গোলাম আজম খান (দৈনিক নয়াদিগন্ত), কক্সবাজার
প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনের অধিবাসীদের স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও শরণার্থীর মতোই জীবন কাটাতে হচ্ছে। সেন্টমার্টিনে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সরকারি অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত ও সঠিক পরিবেশবান্ধব নীতিমালার অভাবে এ সম্ভাবনা আলোর মুখ দেখছে না। পরিস্থিতি এমনই হয়েছে যে, সেন্টমার্টিন দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ হওয়ায় এখানকার অধিবাসী নাগরিক অধিকার ভোগ করতে পারছেন না। প্রবালদ্বীপ হিসেবে ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া (ইসিএ) হওয়ায় পরিবেশ-সংশ্লিষ্ট জিও-এনজিও নানা প্রতিষ্ঠান থেকে এখানকার অধিবাসীদের ভেঙে যাওয়া ঘর মেরামত কিংবা একটি টয়লেট নির্মাণ করতে গেলেও বাধা দেয়া হচ্ছে। এখানে হয়রানিমুক্ত স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অব্যাহত রাখতে একটি নীতিমালা করে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন সেন্টমার্টিনবাসী। সেন্টমার্টিনবাসীদের মতে, পরিবেশবান্ধব একটি নীতিমালার অভাবে পর্যটন শিল্পের বিপুল সম্ভাবনা ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগও কাজে আসছে না। এই সম্ভাবনাকে বাস্তব রূপ দিতে কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং দ্বীপবাসীকে সম্পৃক্ত রেখে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পর্যটন শিল্প বিকাশে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে অনেক উন্নত রাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক ও কূটনীতিকেরা গোপনে সেন্টমার্টিন দ্বীপের ওপর কয়েকবার সার্ভে করেছেন। তাদের সমীা অনুযায়ী, সেন্টমার্টিন দ্বীপটি চতুর্দিকে প্রবাল পাথরের বেষ্টনীতে গড়া। গভীর নিচে রয়েছে জমাটবাঁধা পাথর। এই জমাট পাথরের বেষ্টনী সাগরের তলদেশ হয়ে মালয়েশিয়া পর্যন্ত বেষ্টিত। তাদের সমীায় দেখা গেছে, প্রবাল পাথরবেষ্টিত সেন্টমার্টিনে বহুতল ভবন ও সুউচ্চ টাওয়ার করলেও দ্বীপটি ধসে পড়ার আশঙ্কা নেই। সেন্টমার্টিন একটি দ্বীপ হলেও ভৌগোলিক দিক দিয়ে এর গুরুত্ব বিশ্বের দরবারে অপরিসীম। নীল সাগরের বুকে প্রবাল থেকে উৎপত্তি হয়ে সাগরের বুক চিরে তিল তিল করে গড়ে ওঠা এই দ্বীপ। ১৯৭৮ সালে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রার স্বার্থে তৎকালীন সরকার গড়ে তুলেছিল বিভিন্ন অবকাঠামো। দ্বীপের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য বিদ্যুতায়ন, অফিস, পোস্ট অফিস ও জাহাজ চলাচলের জন্য নেভিগেশন টাওয়ার স্থাপন করেছিল। কালক্রমে সেন্টমার্টিনের সৌন্দর্য বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আনাগোনা সেন্টমার্টিনের সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি করেছে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার দিক দিয়ে এ দ্বীপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পর্যটনের দিক দিয়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপ একটি দৃষ্টিনন্দন মন জুড়ানো এলাকা।
