গত এক দশকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে সমুদ্র-তীরবর্তী সীমান্ত জেলা কক্সবাজার। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ১ হাজার ১০১ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছে কক্সবাজারে। এ সময় শুধু এখানেই বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যু হয় ২০৬ জনের।
কক্সবাজার ছাড়াও এ তালিকায় ওপরের দিকে থাকা অন্য জেলাগুলো হলো ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ, খুলনা ও যশোর। সারা দেশে বন্দুকযুদ্ধে মোট নিহতের ৬০ শতাংশেরই প্রাণহানি হয়েছে এ কয়েকটি জেলায়।
যদিও প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা আরো অনেক বেশি বলে মনে করছেন মানবাধিকার কর্মীরা। তবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে মূলত ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দায়ে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন ও এর সাত কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর থেকে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মৃত্যু এক প্রকার বন্ধ রয়েছে। সেক্ষেত্রে পরে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পরিবর্তে মাত্রা বেড়েছে অপহরণ ও গুমের।
দেশে গত এক দশকে সংঘটিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বেআইনি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বড় ধরনের যোগসূত্র রয়েছে বলে মনে করছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সংশ্লিষ্ট ও মানবাধিকার কর্মীরা। তাদের ভাষ্যমতে, এসব কার্যক্রম থেকে আসা আয়ের ভাগ-বাটোয়ারা বা কমিশন নিয়ে বিরোধসহ নানা বিষয় এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে বড় অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। আবার রাজনৈতিক কারণসহ নানা ঘটনার প্রেক্ষাপটেও এমন অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটতে দেখা গেছে, যেগুলো হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পকের সঙ্গে পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে ঘটেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি বা সন্ত্রাসী অর্থনীতি যেটাই বলি এটি কিন্তু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটনে চরমভাবে প্রভাবকের ভূমিকা রাখে। কারণ এ ধরনের অর্থনীতির সঙ্গে অপরাধীদের যেমন সম্পৃক্ততা থাকে, তেমনি কতিপয় অসাধু পুলিশ কর্মকর্তারও যোগসাজশ থাকে। ফলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হলে সবার আগে এ অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির ওপর নজর রাখতে হবে। পাশাপাশি এ ধরনের অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত হিসেবে অভিযুক্ত বা সন্দেহভাজন সবার রেকর্ড সংরক্ষণ এবং নিয়মিত বিশ্লেষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। তাহলেই এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা যাবে।’
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে গোটা দেশের মধ্যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে কক্সবাজারে। ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত জেলাটিতে পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মৃত্যু হয়েছে ২০৬ জনের। পর্যটন কেন্দ্রসহ সামুদ্রিক অর্থনীতিনির্ভর জেলাটি সাম্প্রতিক বছরগুলোয় রোহিঙ্গা সংকটের পাশাপাশি কয়েকটি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মৃত্যুর ঘটনায়ও বেশ আলোচিত হয়েছে।
এর মধ্যে শুধু ২০১৮ সাল থেকে পরের চার বছরেই মৃত্যু হয়েছে ২০১ জনের। জেলাটিতে সবচেয়ে বেশি বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ২০১৯ সালে। ওই বছর জেলার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যু হয় ১১৫ জনের।
এ ব্যাপারে টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গিয়াস উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাৎক্ষণিকভাবে তার মন্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
গত ১০ বছরে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল ঢাকা। রাজনীতির পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিরও কেন্দ্রে রয়েছে ঢাকা অঞ্চল। একই সঙ্গে এখানে অপরাধমূলক কার্যক্রমেরও প্রসার ঘটেছে অনেক। পাশাপাশি বেড়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও। ঢাকা জেলাভুক্ত এলাকাগুলোয় ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৪৩ জন। এর মধ্যে ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ৩৪ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। পরের দুই বছর ২০১৭ ও ২০১৮ সালে বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যু হয় যথাক্রমে ২৩ ও ২৯ জনের। ২০১৯ ও ২০২০ সালে ঢাকা জেলায় ১৭ জন করে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। ২০২১ সালে এ সংখ্যা ছিল ৫।
‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতের পরিসংখ্যানে তৃতীয় অবস্থানে আছে চট্টগ্রাম জেলা। দেশের মোট আনুষ্ঠানিক আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের ৭০ শতাংশই পরিচালিত হয় এখানকার চট্টগ্রাম বন্দরকে কেন্দ্র করে। এখানে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ৬০ জন। এর মধ্যে ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ ১৮ জন বন্দুকযুদ্ধে মারা যান। তার আগের বছর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ১৬ জন।
সীমান্তবর্তী জেলা কুষ্টিয়ায় বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন ৫২ জন। এর মধ্যে ২০১৮ সালে এখানে ২০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব হত্যাকাণ্ডের বড় একটি অংশের পেছনে মাদক ব্যবসা ও চোরাচালানের মতো কার্যক্রমের বড় ভূমিকা রয়েছে বলে স্থানীয় মানবাধিকার কর্মীদের অভিযোগ।
কুষ্টিয়ার সামাজিক সংগঠনগুলোর প্লাটফর্ম সম্মিলিত সামাজিক জোটের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট মোহাইমিন পলল জানান, তারা এ ধরনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুটি ঘটনার ওপর কাজ করেছেন। এর মধ্যে জেলার দৌলতপুর উপজেলার সীমান্ত এলাকায় মাদক ব্যবসার আধিপত্য বিস্তার ঘটাতে অর্থের বিনিময়ে হত্যাকাণ্ড ঘটানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছাড়াও ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়।
কুমিল্লা জেলায় বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন ৫০ জন। এর মধ্যে ২০১৮ সালে ২০ জন এবং তার পরের বছর ১৯ জন বন্দুকযুদ্ধে মারা যান। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এখান থেকে প্রত্নসম্পদ চুরি ও পাচারের পাশাপাশি মাদক ও স্বর্ণ চোরাচালানের বিস্তার ঘটারও অভিযোগ রয়েছে।
এ ১০ বছরে শিল্পনগরী খুলনায় বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন ৪৮ জন। পাশের জেলা যশোর সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশ থেকে ভারতে স্বর্ণ পাচারের প্রধানতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। ২০১৫ সালের পর থেকে এখানে ৩০ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
যশোরে সংঘটিত বিচারবহির্ভূত হত্যাগুলোর ক্ষেত্রে বৃহদংশের সঙ্গে স্বর্ণ ও মাদক চোরাচালানে আধিপত্য বিস্তারের বিষয়টি জড়িত বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
রাইটস যশোরের নির্বাহী পরিচালক বিনয়কৃঞ্চ মল্লিকের অভিযোগ, যশোরের সাবেক এক এসপির সময় টাকার বিনিময়ে ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত ওই পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে চেষ্টা করেও তাৎক্ষণিকভাবে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
ময়মনসিংহে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ৪৫ জন। গাজীপুরে নিহত হন ৩৪ জন ও নারায়ণগঞ্জে নিহত হন ২৪ জন। এ জেলাগুলোয়ও মাদক, অস্ত্র ও চাঁদাবাজির অনানুষ্ঠানিক আর্থিক কার্যক্রম গত এক দশকে বাড়তে দেখা গেছে।
মানবাধিকার কর্মী মো. নূর খান লিটন বলেন, ‘বিগত বছরগুলোয় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের গতিপ্রকৃতি দেখে বলা যায়, বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকারের প্রকৃত সংখ্যা পুলিশের এ পরিসংখ্যানের চেয়েও কয়েক গুণ বেশি হবে। যেমন শুধু কক্সবাজারেই মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার নামে এক বছরে শতাধিক মানুষকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে। কুষ্টিয়া, খুলনা ও যশোরে চরমপন্থী নির্মূলের নামে বিশেষ অভিযান চালিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে। আর ঢাকায় বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ঘটনাগুলোর বেশির ভাগই রাজনৈতিক। বন্দুকযুদ্ধের ধরনগুলো ভিন্ন হলেও এর নেপথ্যে অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্যের প্রভাব রয়েছে। এসব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পেছনে অর্থের লেনদেন রয়েছে বলেও শোনা যায়।’
বিষয়গুলো নিয়ে জানতে চাইলে র্যাবের মুখপাত্র লে. কর্নেল মো. মুনীম ফেরদৌস তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। আবার পুলিশ সদর দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের পক্ষ থেকেও আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
-নিউজ২৪
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।