শহিদ সিরাত:
কক্সবাজার সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জামায়াত ইসলামী কক্সবাজার জেলার সাবেক সেক্রেটারী জি.এম রহিমুল্লাহ এর ৬ষ্ট মৃত্যুবার্ষিকী আজ (২০ নভেম্বর)। জি.এম রহিমুল্লাহ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ২০১৮ সালের ২০ নভেম্বর ইন্তেকাল করেন।
তিনি কক্সবাজার সদরের ভারুয়াখালী বানিয়াপাড়ার বাসিন্দা মৃত আব্দুল হাকিম ও দিলদার বেগমের পুত্র।
ভারুয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জি.এম রহিমুল্লাহ ছাত্র জীবন থেকেই নেতৃত্ব বিভিন্ন সংগঠনের দিয়েছেন। ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় ছাত্র আন্দোলন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
অজপাড়া গাঁয়ের একজন ছেলে হয়েও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত ইসলামী ছাত্র শিবিরের নেতৃত্ব দেন তিনি। তখনকার সময়ে তার দক্ষ ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ছিল খুবই প্রশংসনীয়।
জি.এম রহিমুল্লাহ ছিলেন একাধারে রাজনৈতিক নেতা, নিষ্ঠাবান সমাজকর্মী, নির্লোভ ব্যক্তি। ইউপি চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যন্ত তাকে কোন অনিয়ম-দুর্নীতি স্পর্শ করতে পারেনি। ছয় বছর আগে তাঁকে হারিয়ে শুধু বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী নয়, কক্সবাজারবাসীও একজন সম্পদ হারিয়েছিলো।
মৃত্যূর পরদিন ২১ নভেম্বর বুধবার জি.এম রহিমুল্লাহ’র স্মরণকালের বিশাল প্রথম নামাজে জানাজা সকাল দশটায় কক্সবাজার কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে এবং একইদিন বাদে জুহুর ভারুয়াখালীতে দ্বিতীয় নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
জি.এম রহিমুল্লাহ’র সংক্ষিপ্ত জীবনী :
জি.এম রহিমুল্লাহ ১৯৬৬ সালের
৩০ জানুয়ারী প্রত্যন্ত অঞ্চল কক্সবাজার সদর উপজেলার ভারুয়াখালী ইউনিয়নের বানিয়া পাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা ছিলেন- লোকমান হাকিম এবং মাতা ছিলেন- দিলদার বেগম। চার ভাই চার বোনের মধ্যে জিএম রহিমুল্লাহ সবার ছোট। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ভারুয়াখালী গ্রামে যে কয়জন সমাজ সচেতন ও শিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন জি.এম রহিমুল্লাহ’র পিতা লোকমান হাকিম ছিলেন অন্যতম। বড় ভাই মরহুম জি.এম সলিমুল্লাহ কক্সবাজার সরকারী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ছিলেন।
শিক্ষাজীবনঃ
পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান জি.এম রহিমুল্লাহ বাল্যকালে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিতে অসাধারণ প্রতিভা প্রদর্শনের মাধ্যমে তিনি মানুষের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।সচেতন পিতা-মাতা স্বপ্ন দেখতেন ছেলে একদিন উচ্চ শিক্ষিত হয়ে সমাজ ও দেশকে আলোকিত করবেন। সেই লক্ষ্যকে বুকে ধারণ করে পিতা তাকে গ্রামের নিকটবর্তী সাবেকপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে পঞ্চম শ্রেণী ও ভারুয়াখালী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় হতে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়ন করান। পিতামাতার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে তাকে ১৯৮০ সালে কক্সবাজার সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন। সেখান থেকে তিনি ১৯৮২ সালে দ্বিতীয় বিভাগে এসএসসি, সাতকানিয়া সরকারী কলেজ হতে ১৯৮৪ সালে দ্বিতীয় বিভাগে এইচএসসি, চট্টগ্রাম সরকারী কলেজ থেকে ১৯৯০ সালে দ্বিতীয় বিভাগে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে বিএ অনার্স ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৯৩ সালে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে দ্বিতীয় বিভাগে স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) ডিগ্রী অর্জন করেন।
