জালাল আহমদ,ঢাকা :

বিএনপিতে সংস্কারপন্থীদের ক্রমাগত পদোন্নতিতে দলের দুর্দিনে মাঠে থাকা ত্যাগী নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন।সম্প্রতি জহির উদ্দিন স্বপন, মেজর হাফিজ এবং নুরুল ইসলাম মনি’র পদোন্নতির পর নেতাকর্মীরা মুখ খুলতে শুরু করেছেন।

গত ১৬ আগস্ট সংস্কারপন্থী বিএনপি নেতা মেজর(অব:) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ কে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য, ২০ আগস্ট নুরুল ইসলাম মনি কে ভাইস চেয়ারম্যান এবং কয়েক মাস আগে জহির উদ্দিন স্বপনকে চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা করা হয়েছে। এতে দলের মাঠ পর্যায়ের ত্যাগী নেতাকর্মীরা এ প্রতিবেদকের কাছে তাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।

যারা সংস্কারপন্থী বিএনপি :

সেনা-সমর্থিত সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ সালের ২৬ জুন বিএনপিতে ১৫ দফা সংস্কার প্রস্তাব আনেন দলটির তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া। ওই সময় দলের একটি অংশ তাকে সমর্থন দেন। ওই সময় মান্নান ভূঁইয়া ও তার অনুসারীরা ‘সংস্কারপন্থী’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

মূলত সংস্কারের নামে বেগম খালেদা জিয়াকে বিএনপির রাজনীতি থেকে ‘মাইনাস’ করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন তারা।

এই সংস্কার প্রস্তাব আনার দায়ে ওই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর বেগম খালেদা জিয়া আটকের পূর্বে দল থেকে মান্নান ভূঁইয়াকে বহিষ্কার করলে সংস্কারপন্থীরা তার নেতৃত্বে তৎপরতা চালাতে থাকেন। কার্যত তখন থেকেই বিএনপিতে ‘সংস্কারপন্থী’ ও ‘মূলধারা’—এই দুটি পক্ষ তৈরি হয়।দুই পক্ষের মধ্যে বিভিন্ন সময় সংঘাত-সংঘর্ষ হয়।

খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন মহাসচিব হওয়ার পর বিভেদ আরও বাড়ে। ওই বছরের ১ নভেম্বর তৎকালীন নির্বাচন কমিশনের সাথে সংলাপ কে কেন্দ্র করে বিএনপিকে বিরক্ত করা পায়তারা করে সরকার। সংস্কারপন্থীরা সেই ২৭ অক্টোবর দিবাগত রাতে সাইফুর রহমানের বাসায় মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে একটি সভা আহ্বান করে। সেই সভায় যোগদানের জন্য বিএনপি’র তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেন কে একটু গোয়েন্দা সংস্থা ‘চাপ’ প্রয়োগ করে। খন্দকার দেলোয়ার কৌশলে সেই ‘চাপ’ মোকাবেলা করলেও সাইফুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং মেজর হাফিজ কে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব করে ‘আলাদা বিএনপি’ গঠন করা হয় মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে। মানুষের কাছে মান্নান ভূঁইয়ার বিএনপি ‘সরকারপন্থী বিএনপি/ সংস্কারপন্থী’ বিএনপি নামে পরিচিত ছিল।

নির্বাচন কমিশনের সংলাপের চিঠি কে কেন্দ্র করে আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল তাদের এই গ্রুপিং। ২০০৮ সালের এপ্রিল মাসের শুরুতেই ‘রাজনৈতিক’ বিষয়ে রায় দেওয়ার ‘এখতিয়ার’নেই জানিয়ে রিটটি খারিজ করে দিয়েছিল উচ্চ আদালত।

দুই পক্ষের মধ্যে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের জন্য নির্বাচন কমিশন অফিসে বৈঠক করেও কাজ হয়নি।

২০০৮ সালের এপ্রিল মাসের শেষে তৎকালীন নির্বাচন কমিশন মেজর হাফিজের নেতৃত্বাধীন বিএনপির সাথে সংলাপ পর্যন্ত করেছিল। মে মাসে সাইফুর রহমান বিদেশ যাওয়ার পূর্বে সংস্কারপন্থী বিএনপি ‘কোমর’ ভেঙ্গে দেন। এরপরে ধীরে ধীরে ‘সংস্কারপন্থী বিএনপি’ দুর্বল হতে থাকে। ২০০৮ সালের ১১ ই সেপ্টেম্বর বেগম খালেদা জিয়া মুক্তি পাওয়ার পর সংস্কারপন্থী বিএনপি আস্তে আস্তে মূলধারার বিএনপির সাথে মিশে যায়।

