প্রভাষ আমিন

অনেকদিন ধরেই বলাবলি হচ্ছে, ছাপা পত্রিকার ভবিষ্যৎ ফুরিয়ে আসছে। সামনে নাকি অনলাইনের ভবিষ্যৎ। আশঙ্কাটা অমূলক নয়। আমরা যারা পুরনো ঘরানার মানুষ, সকালে ছাপা পত্রিকা হাতে না নিলে দিনটা শুরুই হতে চায় না। দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করার কারণে রাতে যখন বাসায় ফিরি, দিনের সব ঘটনাই জানা থাকে। তারপরও সকালে পত্রিকা আসতে দেরি হলে বা পত্রিকা বন্ধ থাকলে অস্বস্তি লাগে। তবে আমিও জানি, আগে হোক আর পরে আশঙ্কাটা সত্যি হবে। কতদিন জানি না, একদিন পৃথিবীতে হয়তো ছাপার পত্রিকা থাকবে না। সব হয়ে যাবে অনলাইনভিত্তিক।

গত তিন দশকে ভেতর থেকে বাংলাদেশের সাংবাদিকতাকেও বদলে যেতে দেখেছি। একসময় দেশের দুর্গম এলাকায় ঢাকার পত্রিকা যেত বিকেলে বা একদিন পর। এখন পত্রিকার অনেকগুলো এডিশন ছাপা হয়, সারা বাংলাদেশে পত্রিকা পৌঁছায় প্রায় একই সময়ে। সাংবাদিকতা শুরুর সময় আমরা কখনো কখনো অফিসে ঢুকতাম রাত ১০টায়। আর এখন রাত ৮টার মধ্যে রিপোর্টারদের কাজ ফুরিয়ে যায়। অনেক রিপোর্টার রিপোর্ট ই-মেইল করে দিয়ে অফিসে না গিয়েই বাসায় চলে যান। একসময় পত্রিকায় ফ্যাক্সে পাঠানো ঢেউ খেলানো ছবি ছাপা হতো। এখন সবকিছু তাৎক্ষণিক। বাংলাদেশে পত্রিকা রঙিন হয়েছে, খুব বেশিদিন আগে নয়। এভাবেই দ্রুত বিকশিত হচ্ছে ছাপা পত্রিকা, দ্রুত বদলে যাচ্ছে। ছাপা পত্রিকা দ্রুত উন্নতির শিখরে যাচ্ছে, যাচ্ছে আসলে ধ্বংসের দিকে।

শুরুর সময় আমরা নিউজ এজেন্সি বলতে বুঝতাম বাসস আর ইউএনবি। সে দুটিরও গ্রাহক ছিল মূলত পত্রিকাগুলো। সাধারণ মানুষ এ দুটির নামও জানত না। বিডিনিউজ যখন অনলাইনভিত্তিক নিউজ পোর্টাল করলো, আমরা হাসাহাসি করেছি। এই অনলাইন কে পড়বে, কে বিজ্ঞাপন দেবে, কয়দিন টিকবে; এই নিয়ে আমাদের সংশয় ছিল। কিন্তু দেখুন শুধু বিডিনিউজ নয়, অনলাইন নিউজ পোর্টাল আজ কেমন বাস্তবতা। দেশে আজ কয়টি অনলাইন আছে, সেটা তথ্যমন্ত্রীও জানেন না বোধহয়। অনলাইন নিউজ পোর্টালের পাশাপাশি সবগুলো পত্রিকাও এখন অনলাইন ভার্সন করেছে। কিন্তু এই বাস্তবতাকে আমরা এখনও মেনে নিতে তৈরি নই। এখনও অনলাইন মানেই অবহেলা, উপেক্ষা।

প্রেসক্লাবের সদস্যপদ দেয়ার ক্ষেত্রে অনলাইনে কর্মরত সাংবাদিকদের বিবেচনায় নেয়া হয় না, যেন তারা পুরো সাংবাদিক নয়। অবশ্য এর দায় অনেকটা ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা অসংখ্য অনলাইনের। এখন ঘরে ঘরে অনলাইন। সবগুলো যেমন মানসম্পন্ন, বিশ্বাসযোগ্য নয়; আবার দ্রুত, তাৎক্ষণিক, সঠিক সংবাদ পৌঁছে দিতে অনেকগুলো বিশ্বাসযোগ্য অনলাইনও আছে। এখন বাছাইয়ের কাজটা করতে হবে সতর্কভাবে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে ঢালাও অনলাইন করার সুযোগ থাকা উচিত নয়। তাই সরকারের উচিত সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে দ্রুত এ ব্যাপারে একটা কার্যকর ফিল্টারিং পদ্ধতি বের করা। তবে অনেকগুলো খারাপ অনলাইন আছে বলেই, অল্প কয়েকটা ভালো অনলাইনকেও সেই কাতারে ফেলে দেয়া কোনো কাজের কথা নয়।

ছাপা পত্রিকা, টিভি, রেডিও, কমিউনিটি রেডিও, অনলাইন নিউজ পোর্টালের মত মূলধারার গণমাধ্যমের পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমও এখন শক্তিশালী হয়ে উঠছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশে অবশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বলতে আমরা ফেসবুককেই বুঝি। বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের ৯৯ ভাগই ফেসবুক ব্যবহার করেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের হাত ধরে ডিজিটাল হয়েছে বাংলাদেশ। আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের উদ্যোগ বাংলাদেশ দ্রুত প্রযুক্তির রাজপথে উঠেছে। এখন এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। বাংলাদেশে এখন ৬ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে।

২ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ সক্রিয়ভাবে ফেসবুক ব্যবহার করে। সক্রিয় ফেসবুকারের বিবেচনায় ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় শহর। এই যে বিশাল ভার্চুয়াল জগত, দেরিতে হলেও এর রাজনৈতিক গুরুত্বটা বুঝতে পেরেছেন সেই সজীব ওয়াজেদ জয়ই। তিনি জানেন কোনো না কোনা ভাবে এই ৬ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছাতে পারলে রাজনীতি, নির্বাচন অনেক সহজ হয়ে যাবে। তাই আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি দলীয় সাংসদদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে আরো সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। শুধু মুখের আহ্বান নয়, রীতিমত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। আওয়ামী লীগের ধানমন্ডির কার্যালয়ে প্রথম দফায় ১৫০ এমপির প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। পর্যায়ক্রমে দলের সব এমপি এবং কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল নেতাকর্মীদের এ প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জয় দলীয় সাংসদদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দলীয় কর্মকাণ্ড প্রচার এবং নানা অপপ্রচারের জবাব দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কর্মসূচিতে সবাইকে দিনে অন্তত একটি স্ট্যাটাস দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের তরুণ এমপি, নেতারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয়। প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে জয় মজা করে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলককে লক্ষ্য করে বলেছেন, পলকের সাথে তো আমিও পারি না। এটা ঠিক পলক, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, এমনকি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয়। এমপিদের মধ্যেও অনেকে সক্রিয়। এখন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সবাইকে সক্রিয় করার। আগেই বলেছি, একটু দেরিতে উদ্যগে নেয়া হয়েছে। কারণ জামায়াতে ইসলামী অনেক আগে থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয়। বাঁশের কেল্লা তো অনেক আগে থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দাপটের সাথে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। সজীব ওয়াজেদ জয়ের একটি ফেসবুক পেজ আছে। তিনি নিয়মিতই সেখানে দলের বিভিন্ন অবস্থান তুলে ধরে স্ট্যাটাস দেন। সেগুলো প্রায়শই সংবাদের সোর্স হয়।

তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ ধরনের কোনো পেজ আছে বলে আমরা জানি না। কিন্তু আমরা দেখছি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তো প্রায় দেশ চালাচ্ছেন টুইটারে। যে কোনো খবরই হোক, ট্রাম্প প্রথম দ্বারস্থ হন টুইটারের। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও টুইটারে সক্রিয়। তার অনেক খবরের উৎস টুইটার। তাই দলীয় নেতাকর্মীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় করার উদ্যোগের পাশাপাশি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি সক্রিয় ফেসবুক পেজ এখন সময়ের দাবি, যার মাধ্যমে তিনি সরাসরি জনগণের মনের কথা বুঝতে পারবেন। ইতোমধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া টুইটারে একাউন্ট খুলেছেন, সেটি এরই মধ্যে ভেরিফাইড হয়ে গেছে।

এটা ঠিক ৭৫ সালের পর থেকেই আওয়ামী লীগ নানামুখী অপপ্রচারের শিকার। ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার সময়ে তাদের বিরুদ্ধে ঢালাও অপপ্রচার চলেছে। যদিও তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিল না। এখন আওয়ামী লীগ টানা আট বছর ক্ষমতায় থাকার পরও অপপ্রচার থেমে নেই। ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামকে মতিঝিল শাপলা চত্বর থেকে উচ্ছেদের পর তাদের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে হত্যার গুজব ছড়ানো হরেয়ছিল অনেক বিশ্বাসযোগ্যভাবে। যদিও প্রমাণের অভাবে সে অপপ্রচার হালে পানি পায়নি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারের সমালোচনা করার অধিকার সবারই আছে। কিন্তু এখনও অনেক অপপ্রচার হয়। সরকার বিরোধিতা কখনো কখনো শ্লীলতার সীমা ছাড়িয়ে যায়, অনেক হুমকি ছাড়িয়ে যায় আইনের সীমা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আওয়ামী লীগের সক্রিয় হওয়ার উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে একটা আকাঙ্খা হলো, প্রতিপক্ষকে আক্রমণ, গালাগাল করা, তাদের ব্যর্থতা তুলে ধরার চেয়ে নিজেদের সাফল্য বেশি করলেই বেশি ভালো হবে। অপপ্রচারের জবাব দেয়ার চেয়ে নিজেদের প্রচারণায় বেশি মনোযোগী হলেই তা জনগণ ভালোভাবে নেবে। সব পক্ষের সক্রিয় অংশগ্রহণ, যুক্তি-পাল্টা যুক্তিতে যেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আরো পরিচ্ছন্ন হয়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাশাপাশি আওয়ামী লীগকে বিবেচনায় নিতে হবে অনলাইন পোর্টালের বিশাল জগতকেও। কারণ কোনো একটা ঘটনায় প্রথম নিউজটা আসে একইসঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং অনলাইনভিত্তিক গণমাধ্যম থেকে। প্রাথমিক জনমতটা তৈরি হয় সেখানেই। যেমন দুদিন আাগে কক্সবাজার সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাগরের জলে পা ভেজানো নিয়ে আবেগের ঢেউটা শুরু হয়েছিল অনলাইনে, পরে তা ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, আরো পরে পত্রিকায়। তাই প্রধানমন্ত্রীর কাভারেজসহ সব তৎপরতায় বস্তনিষ্ঠ ও বিশ্বাসযোগ্য অনলাইনগুলোকে বিবেচনায় নিতে হবে।

একটা সময় সত্যি আসবে, যখন ছাপার পত্রিকা থাকবে না, মানুষ সব নিউজ পাবে অনলাইন আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকেই।
জাগোনিউজ – ৮ মে, ২০১৭