– আকতার চৌধুরী
আমরা এক ভাই এক বোন । বোন বড়। ৭ মাস বয়সে পিতৃহারা হই। দাদার হাতেই বড় হই। তিনি কোন একদিন লক্ষ্য করলেন গ্রামের আর দশটা ছেলেদেরমত আমিও গালি শিখে গেছি। যখন তখন খারাপ আচরণ করছি। টুকটাক খেলার মাঝে মারামারিও করছি। এ অবস্থা দেখে আমাকে আর গ্রামে রাখতে রাজি হলেন না।
বড়বোনকে আগেই শহরে গার্লস হাই স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। ছোটবেলায় প্রাইমারী শেষ করে গ্রাম ছেড়ে কক্সবাজার শহরে চলে আসি। কক্সবাজার সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। অনেকটা শহুরে ভাব চলে আসে।
একদিন স্কুলে যাচ্ছিলাম রিকসা দিয়ে। সিকদার মহলের পাশ দিয়ে যেতেই দেখলাম আমার গ্রামের স্কুলের এক স্যার হেটে যাচ্ছেন। আমি চলন্ত রিকসা থেকে এমনভাবে লাফ দিলাম অনেকটা স্যারের পায়ের কাছে। পা মচকে যাওয়ার অবস্থা দেখে স্যারও কিছুটা বকা দিল , এমনভাবে লাফ দেয় কেউ! নেমে সোজা পায়ের কাছে আমার হাত।
সেদিন আমার কাছে মনে হয়েছিল , স্যার হেটে যাবেন , আমি রিকসার উপরে। এটা অশোভন , অনেক বড় বেয়াদবি।
একদিন গ্রামে গেছি। একথা শুনে গ্রামের এক ফুফু ছুটে আসে সৌদি প্রবাসী স্বামীর চিঠি নিয়ে। আমাকে পড়ে দিতে হবে। গ্রামে পড়াশোনা জানা লোকের খুব অভাব ছিল। পড়ে দিতে পেরে নিজেকে নিয়ে কিযে খুশী হয়েছিলাম তার কোন ইয়ত্তা নেই । যেন মাস্টার মাস্টার ভাব!
১৯৭৯-৮০ সালের দিকে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিরক্ষরতা দূরীকরণে গ্রাম সরকারের মাধ্যমে বয়স্কদের জন্য ‘নাইট স্কুল’ চালু করে গ্রামে। আমাদের কাচারী ঘরে গ্রামের মা খালা দাদীরাও চলে আসত পড়তে। তাদের অনেককে অ আ ক খ শিখিয়েছি। আবার কেউ কেউ শুধুমাত্র নিজের নামটা স্বাক্ষর করতে শিখেছেন।
প্রচ্ছন্নভাবে এসব বিষয় আমাকে শিক্ষকতার প্রতি আগ্রহী করে তুলে।
প্রথম জীবনে একটি কর্পোরেট হাউসে চাকরী শুরু, পরে ব্যবসা । এর কোনটিই আমাকে স্থায়ীত্ব দেয়নি। ১৯৯৮ সাল থেকে কক্সবাজার সিটি কলেজে শিক্ষকতার পেশায় জড়িত আছি। ২৬টি বছর পার হয়েছে। এখানে অর্থের প্রাচুর্য না থাকলেও , আছে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর ভালবাসা , শ্রদ্ধা। সামাজিক মর্যাদা, সম্মান আর মানসিক তৃপ্তি।
আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস। সারা পৃথিবীর সকল শিক্ষকদের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা। তবে এক প্রবল শঙ্কা আমাকে ঘিরে ধরে—আমাদের সেকালের শ্রদ্ধা আজকের দিনে বড় আকাল। হয়তো আমরা দিতে পারছি না, নয়তো নিতে জানছি না। এই বিশাল জেনারেশন গ্যাপ আমাদের মধ্যে ক্রমশ গভীর হচ্ছে।
শিক্ষকতা শুধু একটি পেশা নয়; এটি একটি পবিত্র দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব যেন আমরা ভুলে না যাই।