যেসব আসনে সংস্কারপন্থী বিএনপির বিপরীতে মূলধারার বিএনপি’র শক্তিশালী প্রার্থী ছিল না, সেসব আসনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংস্কারপন্থীরা মনোনয়নও পান।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাইফুর রহমান দুটি আসনে মনোনয়ন পান। মেজর হাফিজ, সাদেক হোসেন খোকা, মাসুদ অরুণ সহ কয়েকজন নেতা মনোনয়ন পান।

যেসব সংস্কারপন্থী বিএনপি নেতা মনোনয়ন পাননি, তারা মান্নান ভূইয়ার নেতৃত্বে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। ফরিদপুর সদর আসনে চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, নরসিংদীর শিবপুরে আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া,কক্সবাজার সদরে ইঞ্জিনিয়ার শহীদুজ্জামান স্বতন্ত্র প্রার্থী হন।

২০১০ সালের জুলাই মাসে মান্নান ভূঁইয়ার মৃত্যুর পর সংস্কারপন্থীরা কার্যত নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েন।২০১৪ সালে সংস্কারপন্থীদের মধ্যে ১৮ জন নেতা বিএনপির কাছে লিখিতভাবে অঙ্গীকার করেন, তারা খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির সঙ্গেই থাকতে চান। ওই বছরের ৫ জানুয়ারির আগে সাদেক হোসেন খোকার বাসায় অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে তারা ওই অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করেন। যা পরবর্তী সময়ে দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার কাছে দেওয়া হয়। সংস্কারপন্থী ওই নেতাদের পরবর্তী সময়ে অনুষ্ঠিত উপজেলা ও পৌরসভা নির্বাচনে স্ব-স্ব এলাকায় গিয়ে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার নির্দেশ দেন খালেদা জিয়া। অনেক পৌরসভায় প্রার্থী মনোনয়নের ব্যাপারে সংস্কারপন্থীদের পরামর্শও নেওয়া হয়।

সর্বশেষ ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলের পর ওই বছরের ৩ আগস্ট ঘোষিত কমিটিতে নাম না থাকায় সংস্কারপন্থীরা হতাশ হয়ে পড়েন।

এরপর, ২০১৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া সংস্কারপন্থী বিএনপির সাবেক তথ্য-গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক সাংসদ জহির উদ্দিন স্বপন ও সাবেক সংসদ সদস্য সর্দার সাখাওয়াত হোসেন বকুলকে ডেকে দলে সক্রিয় হতে বলেন। এরপর ২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর মির্জা ফখরুলের হাত ধরে দলে ফেরেন ১০ সংস্কারপন্থী নেতা। তারা হলেন—সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী নওগাঁর আলমগীর কবীর, সাবেক হুইপ আবু ইউসুফ মো. খলিলুর রহমান, সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ (জিএম সিরাজ), ডা. জিয়াউল হক মোল্লা, সুনামগঞ্জের নজির হোসেন, আতাউর রহমান আঙুর, আবু হেনা, শহীদুল আলম তালুকদার ও ইসরাত সুলতানা ইলেন ভুট্টো। এর মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয় আলমগীর কবির (নওগাঁ-৬), খলিলুর রহমান (জয়পুরহাট-২), আবু হেনা (রাজশাহী-৪), গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ (বগুড়া-৫), সর্দার সাখাওয়াত হোসেন বকুল (নরসিংদী-৪), নজির হোসেন (সুনামগঞ্জ-১), জহির উদ্দিন স্বপন (বরিশাল-১)। তারা কেউই নির্বাচনে জয়লাভ করেনি। তবে পরবর্তী সময় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শপথ না নেওয়া শূন্য ঘোষিত (বগুড়া-৬) আসনে উপ-নির্বাচনে অংশ নিয়ে জিএম সিরাজ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

বিএনপির যেসব সংস্কারবাদী নেতা দলে ফিরে এসেও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন, তাদের ‘সংস্কার’ না করে পদোন্নতি দেওয়ার কারণে ক্ষুব্দ হয়েছেন দলটির কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল নেতারা।

তাদের অভিযোগ, সংস্কারপন্থীরা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পেলেও অধিকাংশ নেতাই নিজ-নিজ নির্বাচনি এলাকায় যান না। দলের কোনও কর্মসূচিতেও তাদের পাওয়া যায় না। এমনকি এসব নেতার নির্বাচনী প্রচারণার সময় যেসব নেতাকর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদেরও কোনও সহযোগিতা করেন না সংস্থারপন্থীরা।

গত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আন্দোলন -সংগ্রামে তাদের কোনো ভূমিকা ছিল না। কেউ তৃণমূল বিএনপি, কেউ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন(বি এন এম) গঠন করে সরকারকে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে সহায়তা করেছেন।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে মামলা -হামলার শিকার হয়ে কারাভোগ করায়

