নিজস্ব প্রতিবেদক :
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মাসুমা জান্নাতের নামে ফেসবুকে একটি ভুয়া (ফেক) আইডি খুলে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় তিনি গত ৫ মার্চ সিএমপি’র কর্ণফুলী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন, যার নম্বর ২৩৯।
অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেছেন, অজ্ঞাত ব্যক্তি তার নামে ফেসবুক আইডি খুলে ফরিদপুর জেলার চরভদ্রাসন উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) নিশাত ফারাবীর ছবি ব্যবহার করে অপপ্রচার চালাচ্ছেন এবং বিভিন্নজনের কাছ থেকে অর্থ দাবি করছেন।
প্রতারণার কৌশল ও অভিযুক্ত ফেসবুক আইডির কার্যক্রম
জিডি সূত্রে জানা গেছে, ইউএনও মাসুমা জান্নাত ১ মার্চ দুপুরে নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করে দেখতে পান, তার নাম ব্যবহার করে একটি নতুন ফেক আইডি খোলা হয়েছে। আইডির প্রোফাইলে সহকারী কমিশনার (ভূমি) নিশাত ফারাবীর ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। এই আইডির মাধ্যমে কর্ণফুলী উপজেলা প্রশাসনের নামে বিভিন্ন কার্যক্রম প্রচার করা হচ্ছে, যা বাস্তবে চরভদ্রাসন উপজেলার এসিল্যান্ড নিশাত ফারাবীর ভ্রাম্যমাণ আদালতের ছবি।
এই ফেক আইডি থেকে কর্ণফুলী উপজেলার সাধারণ মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করে আর্থিক লেনদেনের ফাঁদ তৈরি করা হয়েছে। জিডিতে সংযুক্ত ১৭টি স্ক্রিনশট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কিছু স্ক্রিনশটে ‘নবনিযুক্ত কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার’ বলে অভিনন্দন জানানো হয়েছে। এছাড়া, এসিল্যান্ড নিশাত ফারাবীর সরকারি কার্যক্রমের বিভিন্ন ছবি ওই আইডি থেকে পোস্ট করা হয়েছে, যা জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে।
প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া
জিডিতে সংযুক্ত করা স্কিনশটে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতারক চক্র ওই ফেক আইডির মাধ্যমে অন্তত ৮,৬০০ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৬টা ৫২ মিনিটে একজন ব্যক্তি একটি বিকাশ এজেন্ট নম্বর থেকে ০১৬২০-৩০৬১৩৪ নম্বরে টাকা পাঠিয়েছেন। স্ক্রিনশট থেকে পাওয়া ট্রানজেকশন আইডি (৭৩পিওজেএনই৪) অনুযায়ী, টাকা ক্যাশ-ইন হয়েছে এয়ারটেল সিম ব্যবহারকারী একটি নাম্বারে, যার নিবন্ধন করা হয়েছে ২০২৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি।
প্রতারণার শিকার ব্যক্তির পরিচয় স্পষ্ট করা না হলেও কর্ণফুলী উপজেলা প্রশাসনের ফেসবুক পেজে সতর্কতামূলক পোস্ট দেওয়া হয়, যাতে জনসাধারণকে এই ফেক আইডির মাধ্যমে প্রতারিত না হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
নিশাত ফারাবীরও জিডি, প্রতারক চক্রের ছলচাতুরি
এ ঘটনায় চরভদ্রাসন উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) নিশাত ফারাবীও ৪ মার্চ চরভদ্রাসন থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি নম্বর-১১৫) করেন। তিনি জিডিতে উল্লেখ করেন, তার ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি থেকে ছবি নিয়ে প্রতারক চক্র মাসুমা জান্নাত নামে ফেক আইডি খুলেছে এবং তার ছবি ব্যবহার করে পরিচয় দিচ্ছে। এই ফেক আইডি যদি কোনো অপরাধমূলক কাজ বা আর্থিক লেনদেনে যুক্ত থাকে, তবে তাঁর কোনো দায় নেই।
প্রতারক চক্রের পরিচয় ও অবস্থান
