ধর্মান্তরিত হয়ে জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদে জড়িয়েছে এমন তরুণদের সংখ্যা বাড়ছেই। এসব তরুণ নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) ও নব্য জেএমবিতে জড়াচ্ছে। নিজেদের বাসাবাড়িতেই গড়ে তুলছে জঙ্গি আস্তানা। বোমা বানানোসহ নিচ্ছে সামরিক প্রশিক্ষণও। কেউ আবার পরিবার নিয়ে দেশের বাইরে হিজরতে। এভাবে ধর্মান্তরিত হয়ে উগ্রবাদের জড়িয়ে যাওয়ার বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত যারা ইসলাম সম্পর্কে কম জানে এবং গরিব তাদের টার্গেট করে জঙ্গি বানানোর প্রক্রিয়ার অংশ এটি।

গত শুক্রবার ঝিনাইদহ সদর উপজেলার পোড়াহাটি গ্রামের ঠনঠনেপাড়ার একটি বাড়িতে জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। পরবর্তীতে পুলিশ জানতে পারে বাড়িটি ধর্মান্তরিত এক জঙ্গির। যার প্রকৃত নাম প্রভাত কুমার। ধর্মান্তরিত হয়ে তার নাম হয় আব্দুল্লাহ। পাঁচ বছর আগে সে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করে। টিনের বেড়া দিয়ে ঘেরা ওই বাড়িটিতে সে জঙ্গি আস্তানা হিসাবে গড়ে তুলেছে। পুলিশের ধারণা, বাড়িটিতে বোমা তৈরি করা হতো। সে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) সদস্য। ঠনঠনে পাড়ায় বসবাস করলেও এলাকাবাসীর সঙ্গে তার খুব একটা সম্পর্ক ছিল না। তার বাবার নাম চৈতন্য বাউতি। মা সন্ধ্যা রানী। আবদুল্লাহরা তিন ভাই। আবদুল্লাহ তিনটি বিয়ে করেছে। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর পরিবারের সদস্যরা তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়। তখন সে একজন মুসলিম নারীকে বিয়ে করে।

সিটিটিসি’রঅভিযানের সময় আব্দুল্লাহ বাড়িতে ছিল না। সে আগেই তার স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে যায়।পরবর্তীতে তার বাড়ি থেকে থেকে ২০ ড্রাম হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, ১০০ প্যাকেট লোহার বল, ৩টি সুইসাইডাল ভেস্ট, ৯টি সুইসাইডাল বেল্ট, বিপুল পরিমাণ ইলেকট্রিক সার্কিট, ১৫ টি জিহাদি বই, ১টি বিদেশি পিস্তল, ১টি ম্যাগাজিন, ৭ রাউন্ড গুলি, ১টি মোটরসাইকেল, ১টি চাপাতি, বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক, ৬টি শক্তিশালী বোমা উদ্ধার করে। এর মধ্যে ৩টি সুইসাইডাল ভেস্ট ও ২ টি বোমা নিষ্ক্রিয় করা হয়।

গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর ফিরে আসার আহ্বান জনিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যে ১০ যুবকের ছবিসহ গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। তার মধ্যে একজনের নাম সাইফুল্লাহ ওজাকি। পরবর্তীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানতে পারে, নবীনগর উপজেলার কড়ইবাড়ি গ্রামের জনার্দন দেবনাথের ছেলে সুজিত কুমার দেবনাথই সাইফুল্লাহ ওজাকি। ছাত্রজীবনে সে বৃত্তি পেয়ে জাপানে পড়ালেখা করতে যায়। সেখানে লেখাপড়া শেষ করে অধ্যাপনা শুরু করে। এরপর বিয়েও করে জাপানে। সুজিতের তিন ছেলে ও এক মেয়ে। সে দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ। ঢাকার উত্তরা পশ্চিম থানার সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়ের করা একটি মামলার আসামি সাইফুল্লাহ ওজাকি (মামলা নং ২৩, তারিখ: ২৪/৫/১৫ ইং)। গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার পর নিখোঁজ হিসেবে তার নাম প্রকাশিত হয়।