জহির উদ্দিন স্বপনকে বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা করা হয় কয়েক মাস পূর্বে।তখন কেউ প্রতিবাদ করেন নি।

বিএনপির নেতাকর্মীদের সূত্রে জানা যায়, বৃহত্তর চট্টগ্রাম এবং নোয়াখালীতে সংস্কারপন্থী বিএনপির নেতা কম ছিল।সবচেয়ে বেশি সংস্কারপন্থী নেতা ছিল বৃহত্তর বরিশালে।

এ বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর যেসব সংস্কারপন্থী নেতারা পদোন্নতি পাচ্ছেন ,তাদের অধিকাংশই বরিশালের।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ১৬ আগস্ট বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর অবসরপ্রাপ্ত হাফিজ উদ্দিন আহমদকে স্থায়ী কমিটির সদস্য করা হয়। গত ২০ আগস্ট বরগুনার সাবেক সংসদ সদস্য বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম মনি, যিনি সংস্কারপন্থী বিএনপি নেতা হওয়ার কারণে ২০০৮ এবং ২০১৮ সালে মনোনয়ন বঞ্চিত হন, তাকে ভাইস চেয়ারম্যান পদে পদোন্নতি দেওয়ার পর ওই এলাকার বিএনপি’র মূলধারার নেতাকর্মীরা মুখ করলে শুরু করেন।

২০০৮ সাল থেকে বরগুনা ২ আসনের বিএনপি নেতাকর্মীদের সাংগঠনিক অবিভাবক ছিলেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন।২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর মাহবুব হোসেন মারা যাওয়ার পর বরগুনা জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট সগীর হোসেন লিওন এই এলাকায় বিএনপির হাল ধরেন।সাবেক ছাত্রনেতা হিসেবে নেতাকর্মীদের মামলা- মোকদ্দমায় সহযোগিতা করেছেন।কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রথম আইনজীবী ছিলেন।

নুরুল ইসলাম মনি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মনোনীত হওয়ার পর এডভোকেট সগীর হোসেন লিওনের পোস্টার,ব্যানার এবং ছবি ভাঙচুর করা হয়।

স্থানীয় বিএনপি ও যুবদলের একাধিক নেতা অভিযোগ করে বলেন, গত ২৪ আগস্ট বরগুনা জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এবং সাবেক সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম মনি বর্তমানে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান পদে মনোনীত হওয়ায় স্থানীয় নেতাকর্মীরা তার ঢাকার বাসভবনে দেখা করতে যান ।এসময় তাদের সাথে ঢাকার যুবলীগের এক নেতাকে দেখা যায়। যার নাম মাসুম বিশ্বাস বলে জানা যায়।মাসুম বিশ্বাস ঢাকার এবং তার আপন ছোট ভাই ইমরান বিশ্বাস বিবিচিনি ইউনিয়নের যুবলীগের নেতা ।

বেতাগীর তৃণমূলের কয়েকজন নেতা অভিযোগ করে বলেন,বিভিন্ন জায়গায় বিএনপির কিছু নেতা আওয়ামী লীগের লোকজনকে দলে ভেড়ানোর চেষ্টা এবং তাদের দিয়ে দলের ত্যাগী, পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের দূরে সরানোর পায়তারা করছে।

পুরো বরিশাল জুড়ে সংস্কারপন্থী বিএনপির দাপটে কোণঠাসা মূলধারার বিএনপির নেতাকর্মীরা।

মূলধারার নেতাকর্মীরা জানান, “দলের সংকটকালে যারা মাঠে ছিলেন , তাদের বঞ্চিত করে অর্থের বিনিময়ে সংস্কারপন্থীদের দলে পদোন্নতি দিলে দলের ভেতরে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে। এতে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মনোবল ভেঙে পড়তে পারে।”

‘আওয়ামী লীগ’ এ সংস্কারপন্থী নেতারা তাদের দলে কোন পদোন্নতি পাননি। কিন্তু বিএনপিতে সংস্কারপন্থীদের পদোন্নতির ফলে ভবিষ্যতের দলের দুর্দিনে দলকে কঠিন ‘মাশুল’ দিতে হতে পারে বলে নীতি নির্ধারকদেরকে সতর্ক করেছেন মাঠ পর্যায়ের নেতা কর্মীরা।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম মনি কে বার বার কল দিলেও তিনি সাড়া দেন নি।

বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব:) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ এর কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোন উত্তর না দিয়ে তাকে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য করার জন্য দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কে ধন্যবাদ জানান।

বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্যের কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে তারা কোন উত্তর দেননি।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ জানান,“এটি দলের নীতি নির্ধারকদের বিষয়। এই বিষয়ে আমার কোন মন্তব্য নেই।”