-এডভোকেট ফখরুল ইসলাম গুন্দু :
আজ আমাদের বাংলা নববর্ষ । পুরানো দিনের সব ভেদাভেদ ভুলে আমরা বরন করে নেবো নতুন বছরকে। আজকের দিনটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন উৎসব। বিশ্বের সকল প্রান্তের সকল বাঙালি এ দিনে নতুন বছরকে বরন করে নেবেন। ভুলে যাবার চেষ্টা করবেন অতীত বছরের সকল দুঃখ গ্লানি। আজকের এ দিন থেকে সবার কামনা থাকবে যেনো বছরটি সমৃদ্ধ ও সুখময় হয়। আজকের এই দিনে সারা বাংলার ক্ষুদে- মাঝারি ব্যবসায়ীরা খুলবেন হালখাতা। পল্লীর হাট-বাজারের ব্যবসায়ীরা ক্রেতা খদ্দেরদের মিষ্টি মুখ করাবেন, বাংলার ঘরে ঘরে আনন্দ উৎসব, ভাল খাবার পিঠে পায়েশ তো থাকবেই।
আমাদের এই সুন্দর দিনটি একটি কু-চক্রী মহল নষ্ট করে দিতে মেতে উঠেছে। বাঙালির এই আনন্দময় দিনটি নিয়েও চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে। যার যেমন ইচ্ছে, সাধ্যমত আনন্দ, উল্লাস করে দিনটি যাপন করবেন এটাই স্বাভাবিক। বর্ষবরনের সাথে ধর্মের তো কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। অথচ বছরের একটি সুন্দর দিনকে নিয়েও ধর্ম ব্যবসায়ীরা মাতামাতি করে যাচ্ছে। আমাদের জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নববর্ষ উৎসবকে দেশের ঐতিহ্য হিসেবে অবিহিত করে বলেছেন, বাংলা নববর্ষ পালন ও ধর্মের মধ্যে কোনো যোগসূত্র নেই। এই উৎসব হচ্ছে আমাদের সাংস্কৃতির ঐতিহ্য। এটা আদিকাল থেকে চলে আসছে। যারা এই উৎসবকে নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে তাদের ব্যপারে দেশবাসীকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
আজ আমাদের কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় বর্ষবরন হচ্ছে। সমুদ্র সৈকতে পর্যটকদের মিলন মেলা পরিনত হয়েছে।
নতুন বছরের উৎসবের সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগ। গ্রামে মানুষ ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, নতুন জামাকাপড় পড়ে এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যাবেন। বাড়িঘর পরিষ্কার করা হয় এবং মোটামুটি সুন্দর করে সাজানো হয়। বিশেষ খাবারের ব্যবস্থাও থাকে। কয়েকটি গ্রামের মিলিত এলাকয়, কোন খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার। মেলাতে থাকে নানা রকম কুঠির শিল্পজাত সামগ্রীর বিপণন, থাকে নানারকম পিঠা পুলির আয়োজন। এই দিনের একটি পুরনো সংস্কৃতি হলো গ্রামীন ক্রীড়া প্রতিযোগীতার আয়োজন। এর মধ্যে থাকে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা কিংবা কুস্তির। বাংলাদেশে এরকম কুস্তির সবচেয়ে বড় আসরটি হয় ১২ বৈশাখ, চট্টগ্রাম- এর লালদিঘী ময়দান- এ। এটি জব্বারের বলি খেলা নামে পরিচিত।
বন্দরনগরী চট্রগ্রামে পহেলা বৈশাখের উৎসবের কেন্দ্র ডিসি পাহাড় পার্ক। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে পুরোনো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে বরণ করার দুই দিনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। মুক্ত মঞ্চে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি থাকবে নানা গ্রামীন পন্যের পশরা। থাকে পান্তা ইলিশের ব্যবস্থাও। চট্রগ্রামে সম্মিলিতভাবে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের উদ্যোগ ১৯৭৩, ১৯৭৪ ও ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিকগণের চেষ্টায়। ইস্পাহানী পাহাড়ের পাদদেশে এই অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। ১৯৭৮ সালে এই উৎসব এখনকার ডিসি হল পার্কে সরিয়ে নেওয়া হয়। ১৯৭৮ সালের উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ওয়াহিদুল হক, নির্মল মিত্র, মিহির নন্দী, অরুন দাশ গুপ্ত, আবুল মোমেন, সুভাষ দে প্রমুখ। প্রথম দিকে প্রত্যেক সংগঠন থেকে দুইজন করে নিয়ে স্কোয়াড গঠন করা হত। সেই স্কোয়াডই সম্মিলিত সঙ্গীত পরিবেশন করতো। ১৯৮০ সাল থেকে সংগঠনগুলো আলাদাভাবে গান পরিবেশন শুরু করে। পরে গ্রুপ থিয়েটার সমন্বয় পরিষদ যুক্ত হওয়ার পর অনুষ্ঠানে নাটক ও যুক্ত হয়েছে। নগরীর অন্যান্য নিয়মিত আয়োজনের মধ্যে রয়েছে শিশু সংগঠন ফুলকীর উৎসব। নারীর মহিলা সমিতি একটি বর্ষবরণ মেলা আয়োজন করে থাকে।
পার্বত্য জেলার আদিবাসীদের বর্ষবরণ আরো চমৎকার। পার্বত্য চট্রগ্রাম এলাকার প্রধান তিনটি ক্ষুদ্রজাতিস্বত্তা রয়েছে, যাদের প্রত্যেকেরই বছরের নতুন দিনে উৎসব আছে। ত্রিপুরাদের বৈশুখ, মারমাদের সাংগ্রাই ও চাকমাাদের বিজু উৎসব। সব মিলিয়ে বৈ-সা-বি। চৈত্র মাসের শেষ প্রান্তে পহেলা বৈশাখ বর্ষবরণ। এই বর্ষবরনকে পাহাড়ি আদিবাসীদের চৈত্র-সংক্রান্তি বিজু উৎসব। এ বিজু বৈসব- সাংগ্রাই বা বৈ-সা-বি পাহাড়ি আদিবাসী জাতীয় জীবনের প্রতিচ্ছবি। পাহাড়ী অঞ্চলের আদিবাসীরা এই অনুষ্ঠানকে জাঁক-জমকভাবে পালন করে। পাহাড়ী আদিবাসীদের এটাই প্রধান উৎসব। আদিবাসীরা এই উৎসবকে তিন ভাগে ভাগ করে নেয়। যেমনঃ ফল বিজু, মুল বিজু ও গজ্যাপয্যা দিন(খেয়ে ঘুমানো) ফুল বিজু হচ্ছে – চৈত্র মাসের ২৯ তারিখ। মুল বিজু হচ্ছে চৈত্র মাসের ৩০ তারিখ। গজ্যাপয্যা নববর্ষ।
লেখকঃ আইনজীবি, রাজনীতিক, মুক্ত সাংবাদিক, গবেষক ও গ্রন্থাকার
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।