সাইফুল্লাহ ওজাকির বাবা জনার্ধন দেবনাথ পেশায় একজন কাপড় ব্যবসায়ী। বাজারে বাজারে ফেরি করে কাপড় বিক্রি করে খুব কষ্টের মধ্য দিয়ে ছেলে মেয়েদের মানুষ করেছেন। বর্তমানে জিনদপুর বাজারে দোকান করে প্রতিষ্ঠিত একজন কাপড় ব্যবসায়ী। জিনদপুর বাজারে স্থায়ী দোকান খোলার আগে বিভিন্ন হাটে ঘুরে ঘুরে কাপড় বিক্রি করতেন তিনি। সুজিত ওরফে সাইফুল্লাহর মা অনিতা রানী দেবী। কানাডাভিত্তিক বেঙ্গল টাইমস নামে একটি অনলাইন পত্রিকায় গত বছরের ২৩ জুলাই সংবাদ প্রকাশ করে যার শিরোনাম ‘ধর্মান্তরিত হয়ে সপরিবারে আইএসে সাইফুল্লাহ ওজাকি’। অনলাইন দ্য জাপান টাইমস এর বরাত দিয়ে প্রকাশ করা ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ইউরোপ হয়ে সিরিয়া পাড়ি দিয়েছে সাইফুল্লাহ ওজাকি।’

চট্টগ্রামে নিখোঁজ যুবক ঝুলন দেবনাথ নগরীর দক্ষিণ কাট্টলী পশ্চিম পাড়ার বড় হাতিয়া গ্রামের বাসিন্দা। প্রায় এক বছর আগে সে ধর্মান্তরিত হয়। ২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে ঝুলন নিখোঁজ থাকলেও তার বাবা খগেন্দ্র দেবনাথ গতবছরের জুলাইয়ে পাহাড়তলী থানায় জিডি করেন। জিডিতে তিনি উল্লেখ করেন, দেশবিরোধী কোনও কাজে ঝুলন জড়িত হলে সে জন্য পরিবার দায়ী থাকবে না। ২০১৫ সালের ২৫ মে তার স্ত্রীর দায়ের করা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলায় জেলও খাটে ঝুলন। জেল থেকে বের হয়ে ২০১৫ সালের ২ নভেম্বর নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে ধর্মান্তরিত হয় ঝুলন, নিজের নাম রাখে মুহাম্মদ ইব্রাহিম। খগেন্দ্র জানান, তারপর থেকে ঝুলনের আর কোনও সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।

একইভাবে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার সেলুন মালিক উজ্জ্বল কান্তি নাথ দুই বছরের বেশি সময় ধরে নিখোঁজ বলে জানিয়েছে তার পরিবার। এই ঘটনায় গত বছর চট্টগ্রামের আকবর শাহ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করে তার পরিবার। জিডিতে তার ভাই কাজল কান্তিনাথ উল্লেখ করেন, ২০১৫ সালের ১০ জুন উজ্জ্বল নিখোঁজ হয়।

তার ভাই কাজল কান্তি নাথ জিডিতে আরও উল্লেখ করেন, চট্টগ্রামের আকবর শাহ থানার বিশ্বব্যাংক কলোনির বি-ব্লক ও মসজিদ এলাকা এবং ফিরোজশাহ কলোনি এলাকায় উজ্জ্বলের তিনটি সেলুন আছে। তিনি ২০১৫ সালের বছরের জুনে দোকান থেকে কিছু সময়ের কথা বলে বেরিয়ে যায়, আর ফেরেননি। অনেক খুঁজেও উজ্জ্বলকে না পেয়ে ১০ জুন জিডি করেন তিনি। তার আগে উজ্জ্বল ধর্মান্তরিত হয়। তবে ধর্মান্তরিত হয়ে উজ্জ্বল কী নাম গ্রহণ করেছে তার কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি।

 

চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ছনহরা ইউনিয়নের মহাজনবাড়ির অরুণ কান্তি দাশের পুত্র পিকলু দাশ। তার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়ার ছনহরা গ্রাম। নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনে যোগ দিয়ে নাম গ্রহণ করে মুসায়াব ইবনে উমায়ের। সে পোশাক প্রস্তুককারক প্রতিষ্ঠান ইয়াং ওয়ানে চাকরি করলেও আড়ালে যুক্ত ছিল জঙ্গি সংগঠন এবিটির সঙ্গে। হিন্দু থাকাবস্থায় জঙ্গি উমায়ের তার কলেজের এক মুসলিম মেয়ের প্রেমে পড়ে ধর্মান্তরিত হয়ে জঙ্গি সংগঠনে যোগ দেয় বলে জানা গেছে।

