেশের স্বপ্ন দেখেছিল ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের শহীদরা।