মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের উপদেষ্টা ড. আ.ফ.ম খালেদ হোসেন আরো বলেছেন, মডেল মসজিদ নির্মাণে অতিরিক্ত প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা, নির্মাণ কাজের গুনগত মান যথাযথ রক্ষা নাকরা, কাল্পনিক ব্যয় দেখানো, আরো অনেক ত্রুটি সহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সেজন্য তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে ইসলামী ফাউন্ডেশনের মহা পরিচালককে সদস্য করে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত মডেল মসজিদ নির্মাণে দুর্নীতি হয়েছে, সেটা দৃঢ়ভাবে বলা যাবেনা। তবে তদন্তে দুর্নীতির বিষয়টি প্রমাণিত হলে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

শুক্রবার (২১ মার্চ) কক্সবাজার জেলা মডেল মসজিদ ও ইসলামীক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র (কাচারী পাহাড়স্থ সাবেক কক্সবাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ) উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের উপদেষ্টা ড. আ.ফ.ম খালেদ হোসেন একথা বলেন।

উপদেষ্টা ড. আ.ফ.ম খালেদ হোসেন আরো বলেন, সমাজের নৈতিক অবক্ষয় রোধ, নৈতিকতা ও শিষ্ঠাচার সমৃদ্ধ পরিশুদ্ধ সমাজ বিনির্মাণে মসজিদের ভূমিকা অপরিসীম। কারণ নামাজ মানুষকে অন্যায় ও গর্হিত কাজ হতে বিরত রাখে। ন্যায় ও সুন্দরের দিকে ধাবিত করে। তাই মসজিদকে সমাজ সংস্কারের কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলতে হবে।

উপদেষ্টা ড. আ.ফ.ম খালেদ হোসেন বলেন, রমজানের মূল শিক্ষা হচ্ছে, তাকওয়া অর্জন করা। অর্থাৎ জীবনের সর্বক্ষেত্রে সবসময় খোদাভীরুতা অন্তরে লালন করা। তিনি আরো বলেন, ক্ষমতা, অর্থ, নারী মানুষকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। অন্তরে খোদাভীরুতা থাকলে এসবের লোভ সহজেই পরিহার করা যায়। তিনি বলেন, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ইসলামী ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনায় ১৯ কোটি ১৯ লক্ষ টাকা ব্যয়ে বহুমুখী সুবিধা সম্বলিত আধুনিক ও নান্দনিক স্থাপত্য শৈলীতে ৪ তলা বিশিষ্ট কক্সবাজার জেলা মডেল মসজিদ ও ইসলামীক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, নির্মিত মডেল মসজিদটি পরিপূর্ণ একটি মসজিদ কমপ্লেক্স। এটি বহুমুখী ব্যবহার করা যাবে। তিনি আরো বলেন, মানুষকে মসজিদমুখী করার মাধ্যমে পর্যটন নগরী কক্সবাজারকে শান্তি ও নিরাপদ নগরী হিসাবে গড়ে তুলতে হবে।

শুক্রবার দুপুর ১২ টার দিকে ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ.ফ.ম খালেদ হোসেন মসজিদ প্রাঙ্গনে পৌঁছালে মুসল্লীদের পক্ষ থেকে তাঁকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়। পরে মসজিদের প্রধান ফটকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফিতা কেটে ও ফলক উম্মোচনের মাধ্যমে জেলা মডেল মসজিদ ও ইসলামীক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটি উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে জেলা মডেল মসজিদ ও ইসলামীক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিন (যুগ্মসচিব), প্রকল্পের পিডি মোহাম্মদ শওকত আলম বক্তব্য রাখেন।

উপদেষ্টা ড. আ.ফ.ম খালেদ হোসেন আরো বলেন, “প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় ১টি করে ৫৬০ টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন (২য় সংশোধিত)” শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে সারাদেশে ৫৬৪ টি মডেল মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে। বিগত সরকারে আমলে রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাবে জনবিচ্ছিন্ন এলাকায় মডেল মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানে জনবসতি না থাকায় নির্মিত মসজিদে মুসল্লী পাওয়া যায়না। যা খুবই দুঃখজনক। এরকম জনবিচ্ছিন্ন এলাকায় পেকুয়া ও রাঙ্গুনিয়ায় নির্মিত ২ টি মডেল মসজিদের অবস্থান দেখে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলে সরকারী অর্থ এভাবে অপচয় করা কোনভাবেই উচিত হয়নি।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সাধারণ) নিজাম উদ্দিন আহমেদ, প্রকল্পের ডিপিডি মোহাম্মদ ফেরদৌস, ইসলামি ফাউন্ডেশন কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের উপ পরিচালক ফাহমিদা বেগম, গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী, কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমাম মুফতি সোলাইমান কাসেমী, অ্যাডভোকেট আকতার উদ্দিন হেলালী, অ্যাডভোকেট নেজাম উদ্দিন, অ্যাডভোকেট আবদুর রহমান, মাওলানা ইয়াছিন হাবিব প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। উদ্বোধনের পর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের দীর্ঘ ৩৪ বছরের খতিব আল্লামা মাহমুদুল হক এর খুতবা প্রদান করেন এবং জুমার নামাজ পড়ান।

