হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর

ইলমে নবভী চর্চার প্রাণকেন্দ্র কওমী মাদ্রাসা। দারুল উলুম দেওবন্দের শাখা-প্রশাখা হিসেবে বিস্তৃতি লাভ করে অসংখ্য কওমী মাদ্রাসা বিশ্বময় সহীহ দ্বীনি শিক্ষা বিস্তার ও ইসলামী তাহযীব- তামাদ্দুনের বিকাশে অসামান্য অবদান রেখে চলেছে। কুরআন-হাদীসের শিক্ষাদান ও গ্রহন কওমী শিক্ষক-শিক্ষির্থীদের মৌলিক কর্মসূচী। তাই তাঁরা মহানবী স.এর হাদীসের আলোকে উচ্চতর মর্যাদার আসনে অভিষিক্ত। রাসুল স.ইরশাদ করেন,”তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ওই ব্যক্তি যে কুরআন মজিদ শিক্ষা করে এবং শিক্ষা দেয়।” এর চেয়ে বড় স্বীকৃতি আর কি হতে পারে! সুতরাং কওমী শিক্ষাধারায় যুক্তদের মর্যাদাপ্রাপ্তির জন্য জাগতিক কোন স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই! বরং কওমী শিক্ষা সনদের স্বীকৃতিদাতাই এতে ধন্য হবে। ঐতিহ্যবাহী এ শিক্ষাধারা আবহমানকাল ধরে সন্তানদের ঈমানদার,আদর্শ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এবং সমাজে নৈতিক আবহ সৃষ্টির মাধ্যমে শান্তি-শৃংখলা বজায় রাখতে নিরবচ্ছিন্নভাবে ভূমিকা পালন করে আসছে। তথাপি নিরক্ষকরতা দূরীকরণেও কওমী শিক্ষাধারা সরকারের জন্য বড় সহায়ক দিক। সরকারীভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখতে কওমী শিক্ষক-ছাত্রগণ সক্ষম। এ পবিত্র শিক্ষাধারার সনদের স্বীকৃতি দেয়া সরকারের নৈতিক দায়িত্ব;করুণা নয়। আর স্বীকৃতি পাওয়া কওমী পড়ুয়াদের ন্যায্য অধিকার। তবে এ স্বীকৃতি হতে হবে দারুল উলুম দেওবন্দের নীতি-আদর্শের ভিত্তিতে। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসমাজ এমন দাবীতে আশির দশক থেকে নিরলস আন্দোলন করে আসছে। সুদীর্ঘ ৩০-৩৫বছর ধরে ধারাবাহিক এ আন্দোলনের ইতিহাস কওমী প্রজন্মের জানা দরকার। ১৯৮৪সালে জনাব আ.ফ.ম খালিদ হোসেন (ড. আ.ফ.ম খালিদ হোসেন) ইসলামী ছাত্রসমাজের কেন্দ্রীয় সভাপতি থাকাবস্থায় একটি লিফলেট প্রকাশের মাধ্যমে সর্বপ্রথম এ দাবী পেশ করা হয়। তিনি নিজেই এটি সম্পাদনা করেন। সে লিফলেট ১৯৮৫ সালে বারিধারায় অনুষ্ঠিত কওমী মাদ্রাসা সমূহের জাতীয় সম্মেলনে প্রচার করা হয়েছিল তখনকার কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা আ.হ.ম নুরুল কবির হিলালীর নেতৃত্বে। এতে যে ইয়াহয়া মাহমুদ বাধা দিয়েছিলেন তিনিই আজ কওমী সনদের স্বীকৃতি বাস্তবায়ন পরিষদের সদস্য সচিব সেজে মায়া কান্না করছেন…! শ্রদ্ধেয় ড.আ.ফ.ম খালিদ হোসেন ও অপর কেন্দ্রীয় নেতা অধ্যাপক শেখ লোকমান হোসেন সে ঘটনার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী। ইতিহাস কথা বলে। এত বিপদ-বাধার পরও স্তব্ধ হয়ে যায়নি আন্দোলন। অবিরাম পথ চলেছে হেরার জ্যোতির এ কাফেলা।

কওমী মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদীসের সনদকে এম.এ.এর সমমর্যাদা প্রদানের সংগ্রামকে জোরদার করুন- শিরোনামে ১৯৮৪ সালে ইসলামী ছাত্রসমাজ কর্তৃক প্রকাশিত সে ঐতিহাসিক লিফলেটটি আজ ইতিহাসের মূল্যবান দলিল। সে লিফলেটই কওমী শিক্ষা সনদের সরকারী স্বীকৃতি দাবীর প্রথম রেফারেন্স ও মাইল ফলক। সংগঠনের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ড.আ.ফ. ম খালিদ হোসেন স্বীকৃতি প্রসঙ্গে সম্প্রতি এক প্রবন্ধে লিখেছেন,” ছাত্র জীবন থেকে আমি কওমী সনদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির আন্দোলনে যুক্ত ছিলাম। আমরাই সর্বপ্রথম একটি লিফলেট বের করে এ ব্যাপারে জনমত গঠনের চেষ্টা করি। সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি বাংলাদেশ কওমী শিক্ষক ফেডারেশনের সভাপতি মাওলানা আব্দুল মাজেদ আতহারী বলেন,” কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা সনদের সরকারী স্বীকৃতির দাবীতে সর্বপ্রথম ইসলামী ছাত্রসমাজ যে আওয়াজ তুলেছিল তা আজ গণদাবীতে রূপ নিয়েছে। এটি ইসলামী ছাত্রসমাজের সাফল্যের সোনারাঙ্গা মাইল ফলক।