রাজনৈতিক জীবনঃ
মাধ্যমিকে অধ্যয়নের সময় সদ্য প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবিরের সমর্থক ফরম পূরনের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি। ইসলামী আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে তাকে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে অনেক বাঁধা ও প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। শিবিরের সাথী হিসেবে শপথ নেওয়ার দিন তাকে নিজ বাড়ীর জানালা ও দেওয়াল ডিঙ্গিয়ে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগদান করতে হয়েছিল। তিনি ১৯৮৩ সালে কক্সবাজার শহর ছাত্র শিবিরের সভাপতি, ১৯৮৭ ও ৮৯ সালে কক্সবাজার জেলা ছাত্র শিবিরের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে অনন্য রাজনৈতিক প্রতিভার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রাম দক্ষিন জেলা ছাত্র শিবিরের সভাপতি ও ১৯৯২-৯৩ সালে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্র শিবিরের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। পরে ১৯৯৪-৯৫ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পাদক ও ১৯৯৬- ৯৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র শিবিরের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি ১৯৯৮-৯৯ সালে বাংলাদেশ ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে ছাত্র আন্দোলন বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে সারা বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতিতে ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছিলেন। মূল সংগঠন জামায়াত ইসলামীর সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে কক্সবাজার শহর আমিরের দায়িত্ব পালন করার পরে তিনি ২০১২ সাল হতে মৃত্যুর পূর্বে পর্যন্ত অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কক্সবাজার জেলা জামাতের সেক্রেটারী পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১২ সাল হতে মৃত্যুর পূর্বে পর্যন্ত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সুরা সদস্য পদেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
জনপ্রতিনিধি জি.এম রহিমুল্লাহ :
জীবনে প্রথম ২০০৩ সালে জনপ্রতিনিধি হিসেবে নিজ জন্মভূমি ভারুয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেন। সেই নির্বাচনে তিনি রেকর্ড সংখ্যক ভোটের ব্যবধানে বিজয় লাভ করেন। তিনি ২০০৩ সালের ২৬ মার্চ হতে ২০১১ সালের ৬ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় নয় বছর চেয়ারম্যানের দায়িত্বপালন করেছেন। ২০১৪ সালের কক্সবাজার সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনি মোটর সাইকেল প্রতীকে নির্বাচন করে প্রতিপক্ষের প্রবল ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচার স্বত্বেও বিপুল ভোটের ব্যবধানে কক্সবাজার সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে তিনি যে সৎ, যোগ্য, বলিষ্ঠ ও অপরাজিত নেতা ছিলেন তা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
রাজনৈতিক মিথ্যা মামলার অজুহাতে ২০১৫ সালে কক্সবাজার সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হতে পদচ্যুতি করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাঁর বিরুদ্ধে যে নোটিশ প্রদান করেছিল হাইকোর্ট তা বহাল রাখা সত্বেও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগে আপিলের মাধ্যমে তিনি উনিশ দিনের ব্যবধানে স্বপদে ফিরে এসে বলিষ্ঠ নেতৃত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি অত্যন্ত সুনামের সাথে মৃত্যুর পূর্বে পর্যন্ত কক্সবাজার সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