উপদেষ্টা ড. আ.ফ.ম খালেদ হোসেন আরো বলেন, জেলা মডেল মসজিদ ও ইসলামীক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটি ঈদুল ফিতরের পর উদ্বোধনের কথা থাকলেও স্থানীয় মুসল্লীদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে তার আগে উদ্বোধন করে সবার নামাজের জন্য উম্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।

নবনির্মিত জেলা মডেল মসজিদ ও ইসলামীক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটির নীচতলায় গাড়ি পার্কিং, ইমাম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, পাম্প রুম, ইসলামি ফাউন্ডেশনের উপ পরিচালকের অফিস, পুরুষ মুসল্লীর অজুখানা, জেনারেটর রুম, লাশ ধোয়ার ঘর, প্রতিবন্ধীদের নামাজ কক্ষ, গণশিক্ষা কেন্দ্র, ডাইনিং রুম, রান্নাঘর, স্টোর রুম, ইসলামিক বুক সেন্টার ও গার্ডরুম। ২য় তলায় নামাজের মূল স্থান, পুরুষ মুসল্লীর অজুখানা, ইসলামি ফাউন্ডেশনের পরিচালকের অফিস, হিসাব রক্ষকের রুম, ইসলামি ফাউন্ডেশনের সাধারণ কর্মচারীদের রুম, ইসলামি গবেষণা কেন্দ্র, ইসলামি ফাউন্ডেশনের সহকারী পরিচালকের কক্ষ। ৩য় তলায় পুরুষ ও মহিলাদের পৃথক নামাজের স্থান, পুরুষ ও মহিলাদের পৃথক অজুখানা, ইসলামি লাইব্রেরি ও সম্মেলন কক্ষ। ৪র্থ তলায় পুরুষদের নামাজের স্থান, হেফজখানা, পুরুষ মুসল্লীদের অজুখানা, ইমামের কক্ষ, শিক্ষককের কক্ষ, খাদেম ও মোয়াজ্জেমের কক্ষ, ২ টি গেস্ট রুম ও বারান্দা রয়েছে। নব নির্মিত কক্সবাজার জেলা মডেল মসজিদ ও ইসলামীক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের লোকবল নিয়োগের লক্ষ্যে ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিন ৪টি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রদান করেছেন। পদগুলো হচ্ছে-ইমাম একজন, মোয়াজ্জেম একজন এবং খাদেম ২ জন।

শুক্রবার উদ্বোধনের দিন জুমার নামাজে শত শত মুসল্লী নামাজ পড়ার জায়গা নাপেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে অন্যত্র চলে যেতে দেখা গেছে। নতুন মসজিদটিতে পুরুষ মুসল্লী মাত্র ১১০০ জন এবং মহিলা মুসল্লী একশত জন নামাজ আদায় করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ভেঙে ফেলা পুরাতন কক্সবাজার কেন্দ্রীয় মসজিদ ও মসজিদের চেহেনে প্রায় দেড় হাজার মুসল্লী একত্রে নামাজ আদায় করতে পারতো। স্থানীয় মুসল্লীদের মতে, জনসংখ্যার আধিক্য ও জেলা সদরের মসজিদ বিবেচনায় নব নির্মিত জেলা মডেল মসজিদে কমপক্ষে ৩ হাজার মুসল্লী একত্রে নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা থাকলে ভালো হতো। মুসল্লীদের মতে, এখন জুমা, বিশেষ বিশেষ ইসলামি দিবস, রমজানে নব নির্মিত জেলা মডেল মসজিদে মুসল্লীদের স্থান সংকুলান না হওয়ার আশংকা রয়েছে। বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ও আনুষাঙ্গিক কাজের জন্য নব নির্মিত মসজিদে প্রচুর স্থান বরাদ্দ করায় মূলত নামাজের জায়গা সংকুচিত হয়ে গেছে। এছাড়া, প্রয়োজনের তুলনায় অজুখানা সংখ্যাও অপ্রতুল হয়েছে বলে মন্তব্য করেন, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মুসল্লী। এ বিষয়ে গণপূর্ত বিভাগ জানিয়েছে, মসজিদের ডিজাইন, প্ল্যান উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রকল্পের কাজ শুরু করার আগেই অনুমোদন করা হয়েছে। নির্মাণ কাজ বাস্তবায়নের সময় পূর্ব অনুমোদিত ডিজাইন, প্ল্যান তাদের পরিবর্তন করার কোন সুযোগ নেই।

প্রসঙ্গত, ১৭৯৮ খৃষ্টাব্দে কক্সবাজার শহরের টেকপাড়ার বাসিন্দা মুনসী উজির আলী সহ কয়েকজন হিতৈষী ব্যক্তির উদ্যোগে কক্সবাজার জেলা সদরে এ মসজিদটি প্রতিষ্ঠা হয়। প্রথমে মসজিদটির নাম ছিল ‘মুনসী উজির আলী মসজিদ’। পরে এটিকে ‘কক্সবাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ’ হিসাবে নামকরণ করা হয়। কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ থেকে শুক্রবার সারাদেশের ন্যায় ‘কক্সবাজার জেলা মডেল মসজিদ ও ইসলামীক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’ হিসাবে যাত্রা শুরু করেছে।