“১৯৯৫ সালের ৮ অক্টোবর বিভিন্ন দাবীতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সমীপে স্মারকলিপি পেশ করে ইসলামী ছাত্রসমাজ। সেখানে কওমী সনদের স্বীকৃতি প্রদান অন্যতম। ওই সময় কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন জনাব আব্দুল খালেক নিজামী। এই দাবীতে ২০০২সালের ২৬সেপ্টেম্বর হাটহাজারী উপজেলা শাখা কর্মী সম্মেলন করে। তৎকালীন মাননীয় হুইফ সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম প্রধান অতিথি ছিলেন। ২০০৫সালের ২৯এপ্রিল চট্টগ্রাম মহানগর শাখা ছাত্র সমাবেশ ও মিছিল করে। কেন্দ্রীয় সভাপতি আজিজুল হক ইসলামাবাদী এতে প্রধান অতিথি ছিলেন। একই বছর ১১মে আমরা কক্সবাজার জেলা শাখা কর্তৃক পাবলিক হলে বর্ণাঢ্য কর্মী সম্মেলন করি। তখনকার যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী সালাহ উদ্দিন আহমদ এমপি প্রধান অতিথি ছিলেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় সভাপতি অধ্যাপক আ.ফ.ম খালিদ হোসেন, চট্টগ্রাম মহানগর নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি আব্দুর রহমান চৌধুরী। প্রধান বক্তা ছিলেন, তখনকার কেন্দ্রীয় সভাপতি মুহাম্মদ আজিজুল হক ইসলামাবাদী। এ কর্মী সম্মেলন উদ্বোধন করেন, কক্সবাজার জেলা নেজামে ইসলাম পাটির সভাপতি মাওলানা হাফেজ ছালামতুল্লাহ। সভাপতিত্ব করেন, সংগঠনের জেলা সভাপতি এম নুরুল হক চকোরী। জেলা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমি সঞ্চালনায় ছিলাম। সে বছর একই দাবীতে আমরা কক্সবাজারে প্রথমবারের মতো কওমী মাদ্রাসা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারেও বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করি। ২০০৫সালের ১৭ এপ্রিল আমাকে আহবায়ক ও ইসলামী ছাত্রসমাজ রামু সভাপতি হাফেজ আতাউল্লাহকে সদস্য সচিব করে এ পরিষদের জেলা কমিটি গঠিত হয়। সে বছর আগষ্টের শেষে পূর্ণাঙ্গ কমিটি হলে আমাকে সভাপতি ও হাফেজ শামসুল হুদাকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। ৮ডিসেম্বর ২০০৫এ উক্ত পরিষদের উদ্যোগে কক্সবাজার শহরে লালদীঘির পশ্চিম পাড়ে ছাত্রসমাবেশ ও মিছিল করা হয়। ২০০৬সালের ১৭আগষ্ট চট্টগ্রাম নেজামে ইসলাম পাটি ঐতিহাসিক লালদীঘি চত্বরে সমাবেশ ও রাজপথে মিছিল করে। এ বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর ইসলামী ছাত্রসমাজের ৩৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কক্সবাজার জেলা শাখার প্রীতি সম্মেলনেও কওমী সনদের সরকারী স্বীকৃতি কার্যকরের জোর দাবী জানানো হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় সভাপতি ড.আ.ফ.ম খালিদ হোসেন। প্রধান বক্তা ছিলেন, তখনকার কেন্দ্রীয় সভাপতি মুহাম্মদ আজিজুল হক ইসলামাবাদী। উদ্বোধন করেন, সাবেক কেন্দ্রীয় সংগঠন সচিব মাওলানা ইয়াছিন হাবিব। বিশেষ অতিথি ছিলেন, সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক রেজাউল করিম ছিদ্দিকী। ২০০৯সালের ৭ ডিসেম্বর ইসলাম বিরোধী শিক্ষানীতি বাতিল ও কওমী সনদের স্বীকৃতির দাবীতে কক্সবাজার জেলা শাখা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী বরাবরে স্মারকলিপি পেশ করে। এভাবে সুদীর্ঘ ৩০-৩৫বছর ধরে কওমী সনদের সরকারী স্বীকৃতি দাবীতে নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে ইসলামী ছাত্রসমাজ অসংখ্য কর্মসূচী বাস্তাবায়ন করেছে। যা ইতিহাসের পাতায় সমুজ্জ্বল হয়ে থাকবে।

লেখক:

সভাপতি

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসমাজ

কক্সবাজার জেলা।

তারিখঃ ১১-০৪-২০১৭ইংরেজী।

ই-মেইলঃ যধভবুধনঁষসধহুঁৎ@মসধরষ.পড়স