সিবিএন ডেস্ক ;

“জাজিরাতুল আরব যখন আইয়ামে জাহেলিয়াত বা পাপাচারের অন্ধকারে ডুবে ছিল,আরবের সর্বত্র দেখা দিয়েছিল অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা। তখন মানুষ হানাহানি ও কাটাকাটি সহ নানান অপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। এমনকি মূর্তিপূজা করত। এই অন্ধকার যুগ থেকে মানবকুলের মুক্তিসহ তাদের আলোর পথ দেখাতে তখন মহান আল্লাহু রাব্বুল আলামিন ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নূরে খোদা, আমাদের মহানবী ও রাসুল হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা:) সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে আলোকবর্তিকা হিসেবে বিশ্বজগতের জন্য রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছিলেন।

গত ১৩ ই সেপ্টেম্বর শুক্রবার জুম্মার নামাজের পূর্বের বয়ানে ব্রিটেনের ওয়েলসের রাজধানী কার্ডিফ শহরের শাহজালাল মসজিদের ইমাম ও খতিব মাওলানা কাজি ফয়জুর রহমান ও রিভারসাইড জালালিয়া মসজিদের ইমাম ও খতিব মাওলানা আব্দুল মোক্তাদির সহ বিভিন্ন মসজিদের ইমামগণ পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা:) এর তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা করা সহ এই দিনটি যথাযথ মর্যাদায় ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সাথে উদ্‌যাপন করার আহ্বান জানিয়েছেন।

“যিনি সমগ্র সৃষ্টিজগতের মধ্যে সর্বোত্তম সৃষ্টি, যিনি মহত্তম আদর্শের অধিকারী, যিনি সমগ্র মানবজাতির জন্য শ্রেষ্ঠতম পথিকৃৎ, যিনি স্রষ্টা ও পালনকর্তা মহান আল্লাহু রাব্বুল আলামিনের প্রিয়তম রাসুল, পিয়ারা হাবিব, বিশ্ব সভ্যতায় যাঁর অবদান সর্বাধিক, যিনি সমগ্র বিশ্বমানবের কল্যাণের জন্য প্রেরিত, যাঁর আগমনের অপেক্ষা করেছেন যুগ যুগ ধরে, লক্ষাধিক আম্বিয়ায়ে কিরামগণ। যিনি সাইয়িদুল মুরসালিন, খাতিমুন নাবিয়্যিন,যাঁর দিদার (সাক্ষাৎ) এর জন্য ব্যাকুল ছিলেন বিশ্ব কূল।

মহান আল্লাহু রাব্বুল আলামিনের অপার রহমতে আমাদের বিশ্বনবি প্রায় এক হাজার ৪০০ বছর আগে তথা ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার মক্কা নগরীর মরু প্রান্তরে বিশ্ব মুসলমানদের সবচেয়ে বড় পবিত্রস্থান মসজিদুল হারাম থেকে সামান্য দূরেই রাসুল (সা:) এর পিতা আবদুল্লাহর ঘরে সম্ভ্রান্ত কুরাইশ গোত্রে সুবহে সাদিকের সময় মা- আমেনার কোল আলোকিত করে শুভ আবির্ভাব তথা জন্মগ্রহণ করেছিলেন। “ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়…।’

৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়ালের একই দিনে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান, তাই এই দিনটিকে তথা মানব জাতির শিরোমণি মহানবী হজরত মুহম্মদ (সা:)এর জন্ম ও ওফাতের স্মৃতিময় ও পুণ্যময় দিন হিসেবে বিবেচনা করেন মুসলিম জাহান।

অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মতে, যেহেতু নবি করীম (সা:) ১২ রবিউল আউয়াল তারিখে জন্মগ্রহণ করেন, সেহেতু এই দিনটি ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যমণ্ডিত। বিশেষত দু’টি কারণে ১২ রবিউল আউয়াল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিন। প্রথমত, সব ইতিহাসবিদের ঐকমত্য বর্ণনা মতে, এই দিনেই মহানবী (সা:) পৃথিবীবাসীকে কাঁদিয়ে ওফাত লাভ করেন। দ্বিতীয়ত, প্রসিদ্ধ অভিমত অনুযায়ী, এই ১২ রবিউল আউয়াল তারিখেই মহানবী (সা:) জন্মগ্রহণ করেন। [সিরাতে ইবনে হিসাম (খ- ১) পৃষ্ঠা- ১৫৮]

মহানবী হজরত মুহম্মাদ (সা:) এর জন্মদিন হিসেবে তারিখ নিয়ে ভিন্নমত থাকলে ও সোমবার দিন সম্পর্কে কোনো মতভেদ নেই। কারণ, জীবন চরিতকাররা সবাই একমত যে রবিউল আউয়াল মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে সোমবার দিন নবি মুহম্মাদ (সা:)-এর জন্ম হয়েছিল। এই সোমবার ৮ অথবা ৯ কিংবা ১২ তারিখ এটুকুতেই হিসাবের পার্থক্য রয়েছে মাত্র। আমাদের উপমহাদেশে সুদীর্ঘকাল হতেই ১২ রবিউল আউয়াল মহানবী (সা:)-এর জন্মদিন হিসেবে পালন হয়ে আসছে। তবে ১২ রবিউল আউয়াল যে মহানবী (সা:)-এর ওফাত দিবস তাতে সব ঐতিহাসিকই ঐকমত্য পোষণ করেছেন। (সূত্র: ইসলামি বিশ্বকোষ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন)

