সিবিএন ডেস্ক:
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। গতকাল সোমবার (৫ আগস্ট) রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে তিনি ভারতে চলে যান। কী কারণে শেখ হাসিনাকে দেশত্যাগ করতে হলো এবং এতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কতটা ঝুঁকিতে পড়লেন, ডয়েচে ভেলের সাংবাদিক আরাফাতুল ইসলামকে এক সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে জানিয়েছেন সজীব ওয়াজেদ জয়।
শেখ হাসিনাকে দেশত্যাগ করতেই হলো কেন? এমন প্রশ্নে জয় বলেন, ‘এখন যে সংঘাত চলছে, আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, তখন তা শুরু হয়ে গিয়েছিল। বলা হচ্ছিল তারা গণভবনে হামলা করবে। উনি দেশ ছাড়তে চাননি। পরিবার থেকে বলা হয়, এরা শুধু প্রটেস্টার না, এরা তোমাকে হত্যা করবে, তোমার দেশ ছেড়ে যেতেই হবে।’
আরাফাতুল ইসলাম বলেন, এতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কি ঝুঁকিতে পড়ে যাননি? বিশেষ করে আমরা দেখতে পাচ্ছি বিভিন্ন স্থানে হামলা হচ্ছে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
জবাবে সজীব ওয়াজেদ বলেন, ‘হ্যাঁ, সেটা স্বাভাবিক। তাদের ওপর হামলা শুরু করে দিয়েছিল তার আগে থেকেই। সরকার পতনের আগে থেকেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর বিভিন্ন জায়গায় ঢাকা ও ঢাকার বাইরে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়, হত্যা করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘এখানে যদি শুধু সরকার ও আওয়ামী লীগের দোষ দেওয়া হয়, সেটা ঠিক না। এখন তো আওয়ামী লীগ নেই, আওয়ামী লীগ সরকার নেই। কিন্তু নির্যাতন তো চলছেই। আমাদের সব মন্ত্রীর বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু মিউজিয়াম পর্যন্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেখানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও আমার পুরো পরিবারকে হত্যা হরা হয়।’
‘আমাদের কয়েকজন এমপি মারা গেছেন। কয়েকজন নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। সংঘর্ষ যেহেতু অনেক আগে থেকে শুরু হয়ে গেছে, তাই আওয়ামী লীগ তো এর জন্য দায়ী নয়।’
আওয়ামী জ্যেষ্ঠ নেতারা বলছেন যে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের বিষয়ে তারা জানতেন না, পত্রপত্রিকায় এই খবর আসছে এখন, এ বিষয়টি কি সত্য?
জয় বলেন, ‘এটা আসলে সিদ্ধান্ত হয়েছিল এক দিন আগে। আমরা কয়েকজন জানতাম যে তিনি ঘোষণা দেবেন তিনি পদত্যাগ করছেন। এবং সংবিধান অনুযায়ী একটা ট্রানজিশন অব পাওয়ার হয়, এটাই ছিল উনার প্ল্যান। কিন্তু যখন তারা গণভবনের দিকে মার্চ করা শুরু করলো, তখন আমরা বললাম যে তোমার আর সময় নেই, তোমাকে এখনই বেরিয়ে যেতে হবে।’
এক দিন আগে যেহেতু সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন ঘোষণা না দেওয়ার কারণ কী ছিল? জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা পরের দিন ঘোষণা দেওয়ার কথা ছিল। সংবিধান অনুযায়ী ট্রানজিশন অব পাওয়ার। হুট করে তো বলা যায় না।’
আপনার রাজনীতিতে আসার সম্ভাবনা আছে কি? হেসে দিয়ে সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, ‘বর্তমানে নেই। আমাদের সঙ্গে তিনবার ক্যু করা হয়েছে। তিনবারই সব হারিয়ে বিদেশে থাকতে হলো। আমি আর আমার মা বাদে আমরা বিদেশে অনেক বছর ধরেই আছি। আমরা এখানে সেটেল্ড। আমাদের এখানের জীবনে কোনও অসুবিধা নেই। আমরা এখানে থাকতে অভ্যস্ত।’
‘গত ১৫ বছরে দেশের জন্য এত করেছি। আপনারা জানেন যে আমি ডিজিটাল বাংলাদেশ বানিয়েছি। এটা আমার স্বপ্ন ছিল। আমি সরকার থেকে কোনও বেতন নিইনি। বিনা মূল্যে এ কাজটি আমি করেছি। আমি প্রচুর পরিশ্রম করেছি বাংলাদেশকে ডিজিটাইজ করতে, গ্রামবাংলা পর্যন্ত ডিজিটাল বেনিফিট পৌঁছানোর জন্য। এই যে উন্নয়ন আমরা করেছি, তারপরও যদি বাংলাদেশের মানুষ আমার পরিবারের সাথে এ রকম করে, তাহলে আমাদের আর কিছু বলার আর করার নেই।’
কিন্তু আপনি বা আপনার পরিবারের সদস্যরা যেমন শেখ রেহানা ও তার দুই সন্তানের কেউ কি রাজনীতিতে আসতে পারেন? মানে এই সময়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কে থাকবেন?
