শিক্ষাবিদ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহঃ

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ত্বাধীন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ‘ভিশন ২০২১’ ঘোষণা করে ২০০৮ সালে সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের অন্যতম জনপ্রিয় ভিশন বা রূপকল্প ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা। অনেকেই তখন এ ঘোষণাকে শস্তা শ্লোগান বলে অভিহিত করার প্রয়াস চালান। কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ ২০১৭ সালে এসে একটি বাস্তবতা।

এটি স্বপ্নচূড়ায় পৌঁছার কল্পলোক নয়, আর। বাস্তবতার সাথে সত্যের মিতালী। বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের সেতুবন্ধন।  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি, ভারতের বাঙ্গালুর বা দক্ষিণ কোরিয়ার গিগা আইল্যান্ডের মত বেশকটি আইটি পার্ক পেতে যাচ্ছি আমরা বাংলাদেশে। ডিজিটাল আইল্যান্ড ইমজার মত মহেশখালী ডিজিটাল আইল্যান্ড প্রকল্পটি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অন্যতম সাফল্য সোপান।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের তিনটি বিভাগ যথা- নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইন বিভাগের সব দপ্তর এখন ডিজিটালাইজড। এর নেপথ্যে আছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুযোগ্য পুত্র মাননীয় তথ্য উপদেষ্টা সজিব ওয়াজেদ জয়। আর তাঁর নিত্যসঙ্গী হিসেবে আছেন তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট জুনায়েদ আহমদ পলক । আল্লাহ তায়ালা সজিব ওয়াজেদ জয় এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দীর্ঘজীবী করুন, এই দোয়া করে মহেশখালীবাসী।

আজ ২৭ এপ্রিল/২০১৭ বৃহস্পতিবার এ প্রকল্পটি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হল।  মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কন্ফারেন্সের মাধ্যমে এর শুভ উদ্বোধন করলেন।  আমরা কক্সবাজারবাসী পেতে যাচ্ছি, একটি গিগা আইল্যান্ড ইমজা, যার অপর নাম মহেশখালী ডিজিটাল আইল্যান্ড। যাহোক, আমি এখানে প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে তথ্য-প্রযুক্তি বা মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে শ্রেণি শিখন-শেখানো কার্যক্রম নিয়ে আলোকপাত করব।

বাংলাদেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শ্রেণি পাঠদান কার্যক্রমে তথ্য-প্রযুক্তি ভিত্তিক কলা-কৌশল প্রয়োগ চলছে বিগত ৬/৭ বছর ধরে। বিশেষত: প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে সারাদেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষক আইসিটি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ও নিজস্ব প্রচেষ্টায় শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। আর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রত্যকটিতে মাল্টিমিডিয়া বিতরণ করা হচ্ছে। চলতি অর্থ বছর ২০১৬-১৭ এবং ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে হয়ত ৬৪ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সবকটিতে ল্যাপটপ, প্রজেক্টর ও স্ক্রিন পৌঁছে যাবে।

আর প্রত্যেক বিদ্যালয়ে অন্তত: ৪ জন করে শিক্ষক/শিক্ষিকা আইসিটি প্রশিক্ষণ পেয়ে যাবেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকগনকে উৎসাহিত করতে সরকারিভাবে শিক্ষক বাতায়ন কোলা হয়েছে। শিক্ষকগণ এ ওয়েবসাইটে হাজার হাজার ভিডিও আপলোড করে রেখেছেন। দেশ-বিদেশে যে কোন প্রান্তে এ ভিডিওগুলো সংগ্রহ ও ব্যবহার করা যায়।এভাবে চলতে থাকলে, আগামী ৫ বছরের মধ্যে শিক্ষাঙ্গনে ডিজিটাল কন্টেন্ট ব্যবহার করে শ্রেণি পাঠদানের ক্ষেতে একটি মহা বিল্পব সাধিত হবে। আর শিক্ষার মানে আন্তর্জাতিকতার ছোঁয়া লেগে সোনার বাংলায় সোনার মানুষ দলে দলে তৈরি হয়ে যাবে। নতুন প্রজন্ম হয়ে যাবে বিশ্ব মানের উন্নত শিক্ষায় শিক্ষিত মানব সম্পদ। সেদিনের অপেক্ষায় আমরা সবাই অপেক্ষমান।

মহেশখালীর প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় আইসিটি-এর প্রয়োগ: বর্তমানে মহেশখালী উপজেলায় ৬৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। বিদ্যালয়বিহীন গ্রামে আরও ৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে তোলা হচ্ছে। এগুলো নির্মাণাধীন। আগামী বছরের শুরুতে এগুলোতে শ্রেণি পাঠদান কাজ শুরু হবে। মোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্রালয়ের সংখ্যা হবে ৭১ টি। আরও ১০ টি গ্রামে নতুন বিদ্যালয় স্থাপন করার প্রক্রিয়া চলছে।

