নিজস্ব প্রতিবেদক :

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতর ডিভিশন পাওয়া তিন বন্দিদেরকে রাজার হালেই থাকার সাথে তুলনা করেন বন্দিরা। এই মুহুর্তে চট্টগ্রাম কারাগারে ডিভিশন সুবিধায় আছেন ৩ মোস্ট ভিআইপি মর্যাদায়।

এদের মধ্যে একজন চট্টগ্রাম-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী ও শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী গ্রুপ কেডিএসের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমানের ছেলে ইয়াসিন রহমান টিটু।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক মো. ইকবাল হোসেন।

এখনো পর্যন্ত আদালতের কাছে আবেদন করেও যাঁরা ডিভিশন পাননি কিংবা ডিভিশন নেননি তাঁরা হলেন-চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সাবেক সভাপতি এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম-১৫ আসনের সাবেক এমপি আবু রেজা মো. নেজাম উদ্দিন নদভী, চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এম এ লতিফ ও হাটহাজারী থানার সাবেক ওসি বর্তমানে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) রফিকুল ইসলাম।

কারাবিধি অনুযায়ী কারাগারে ডিভিশন সুবিধা পান সাবেক এমপি, মন্ত্রী, সিআইপি ও সরকারি কর্মকর্তারা। এ ছাড়া ডিভিশন সুবিধার জন্য যে কোনো বন্দি নিজের সামাজিক অবস্থান তুলে ধরে কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিংবা আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতের কাছে আবেদন করতে পারেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আদালত যদি কোনো বন্দিকে ডিভিশন সুবিধার আবেদন মঞ্জুর করে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়- তাহলে সেই বন্দি ডিভিশন সুবিধা পেয়ে থাকেন।

যারা কারাগারে ডিভিশন পান তাদের আলাদা রুম বা সেলে রাখা হয়। সেখানে থাকে খাট, ভালো বিছানা, টেবিল, চেয়ার, তোষক, বালিশ, তেল, চিরুনি, আয়নাসহ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস। ডিভিশন পাওয়া বন্দিদের জন্য একজন করে সহকারীও দেওয়া হয়। তারা সংশ্লিষ্ট বন্দির প্রয়োজনীয় কাজগুলো করে দেন। পুরুষ বন্দির সাহায্যকারী হিসেবে থাকে একজন পুরুষ আর নারী বন্দির জন্য থাকে একজন নারী সহকারী।

এ ছাড়া কারাগারের বাইরে থেকে স্বজনদের দেওয়া খাবার যাচাই-বাছাই করে কারাগারের ভেতরে পাঠিয়ে দেয় কারা কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া বন্দির চাহিদার প্রেক্ষিতে বইপত্র এবং দু-তিনটি দৈনিক পত্রিকাও থাকবে। সাধারণ বন্দিদের চেয়ে ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দির খাবারের মানও যথেষ্ট ভালো থাকে।

ওদিকে, সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী এবং চট্টগ্রাম-১ (মীরসরাই) আসনের সাবেক এমপি ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে আরও নয়টি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। বুধবার চট্টগ্রামের পৃথক তিনটি আদালতে হাজির করা হলে বিচারকরা তাকে গ্রেফতার দেখানোর আদেশ দেন। এর আগে আদালতে তার জামিনের আবেদন করা হয়। মঙ্গলবার রাতে তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে চট্টগ্রাম করাগারে নেওয়া হয়।

জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী গ্রেপ্তার হন।

চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে সোমবার (২৫ নভেম্বর) বিকেল রাজধানীর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তাকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। পরে মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) দুপুরে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন-৬ এর কাজী শরিফুল ইসলামের আদালতে তোলা হলে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন বিচারক।

গত ৩১ অক্টোবর নগরের চান্দগাঁও মোহরা ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ খান বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলা করেন। পরে ফিরোজ খানকে বিএনপি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ মামলায় চিন্ময় কৃষ্ণসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদে ভারতীয় নাগরিক জিবরান তায়েবী হত্যা মামলায় শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী গ্রুপ কেডিএসের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমানের ছেলে ইয়াসিন রহমান টিটুর যাবজ্জীবন সাজা বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। গত বছরের ৮ আগস্ট প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেন।

২০১২ সালের ১ আগস্ট জিবরান তায়েবী হত্যা মামলায় আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠের মতে টিটুর যাবজ্জীবন বহাল রাখেন। পরে ওই রায় রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) চেয়ে টিটু আবেদন করেন।

চট্টগ্রাম সেন্ট্রাল মেরিটাইম (বিডি) লিমিটেডের প্রিন্সিপাল রিপ্রেজেনটেটিভ হিসেবে কর্মরত থাকাকালে ১৯৯৯ সালে জিবরান তায়েবীকে আগ্রাবাদের শেখ মুজিব রোডের চুংকিং রেস্টুরেন্টের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় পরদিন চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানায় জিবরানের সহকর্মী জেমস রায় মামলা করেন।

জিবরানের বাবা টি এ খান পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের তৎকালীন শীর্ষ কর্মকর্তা ছিলেন। চাকরির সূত্রে ওই সময় জিবরান তাঁর স্ত্রী তিতলী নন্দিনীকে নিয়ে চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন।

ওই ঘটনায় করা মামলায় ১৯৯৯ সালে আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। আট আসামি হলেন ইয়াছিন রহমান টিটু, মো. ওসমান আলী, আলী আকবর ওরফে দিদারুল আলম, জিল্লুর রহমান, জাহিদ হোসেন ওরফে কিরণ, মো. সিদ্দিক, ওমর আলী ওরফে জাহাঙ্গীর কসাই ও আলমগীর।