“সত্যবাদিতা ও সততার প্রতীক, শান্তি প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত, করুণা, ক্ষমাশীলতা, বিনয়, দানশীলতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবের আগমনের ১২ রবিউল আউয়াল এর এই দিনটি ঈদে মিলাদুন্নবী (সা:) (আরবি: مَوْلِدُ النَبِيِّ মাওলিদু এন-নাবীয়ী, আরবি: مولد النبي মাওলিদ আন-নাবী, কখনো কখনো সহজভাবে বলা হয় مولد মাওলিদ, মেভলিদ, মেভলিট, মুলুদ আরো অসংখ্য উচ্চারণ; কখনো কখনো: ميلاد মিলাদ) হচ্ছে শেষ নবীর জন্মদিন হিসেবে মুসলমানদের মাঝে পালিত একটি উৎসব।

প্রতিটি ইদ আমাদের সবার জীবনে বয়ে আনে অনাবিল আনন্দ। আরবি শব্দ ‘ইদ’ এর আভিধানিক অর্থ খুশি হওয়া, ফিরে আসা, আনন্দ উদ্‌যাপন করা ইত্যাদি। আর ‘মিলাদ’ শব্দের অর্থ জন্মতারিখ, জন্মদিন, জন্মকাল ইত্যাদি। “সকল ঈদের ইদ, ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতে জগতের প্রতিটি মুমিন-মুসলমানের সমস্ত আবেগ-অনুরাগ প্রাণোত্সারিত ভালোবাসা আর উচ্ছ্বাসে একাকার হওয়া প্রাণ-মন-মনন আকুল করা দিন তথা নবিজির আগমনে খুশী উদ্‌যাপন করাকে বুঝায়।

বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, আলজেরিয়া, বাহরাইন, বেনিন, ব্রুনাই, বুরকিনা ফাসো, চাদ, মিশর, গাম্বিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, ইরাক, জর্দান, কুয়েত, লেবানন, লিবিয়া, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, মালি, মৌরিতানিয়া, মরক্কো, নাইজার, নাইজেরিয়া, ওমান, পাকিস্তান, সেনেগাল, সোমালিয়া, সুদান, তিউনিসিয়া এবং ইয়েমেন সহ বিশ্বময় বিভিন্ন দেশে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে উদ্‌যাপিত হয়। এ বছর ১৬ সেপ্টেম্বর সোমবার ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সাথে যথাযথ মর্যাদায় মধ্যপ্রাচ্য ও বাংলাদেশ সহ বিশ্বময় বসবাসকারী মুসলমানরা পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা:)পালন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

এই দিনে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা বিশেষ পুণ্যলাভের আশায় মিলাদ-মাহফিল, নফল নামাজ আদায়, জিকির ও কোরআন তেলাওয়াতে মশগুল থাকবেন।
“পবিত্র কোরআন শরিফে বর্ণিত আছে, ‘মহানবীকে সৃষ্টি না করলে মহান আল্লাহু রাব্বুল আলামিন পৃথিবীই সৃষ্টি করতেন না’।

আমাদের প্রিয় বিশ্বনবীর জন্মকে কেন্দ্র করে অনেক আশ্চর্যজনক কাজের জন্ম হয়েছে, যা সব জাতিকে বিমোহিত করেছে এবং তৎকালীন সময়ে গোটা বিশ্বে তা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল; সৃষ্টি হয়েছিল বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনাও। তাঁর পবিত্র জন্মের পর তিন দিন তিন রাত পর্যন্ত পবিত্র কা’বা শরীফ দুলতে থাকে। এই দৃশ্য দেখে কুরাইশ গোত্রের লোকেরা তথা গোটা আরব জাহানের মানুষেরা রাসূলুল্লাহ্ (সা:)’র জন্ম সম্পর্কে প্রথমে জানতে পারে (সিরাতে হালবিয়া, নবি (সা.)’র আবির্ভাব অধ্যায়)। পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যার স্মরণ সব জাতি সব যুগে করেছে। তিনি সেই মহামানব, যার নাম পবিত্র ইঞ্জিল ও তাওরাত শরিফে উল্লেখ আছে। সেখানে তাকে সম্বোধন করা হয়েছে ‘আহমদ’ নামে আর কুরআনে পাকে ‘মুহম্মাদ’ নামে। (তাফসিরে ইবনে কাসির, খ -২, পৃষ্ঠা ৩২৪)

মহানবী (সা:) যে রাতে জন্মগ্রহণ করেন, সেই রাতে পারস্যের রাজ প্রাসাদে প্রবল ভূকম্পনের সৃষ্টি হয়, যার ফলে তৎক্ষণাৎ সেই প্রাসাদের ১৪টি গম্বুজ ভেঙে পড়ে। এই নিদর্শনের মাধ্যমে তাদের ১৪ জন বংশধর ক্ষমতাবান হওয়ার ইঙ্গিত প্রদান করা হয়।

আর এই ১৪ জনের মধ্যে পরবর্তীতে মাত্র ৪ বছরে ১০ জন শাসক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। আর বাকী শাসকরা ইসলামের চতুর্থ খলীফা হজরত উমর (রা:)’র শহিদ হওয়া পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল। মহানবী (সা:)’র জন্মের দিন পারস্য তথা ইরানের আগুন নিভে যায়, যা হাজার বছর ধরে প্রজ্বলিত ছিল। [বায়হাকি, দালাইলুন নবুয়্যাহ্ (প্রথম খ-) পৃ. ১২৬]

হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ্ (সা:) ইরশাদ করেন, মহান আল্লাহর আমার প্রতি সম্মান হলো, আমি খাত্নাবিশিষ্ট অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছি, যাতে আমার লজ্জাস্থান কেউ না দেখে। (মু’জামে আওসাত, হাদিস নং- ৬১৪৮)