এখানকার ২৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া প্রদান করা হয়েছে। কর্মরত ৪০০ জন শিক্ষক শিক্ষকার মধ্যে ১২০ জন মত শিক্ষক/শিক্ষিকা আইসিটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন।বিদ্যুৎ বিভ্রাট এবং ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়া যায়না বলে শ্রেণি পাঠদান কার্যক্রম পুরোপুরি চালিয়ে যাওয়া কষ্টকর হচ্ছে।

বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নত হলে এবং ডিজিটাল আইল্যান্ড মহেশখালী প্রকর্পের আওতায় উচ্চগতিসম্পন্ন ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপিত হলে মহেশখালী প্রত্যেক বিদ্যালয়ে ডিজিটাল কন্টেন্ট ব্যবহার করে শ্রেণি পাঠদান কার্যক্রম চালু করা যাবে। পাল্টে যাবে প্রাথমিক শিক্ষা চিত্র। সকল শিশুর মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ নিশ্চিত হবে, এত কোন সন্দেহ নেই।

মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার ও সনাতন পদ্ধতিতে শ্রেণি পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনার পার্থক্যসমূহ:

সনাতন পদ্ধতিতে পাঠদান ডিজিটাল পদ্ধতিতে পাঠদান

-ব্লাক বোর্ড  বা হোয়াইট বোর্ড এবং  চক-ডাস্টার ব্যবহার করে  পাঠদান চলে।

-লেপটপ, প্রজেক্টর  ও স্ক্রিন ব্যবহার করে  পাঠদান করা হয়।

-বই দেখে দেখে  পাঠদান করা হয়।

-ভিডিও চিত্র  বা পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টশনের  মাধ্যমে পাঠদান করা হয়।

-সাধারণ উপকরণ  ব্যবহার হয়।

-ভিডিও ভিত্তিক  বাস্তব উপকরণ প্রদর্শন  করা হয়্।

-বেশিরভাগ শিশুর  শিখন ফল বা যোগ্যতা  অর্জন হয় না।

-প্রত্যেক শিশুর  শিখন অনেকটা নিশ্চিত  হয়।

-শিক্ষক কেন্দ্রিক  শিখন-শেখানো চলে।

-শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক  পাঠদান চলে।

-সনাতনী পড়াশোনা  বা শিখন-শেখানার চর্চা  করা হয়ে থাকে।

-আধুনিক ধ্যান-ধারণার  আলোকে শ্রেণি শিখন-শেখানো  চলে।

-যোগ্যতা ভিত্তিক  প্রাথমিক শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন  করা পুরোপুরি সম্ভবপর  হয় না।

-তথ্য-প্রযুক্তির  ব্যবহার কাজটি অনেকটা  সহজতর করে তোলে।

-সংশ্লিষ্ট পাঠের  বিষয়বস্তু ও শিখন ফল  শিক্ষার্থীরা ভালভাবে  আয়ত্ত্ব করতে পারে না।

-মাল্টিমিডিয়া  ব্যবহার করে শ্রেণি পাঠদান  করা হলে, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর  শিখন ভালভাবে হয়।

-শিক্ষার্থীরা  তেমন আনন্দ পায় না।

-প্রত্যেক শিক্ষার্থী  তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার  করা হলে আনন্দ পায় এবং  ভালভাবে শেখার আগ্রহ  পায়।

-শ্রেণিকক্ষে  আনন্দমুখর ও স্থায়ি শিখন  ফল অর্জিত হয় না তেমন।

-মাল্টিমিডিয়া  ব্যবহারের ফলে শ্রেণিকক্ষে  শিখন-শেখানো আনন্দমুখর  হয় ও স্থায়ি শিখন ফল  অর্জিত হয়।

-শিশুদেরকে বিজ্ঞান  মনস্ক করে গড়ে তোলা  অসম্ভবপর।

-তথ্য-প্রযুক্তি  ব্যবহারে শিশুরা বিজ্ঞান  মনস্ক হয়ে ওঠার সুযোগ  পায়।

সর্বেপরি বলা যায়, সনাতন পদ্ধতির শিখন-শেখানো এবং মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে পাঠদানের মাঝে ব্যাপক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। বিশ্বব্যাপি শিখন-শেখানা এবং মূল্যায়ন পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্নতন সাধিত হয়ে গেছে। পাশের দেশ ভারত-শ্রীলংকায় অনেক আগেই শিক্ষা ব্যবস্থায় তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার শুর করা হয়। এশীয় দেশগুলোর মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়া সবচেয়ে সাফল্য পেয়েছ।

  আর সারাবিশ্বে ফিনল্যান্ড প্রাথমিক শিক্ষায় শীর্ষে অবস্থান করছে। সেদিন বেশি দূরে নয়, একদিন বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষাও দেখিয়ে দেবে আমরাও পারি। আর মহেশখালী উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা আগামী ৪/৫ বছরে দেশে এক নম্বর অবস্থানে চলে যাবে, এটাই কাম্য।

*মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ্; উপজেলা শিক্ষা অফিসার,

মহেশখালী, কক্সবাজার