প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে জানা গেছে, যে ০১৬২০-৩০৬১৩৪ নম্বরে প্রতারণার টাকা পাঠানো হয়েছে সেটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অ্যাপস ‘আইকনে’ নম্বরটি নাম লিখা আসে ইংরেজিতে ম্যাজিস্ট্রেট আপু। তার মানে একই নম্বর ব্যবহার করে অনেক লোকজনকে তিনি ম্যাজিস্ট্রেট পরিচয়ে প্রতারণা করছেন। অন্তত তা স্পষ্ট।
আরো তথ্য মিলে, মোবাইল কোম্পানি রবি আজিয়াটা লিমিটেড ইলেকট্রনিক টেলিযোগাযোগ গ্রাহক নিবন্ধন ফরমের তথ্য বলছে, ০১৬২০ ৩০৬১৩৪ নম্বরটি নিবন্ধন করেছেন গত ২০২৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারিতে। এয়ারটেল সিমটির মেয়াদ ১ বছর ১ মাস ৭ দিন। মোবাইল কোম্পানিতে গ্রাহক হিসেবে তার নাম এরশাদ। গ্রাহক হিসেবে যার এনআইডি স্মার্ট কার্ড নম্বর-৯৫৮৪৮৬৬১৫৭। জন্মতারিখ ২ মার্চ ২০০২ সাল। ঠিকানা কক্সবাজার সদর এলাকার ঈদগাঁহ।
তবে তথ্য মিলে জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী, ব্যক্তিটির নাম এরশাদুর রহমান। পিতার নাম ফরিদ আহাম্মদ। মাতার নাম রুজিয়া বেগম। তার জন্মসাল ২ মার্চ ২০০২। স্থায়ী ঠিকানা কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলার রশীদ নগর ইউনিয়নের উত্তর কাহাতিয়া পাড়া ধলিরছড়া গ্রাম।
একই ইউনিয়নের ধলিরছড়া গ্রামের গ্রাম পুলিশ জসিম উদ্দিনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ‘এরশাদুর রহমান আমাদের এলাকার। আমি এলাকার গ্রাম পুলিশ হিসেবে তাকে চিনি। সে বর্তমানে এলাকায় রয়েছে।’
ওর নামে রেজিষ্ট্রেশন করা সিমটিতে প্রতারণা করে ৮ হাজার ৬০০ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তাও কর্ণফুলীর ইউএনও’র নাম ও চরভদ্রাসন উপজেলার এসিল্যাণ্ডের ছবি ব্যবহার করে ফেসবুকে ফেক আইডি খুলে। দুজন বিসিএম ক্যাডারের নাম ভাঙিয়ে প্রতারণা করছেন।
প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণে আরো দেখা গেছে
যে নম্বরটিতে টাকা নেওয়া হয়েছে সে নম্বরটি মার্চ মাসের ২ তারিখ হতে ১৯ তারিখ পর্যন্ত প্রতারকচক্র ব্যবহার করেছেন মোট ১৮ বার। তাও একবারো কাউকে ওই নম্বর থেকে ফোন কল করেননি। শুধুমাত্র শর্ট মেসেজ সার্ভিস (এসএমএস) ব্যবহার করেছেন তথ্য আদান প্রদানে। হতে পারে বিকাশের মেসেজ লেনদেন শুধু। এই ১৮ বার যখন সে তার নম্বরটি ব্যবহার করেছেন। তখন তার লোকেশন ছিলো সব সময় কুমিল্লা জেলায়।
ফোনটি ১৮ বার ব্যবহারে যে লোকেশন পাওয়া গেছে, তাতে দেখা মিলে সে কুমিল্লা জেলার নাঙ্গলকোট উপজেলার ভালতা বামপাড়া গ্রাম এবং কুমিল্লা পৌরসভার চৌদ্দগ্রামের শাহী ম্যানসনে ছিলেন। তথ্য আরো বলছে প্রতারকের মোবাইলটি একটি বাটন ফোন। তাই ফোনের নেটওয়ার্ক সব সময় টুজিতে পরিলক্ষিত ছিলো। যে ফোনের আইএমইআই নম্বর দেখা গেছে ৩৪৪৩-৩৬৯৬-১০৩৫-৫৫০।
জিডি করেছিলেন আগে এসিল্যান্ড পরে ইউএনও
কর্ণফুলী ইউএনও মাসুমা জান্নাত তাঁর জিডিতে বিভিন্ন অপপ্রচারের অভিযোগ উল্লেখ করেছেন, তবে প্রতারক চক্র যে ৮ হাজার ৬০০ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, সে বিষয়ে তিনি পুলিশকে স্ক্রিনশট সরবরাহ করলেও প্রতারণার শিকার ব্যক্তির নাম বা কোন নম্বর থেকে অর্থ লেনদেন হয়েছে, সে তথ্য স্পষ্ট করেননি। তবে উপজেলা প্রশাসন কর্ণফুলী ফেসবুক আইডি থেকে জানানো হয় যে, ‘বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে অর্থ দাবি করা হচ্ছে,’ অথচ স্ক্রিনশট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রতারক চক্র ইতোমধ্যেই অর্থ আত্মসাৎ করেছে।