শেখ রেহানা ও তার দুই সন্তানের আসার সম্ভাবনা নেই জানিয়ে জয় বলেন, ‘এখন এটা আর আমাদের দায়িত্ব নয়। এখন তো মনে হয় তারা আওয়ামী লীগকে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা করছে এবং যদি নির্বাচন হয়ও, তারা আওয়ামী লীগকে নির্বাচন করতে দেবে কি না, আওয়ামী লীগকে ঠিকমতো মাঠে নামতে দেবে কি না, এটা কিছুই জানা যাচ্ছে না। তাদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে। তাদের জান বাঁচানো হচ্ছে আমার প্রথম দায়িত্ব।’ সে ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করছেন বলেও জানান তিনি।
তবে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ মরে যায়নি। আওয়ামী লীগ হচ্ছে বাংলা দেশের সবচেয়ে পুরনো দল। সবাই মনে করে আওয়ামী লীগের পপুলারিটি নাই। দেশে ১৭ কোটি মানুষ। এখনও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ ভোটে জিতে আসবে। আওয়ামী লীগের যারা সমর্থক, তারা কিন্তু দেশেই আছেন।’
শেখ হাসিনা এখন কোথায় আছেন কেমন আছেন?
সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, ‘তিনি ভালো আছেন। তিনি এখন দিল্লিতে আছেন। আমার বোন উনার কাছে আছেন। তবে উনার মন খারাপ। তিনি দুঃখিত যে দেশের জন্য উনার বাবা জান দিয়েছেন। উনার পুরো পরিবার প্রাণ হারিয়েছেন। যে দেশের জন্য তিনি জেল খেটেছেন, এত পরিশ্রম করেছেন, এত উন্নয়ন করেছেন, সেই দেশের মানুষ তাকে এভাবে অপমান করে বের করে দেবে, তার ওপর আক্রমণ করতে যাবে, এটা আমরা কেউ কল্পনা করতে পারিনি।’
‘তারা বলছে এটা গণআন্দোলন। কিন্তু মানুষ হত্যা করা, পুলিশের ওপর হামলা করা, প্রধানমন্ত্রীর ওপর হামলা করা, জ্বালাও-পোড়াও করা, এটা তো মব, সন্ত্রাস, জঙ্গি,’ বলেন তিনি।
তিনি (শেখ হাসিনা) ভারত থেকে কোথায় যেতে চাচ্ছেন। নানা রকম খবর পাওয়া যাচ্ছে। প্রশ্নের উত্তরে জয় বলেন, ‘এ রকম কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।’
শোনা গেছে তিনি (শেখ হাসিনা) যুক্তরাষ্ট্রে তার নাতি-নাতনির সঙ্গে সময় কাটাতে চান। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে তার ভিসা বাতিল হয়েছে, এটা কি সত্যি? জয় বলেন, ‘এটা সত্যি নয়। এ রকম কোনও কথা হয়নি। এটা গুজব।’
আপনার কি আপনার মায়ের সাথে দেখা করার বা ভারতে আসার সম্ভাবনা রয়েছে? উত্তরে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ যাবো। তবে কখন যাবো, সেটা এখনও ঠিক হয়নি।’
আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠন করতে আপনার পরিবারের ভূমিকা নেওয়া উচিত নয় কি? উত্তরে তিনি বলেন, ‘উচিতের বিষয় না। বিষয়টা হলো আমাদের টিকে থাকতে বা নির্বাচন করতে দেবে, প্রশ্নটা হলো সেখানে। নির্বাচন যদি না করতে দেয়, তাহলে তো সেখানে থেকে লাভ নেই। শুধু মানুষ মারা যাবে।’
আপনার কেন মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে নির্বাচন করতে দেবে না? সজীব ওয়াজেদ বলেন, ‘দেখেন, ইতোমধ্যে যে আলোচনা চলছে সবকিছুর, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলেন, এখানে কিন্তু আওয়ামী লীগের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করছে না, কথা বলছে না।’
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হচ্ছেন অধ্যাপক ড. ইউনূস। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী? এ নিয়ে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কোনও মতামত নেই। আমাদের সুশীল সমাজ অনেক দিন ধরে চাচ্ছিলেন তিনি দেশ চালানোর একটা সুযোগ পাক। তিনি এখন সেই সুযোগ পাচ্ছেন। তবে কীভাবে চালান, আমি দেখতে চাই। একটা দেশ চালানো অত সহজ ব্যাপার না।
আরাফাতুল ইসলাম প্রশ্ন করেন, অনেকে বলে থাকেন, বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নতি হলেও দুর্নীতি ও অপরিণামদর্শী উদ্যোগের কারণে দেশের অর্থনীতি আজ ধ্বংসের কোঠায়। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
জয় বলেন, ‘গতকাল পর্যন্ত তো অর্থনীতি ভালোই ছিল। আমি জানি দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ে। এটা সারা বিশ্বে বেড়েছে গত এক-দুই বছরে। তার আগে আমাদের মানুষের মাথাপিছু আয় তিন গুণ বেড়েছে। ভারত থেকে বেশি হয়ে গেছে। তাহলে যদি বলা হয় খারাপ হয়ে গেছে? এখন কী হবে আমি জানি না। তবে শেখ হাসিনার পদত্যাগ পর্যন্ত অর্থনীতি ভালোই ছিল। গত দুই-তিন বছরে চাপ পড়েছিল। তবে এটা আমাদের দোষে না। এটা দুর্নীতির জন্য নয়, এটা সারা বিশ্বে বেড়েছে।’
‘আমাদের সরকারের আমলে যারা দুর্নীতি করেছে তাদের ধরা হয়েছে। এর আগে তো কেউ সেটা করতে পারেনি।’
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।