সমাজ সেবা, ইসলাম প্রচার ও শিক্ষা বিস্তার :
ইসলামী শিক্ষাকে প্রসস্থ করার মানসে জন্মভূমি ভারুয়াখালীতে পৈত্রিকভাবে প্রাপ্ত জায়গায় তিনি ২০১৪ সালে হযরত আয়েশা ছিদ্দীকা (রঃ) বালিকা মাদ্রাসাটি এককভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। মাদ্রাসাটি ভারুয়াখালীতে প্রথম বালিকা দাখিল মাদ্রাসা হওয়ায় সকলের নিকট প্রতিষ্ঠানটির গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। মাদ্রাসাটির পাশে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করে তিনি জীবদ্দশায় জীবনের পরিপূর্ণ স্বাদ গ্রহণ করে নিতে পেরেছেন। ভারয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদ ও কক্সবাজার সদর উপজেলা চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে তিনি বিভিন্ন সরকারী বরাদ্দ ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিতরণ করতেন। তিনি কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল স্কুলেরও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, তিনি বাংলাবাজার আইডিয়াল ইনস্টিটিউট, ভারুয়াখালী মুফিদুল উলুম দাখিল মাদ্রাসা, পানিরছড়া আইডিয়াল কেজি স্কুল, পূর্ব ভারুয়াখালী উচ্চ বিদ্যালয়সহ জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উৎসাহ দিয়ে , সাহস দিয়ে, বরাদ্দ দিয়ে ও নানাভাবে সহযোগীতা করে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
পারিবারিক জীবনঃ
তিনি ২০০০ সালে মহেশখালী উপজেলার কতুবজুম ইউনিয়নের অধিবাসী কক্সবাজার সাগরগাঁও হোটেলের সত্ত্বাধিকারী জালাল আহমেদ ও জুহুরা বেগমের অনার্স পড়ুয়া কন্যা সাজেদা পারভীনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের বিবাহিত জীবনে তিন মেয়ে ও এক ছেলে জন্ম গ্রহণ করেন। জি.এম রহিমুল্লাহর মৃত্যুকালে সবার ছোট একমাত্র ছেলে জি.এম নাবহানের বয়স ছিল মাত্র দুই বছর ছয় মাস।
মৃত্যু ও জানাযাঃ
২০১৮ সালের ২০ নভেম্বর কক্সবাজার সাগরগাঁও হোটেলে ৩১৬ নং কক্ষে ঘুমন্ত অবস্থায় ৫৩ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর মাস কয়েক পূর্ব হতে হয়রানি মূলক মিথ্যা রাজনৈতিক মামলার কারণে তিনি বাধ্য হয়ে বাড়ীর বাইরে রাত্রি যাপন করতেন। ক্ষণজন্মা এই পুরুষের আচমকা মৃত্যুর খবর চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লে তার আত্বীয়-স্বজন, বুন্ধুবান্ধব, সমর্থক, শুভাকাঙ্ক্ষীসহ সর্বস্তরের মানুষের অন্তর আত্মা বিষাদের কালো মেঘে ঢেকে পড়ে। শেষ বারের মতো প্রিয় নেতাকে এক নজর দেখার জন্য তার কফিনের পাশে প্রত্যেক মানুষকে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়েছিল। ২১ নভেম্বর সকাল ১০ঘটিকায় জানাযার জন্য ঘোষিত স্থান কক্সবাজার কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে জানাযা শুরু হওয়ার অনেক আগেই মুসল্লীতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। ঈদগাহ মাঠ, পাশের রাস্তাঘাট, অলিগলি, পৌর প্রিপ্যারেটরী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ, কক্সবাজার স্টেডিয়াম, হাসপাতাল সড়ক, সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের পশ্চিম পাশের সড়ক, মোহাজের পাড়া সড়কসহ আরো বিভিন্ন সড়ক মুসল্লীতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়।
মরহুমের জন্মভূমি ভারুয়াখালীতে দ্বিতীয় নামাজে জানাযায় আলিম মাদ্রাসা সংলগ্ন বিশাল মাঠ ও পাশের সড়ক মুসল্লীতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। ভারুয়াখালীর ইতিহাসে এত বড় জানাযা মানুষ আর দেখেনি। জানাযা শেষে তার প্রতিষ্ঠিত হযরত আয়েশা ছিদ্দিকা (রাঃ) বালিকা দাখিল মাদ্রাসার পুকুরের পশ্চিম পাড়ে চিরনিদ্রায় তাকে শায়িত করা হয়।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।