২০১১ সালে বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার এক মাস পর তার পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে একটি ডায়েরির ১ম পাতায় লেখা ছিল, মালিক আল্লাহ। তার বাবা অরুণ কান্তি দাশ মা ঝর্না রানী দাশকে নিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর রিয়াজউদ্দীন বাজার এলাকায় থাকেন।গত বছরের জুলাইতে সীতাকুণ্ড থেকে পিকলু দাসকে এবিটির চার সহযোগীসহ গ্রেফতার করে পুলিশ। বর্তমানে সে কারাগারে রয়েছে। চট্টগ্রামে বিদেশি নাগরিকদের ওপর হামলা করার টার্গেট ছিল তাদের বলে পুলিশ জানায়।

সাতক্ষীরার আশাশুনি থানার খাড়িয়াটির উত্তরপাড়ার শ্রী গৌরাঙ্গ কুমার মন্ডল (৩২) ধর্মান্তরিত হয়ে নাম গ্রহণ করে তামিম দ্বারী ওরফে আব্দুল্লাহ হাসান ওরফে আজিজুর রহমান ওরফে আব্দুল্লাহ আল জাফরী ওরফে আমীর হামযা। তার বাবার নাম শ্রী চৈতন্য কুমার মন্ডল, মায়ের নাম রেনুকা রানী মন্ডল। ২০০৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময় সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর সে তাবলীগ জামাতের অনুসারী ছিল। সেখানেই তানভীর কবির নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এরপর তার সঙ্গে সে বাসায় যায়। তানিভীর কবিরের বাবা হুমায়ুন কবির সরকার তামিম দ্বারীকে পালক সন্তান হিসাবে গ্রহণ করে। ২০০৫ সালে সে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। সেখানে ৭/৮ মাস পড়াশোনা করার পর ২০০৬ সালে চট্টগ্রামের মেরিন একাডেমিতে ভর্তি হয়। ২০০৭ সালে পড়াশোনা শেষ করে ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের বাংলার কাকলিসহ বিভিন্ন জাহাজে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরি করে। একই জাহাজে একাডেমিক জুনিয়র আবু বক্কর নামে এক তরুণ কর্মরত ছিল। ২০১৩ সালে ‘বাংলার কাকলি’ জাহাজ নিয়ে সে পাকিস্তানে যায়। ওই সময় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন রাষ্ট্রে সহিংসতা চলছিল। এই সহিংসতা নিয়ে আবু বক্কর ও তামিম দ্বারীর কথা হয়। এ সময় আবু বক্কর তাকে জিহাদের কথা বলে। তামিম দ্বারী তখন জিহাদের বিষয়ে আগ্রহী হয়। এরপর ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে মিরপুরে জঙ্গিনেতা তামিম চৌধুরীর সঙ্গে তামিম দ্বারীর সাক্ষাত করিয়ে দেয় আবু বক্কর। ২০১৪ সালে তামিম চৌধুরী বাংলার দূত জাহাজে যায়। এসময় তামিম দ্বারী জাহাজটি ঘুরিয়ে দেখায় তামিম চৌধুরীকে। তখন তারা নৌ-পথে নাশকতার রশদ আনার পরিকল্পনা করে। নৌ-পথে কর্মরত তরুণদের আরও জঙ্গিবাদে জড়ানোর পরামর্শ দিয়ে তামীম চৌধুরী অনেকের ভুয়া পাসপোর্ট করে। ২০১৫ সালেও রাজধানীর কয়েকটি স্থানে তামীম চৌধুরীর সঙ্গে তামিম দ্বারীর বৈঠক হয়। ২০১৬ সালে সে বসুন্ধরা জাহাজ-৪ এ চাকরি নেয়। ওই বছরের মাঝামাঝি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ২০১৭ সালে সে হিজরতে বের হয়। গত বৃহস্পতিবার সাভারের একটি বাস থেকে তাকেসহ তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। তারা রাজধানীতে নাশকতার পরিকল্পনা করেছিল। এর আগেই র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়।

এদিকে, কোরআন ও হাদিসের ভুল ও বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে এসব তরুণকে জঙ্গিবাদের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘সরাসরি জান্নাতে যাওয়ার মতো ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে তাদের জঙ্গিবাদে নেওয়া হচ্ছে। যারা মূলত কোরআন হাদিস সম্পর্কে জ্ঞান কম রাখে তাদের টার্গেট করেই জঙ্গিবাদে জড়ানো হচ্ছে।’