এছাড়া, ফরিদপুর জেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) নিশাত ফারাবী ৪ মার্চ চরভদ্রাসন থানায় সতর্কতামূলক সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন, আর কর্ণফুলী ইউএনও মাসুমা জান্নাত ৫ মার্চ চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানায় জিডি করেন। এতে স্পষ্ট, চরভদ্রাসনের এসিল্যান্ড নিশাত ফারাবী আগে জিডি করেছেন, যা ঘটনার গুরুত্ব ও প্রতারক চক্রের কার্যকলাপ সম্পর্কে আগাম সতর্কতার ইঙ্গিত দেয়।
তদন্ত কর্মকর্তা, পুলিশের ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট ও বিকাশ কর্মকর্তা
ফরিদপুর জেলার চরভদ্রাসন থানার সাধারণ ডায়েরি (জিডি) তদন্ত কর্মকর্তা এসআই খয়বর রহমান জানান, ‘এসিল্যান্ডের করা জিডির কপি এখনো আমার হাতে আসেনি। আমি বিষয়টি খতিয়ে দেখছি, তারপর বিস্তারিত জানাতে পারব।’ তবে একজন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট জিডি করার পরও থানার পক্ষ থেকে বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলেই মনে হচ্ছে, অন্তত এসআইয়ের বক্তব্য থেকে এমনটাই ইঙ্গিত মিলে।
অন্যদিকে, কর্ণফুলী থানায় ইউএনও মাসুমা জান্নাতের করা জিডির তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘ইউএনও স্যারের করা সাধারণ ডায়েরিটি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে, খুব শিগগিরই প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।’
বাংলাদেশ পুলিশের ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিশেষ শাখা কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের ইন্সপেক্টর মো. আফতাব হোসেন বলেন, ‘এ ধরনের প্রতারক চক্র সাধারণত অন্য জেলার কারো নামে নিবন্ধিত সিম ব্যবহার করে অপরাধ করে। ফলে তাদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে ভুক্তভোগীরা যদি সংশ্লিষ্ট মোবাইল অপারেটরের কাস্টমার কেয়ারে গিয়ে ওই সিমটি আনরেজিস্টার করে দেয়, তাহলে প্রতারকদের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে।’
বিকাশ প্রতারণা নিয়ে বিকাশ কাস্টমার কেয়ারের এক্সিকিউটিভ অফিসার তানিয়া আহমেদ বলেন, ‘গ্রাহকদের সুরক্ষা ও প্রতারণা এড়াতে বিকাশ সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করছে। সচেতনতাই প্রতারণা প্রতিরোধের প্রধান হাতিয়ার।’
এসিল্যান্ডের মন্তব্য
চরভদ্রাসন উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) নিশাত ফারাবী জানান, ‘আমার সহকর্মীদের মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পেরেই দ্রুত থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছি। আমার ডাক নাম অন্তরা। সহকর্মীরা ওই ফেসবুক প্রোফাইলের বিরুদ্ধে রিপোর্টও করেছেন। তবে ভবিষ্যতে যেন কেউ প্রতারিত না হন, সে জন্যই আমি সতর্কতামূলকভাবে জিডি করেছি।’
এদিকে, কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাসুমা জান্নাতের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
সার সংক্ষেপে মন্তব্য
এই প্রতারণার ঘটনায় কর্ণফুলী ইউএনও মাসুমা জান্নাত ও চরভদ্রাসনের এসিল্যান্ড নিশাত ফারাবী উভয়েই প্রতারকদের শিকার হয়েছেন। প্রতারক চক্র তাদের নাম, ছবি ও পদবী ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছে এবং অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে।
তবে প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধানে প্রতারকদের অবস্থান অনেকটাই স্পষ্ট হয়েছে। এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। এছাড়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি, যাতে কেউ অযথা প্রতারণার শিকার না হন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্রুত পদক্ষেপ নিলে হয়তো প্রতারক চক্রের মূলহোতাকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।