বিচার শেষে ২০০২ সালে চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালত রায় দেন। রায়ে পাঁচজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া আসামি টিটু, ওমর আলী ও আলমগীর খালাস পান।

ওই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ হাইকোর্টে আপিল করে। এ ছাড়া আসামিরাও রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। শুনানি শেষে ২০০৭ সালে হাইকোর্ট পলাতক টিটুকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।

গত ২৫ সেপ্টেম্বর ফজলে করিম চৌধুরীর বাড়িতে অভিযান চালায় যৌথবাহিনী। অভিযানে তার বাড়ি থেকে একটি পয়েন্ট ২২ বোর রাইফেল, একটি এলজি, একটি রিভলভার, একটি শটগান ও সাত রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়।

গত ১২ সেপ্টেম্বর সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সীমান্তের আবদুল্লাহপুর এলাকা থেকে এবিএম ফজলে করিমসহ তিনজনকে আটক করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। ফজলে করিম আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন বলে বিজিবি জানিয়েছে। তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে মামলা হয়েছে ১৪টি। এসব মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর জন্য নিরাপত্তার কারণে তাকে ১৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে আনা হয় হেলিকপ্টারে করে।

চট্টগ্রাম-১৫ আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নদভীকে পাঁচ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। রোববার (১২ জানুয়ারি) চট্টগ্রাম সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মুমিনুন্নিসা খানম পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শুনানি শেষে এ আদেশ দেন।

আইনজীবীর আবেদনের ওপর শুনানি শেষে আসামিকে কারাবিধি অনুযায়ী ডিভিশন ও চিকিৎসা সুবিধা দিতে জেল সুপারকে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন আদালত। গত ১৫ ডিসেম্বর রাতে সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার সাবেক এই সংসদ সদস্যকে রাজধানীর উত্তরা এলাকা থেকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তার বিরুদ্ধে রাজধানীর লালবাগ থানায় দায়ের করা ঢাকা আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থী খালিদ হাসান সাইফুল্লাহ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ।

গত ৪ আগস্ট নিউমার্কেট এলাকায় হত্যাচেষ্টার ঘটনায় এই মামলা হয়। গত ১৭ আগস্ট নগরের বায়েজিদ বোস্তামী এলাকা থেকে এম এ লতিফকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তাঁকে আন্দোলনের হত্যা ও হামলার কয়েকটি মামলায় আসামি করা হয়।

সর্বশেষ মাদ্রাসা ছাত্র হাফেজ রবিউল ইসলাম হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া হাটহাজারী থানার সাবেক ওসি বর্তমানে সহকারী পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম কারাগারে রয়েছেন।

তাঁর কর্মস্থল ঢাকার উত্তরায় এপিবিএন সদর দপ্তর থেকে সহকারী পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার এই পুলিশ কর্মকর্তার গ্রামের বাড়ি বাগেরহাট জেলার মোড়লগঞ্জ থানা এলাকায়। তার বাবার নাম মোহাম্মদ আলী খান।

জানা যায়, ২০২১ সালের ২৬ মার্চ দুপুরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরের প্রতিবাদ মিছিল করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে হাফেজ রবিউল ইসলাম (২৪) নিহত হন। এই ঘটনায় ভিকটিমের বাবা আব্দুল জব্বার হাটহাজারী থানায় মামলা দায়ের করেন।

মামলায় হাটহাজারী মডেল থানার সাবেক ওসি মো. রফিকুল ইসলামকে প্রধান আসামি করার পাশাপাশি তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম–২ (ফটিকছড়ি) আসনের সাবেক এমপি সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী, চট্টগ্রাম জেলার সাবেক পুলিশ সুপার এসএম রশিদুল হক ও দুই উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌর প্রশাসক, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীসহ সুনির্দিষ্ট ২৮ জন এবং অজ্ঞাত পরিচয় ১৫ থেকে ২০ জন পুলিশ সদস্য ও অজ্ঞাত পরিচয় ১০০–১৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

এজাহারে বলা হয়, ২০২১ সালের ২৬ মার্চ বিকেলে হাটহাজারী মডেল থানার সামনে মাদ্রাসা ছাত্র হাফেজ রবিউল ইসলামকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আসামি সাবেক ওসি রফিকুল নিজেই রবিউল কে গুলি করে হত্যা করেন বলে এজাহারে অভিযোগ করেন বাদী নিহতের পিতা আব্দুল জব্বার।

তবে, যারা কারাগারে ডিভিশন সুবিধা লাভ করেন, তাদের শাস্তি শিথিল বা অপরাধ কমে যাওয়ার কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। আদালত এবং কারা কর্তৃপক্ষের নিয়মের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেই এসব সুবিধা প্রদান করা হয়।

বিশেষত, এই ঘটনাগুলোর ফলে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং আইনগত ক্ষেত্রে নানা ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, রাজনৈতিক প্রভাব এবং সামাজিক অবস্থান কি একটি বন্দির জন্য বিচারকরণের পরিবর্তে সুযোগ ও সুবিধার পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পারে?

এজন্য, ডিভিশন সুবিধার প্রক্রিয়া এবং বিচারব্যবস্থার মধ্যে সুষমতা বজায় রাখতে আরও নজরদারি ও অবাধ বিচারিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দাবি উঠেছে।