আগামী ২০ মের মধ্যে সেন্টমার্টিনের ৩৮টি হোটেল ভাঙার জন্য গত মাসে নোটিশ জারি করেছে পরিবেশ অধিদফতর। নোটিশ জারিকে কেন্দ্র করে সরকারি-বেসরকারী পর্যটন সংশ্লিষ্টদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। গত ১৯ এপ্রিল পরিবেশ অধিদফতরের কক্সবাজার অফিস থেকে এ নোটিশ দেয়া হয়। তবে প্রশ্ন উঠেছে, সেন্টমার্টিনের বহুতল হোটেল, কটেজ ও অন্যান্য স্থাপনা কিভাবে নির্মিত হলো, কয়েক যুগ ধরে বেশ কিছু স্থাপনা ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে গেলেও তখন কেন এ ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তা ছাড়া শুধু হোটেলগুলোই ভেঙে ফেলা হলে কি দ্বীপ রক্ষা হবে? নাকি এখানে পর্যটনে ধস নামাতে চক্রান্ত করা হচ্ছেÑ এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে দ্বীপে। বিশেষ করে দ্বীপের বেশির ভাগ অধিবাসী এখন পর্যটন মওসুমের দিকে তাকিয়ে আছেন। কেউ ভ্যান চালিয়ে, কেউ পর্যটকদের সেবা দিয়ে জীবন-জীবিকা পরিচালনা করছেন। এ প্রসঙ্গে সেন্টমার্টিনের ইউপি চেয়ারম্যান নূর আহমেদ বলেন, এসব হোটেল ভেঙে দেয়া হলে পর্যটনে মারাত্মক ধস নামবে, সেন্টমার্টিন দ্বীপের প্রায় ১০ হাজার অধিবাসীর জীবন-জীবিকা ব্যাহত হবে। তিনি বলেন, দুর্যোগকালে এসব হোটেলে সেন্টমার্টিনের লোকজন আশ্রয় নিয়ে থাকেন। এসব বিবেচনা করে পরিবেশসম্মত কোনো উপায় বের করা দরকার।
বেসরকারি পর্যটন শিল্প খাতে একাধিক বিনিয়োগকারী বলেছেন, ১৯৯৭ সালে আমরা দ্বীপের উত্তর-পশ্চিমাংশে বহুতল আবাসিক হোটেল নির্মাণ করেছি। ট্রেড লাইসেন্স, জেলা প্রশাসনের লাইসেন্স নিয়েছি। নিয়মিত ভ্যাট প্রদান করে দেশ-বিদেশের হাজার হাজার পর্যটকের সেবা দিয়ে আসছি। আমরা নিজের তাগিদে সেন্টমার্টিনে বাঁধ নিমাঁণ করে দ্বীপ রক্ষায় অংশীদার হয়েছি। তা না হলে অনেক আগেই দ্বীপের বেশির ভাগ তলিয়ে যেত।
অথচ পরিবেশবাদীরা এসব চিন্তা না করে একতরফা বক্তব্য দিচ্ছেন। তারা আরো জানান, ১৯৯৯ সালের দিকে সরকার দ্বীপটিকে পরিবেশ ও প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করেই দায়িত্ব শেষ করেছে। দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন নিয়ে তৈরি হয়নি কোনো নীতিমালা। নীতিমালার আলোকেই এখানে ব্যবস্থাপনা নেয়া দরকার ছিল।
দ্বীপের স্থায়ী বাসিন্দারা জানান, এখানে আরো অনেক সরকারি স্থাপনা রয়েছে। অথচ শুধু পর্যটকদের জন্য গড়ে ওঠা স্থাপনাগুলোকে উচ্ছেদের জন্য কেন নোটিশ তা বোধগম্য হচ্ছে না। তারা জানান, দ্বীপের মানুষ এক সময় শুধু মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। এখন পর্যটনের সাথে মিশে গেছেন দ্বীপবাসী। তাদের জীবন-জীবিকার দিকে তাকানো দরকার। কেউ তাদের একটা কাজের ব্যবস্থা না করে মুখের গ্রাস কেন কেড়ে নেয়ার চক্রান্ত শুরু করল পরিবেশবাদীদের তা খতিয়ে দেখা দরকার।
জীববৈচিত্র্য রার নামে পরিবেশবাদী এনজিওদের কূটকচালে সরকার উল্টো পরিবেশ সঙ্কটাপন্ন ঘোষণা দিয়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপের বহুতল দালান নির্মাণ ও অবকাঠামো নির্মাণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দ্বীপবাসীকে পিছিয়ে দিয়েছেÑ এমন অভিযোগ করলেন সেন্টমার্টিনের সাবেক চেয়ারম্যান মাওলানা ফিরোজ আহমদ খান। তিনি আরো বলেন, দ্বীপে বেশ কয়েকটি বহুতল হোটেল, হাসপাতাল, ইউপি ভবনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের জন্য পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র প্রযোজন ছিল না। তাহলে অন্যদের েেত্র কেন প্রয়োজন হবে। তিনি এই পরিবেশবাদী এনজিওগুলোর কূটকচাল পরিহার করে সেন্টমার্টিন দ্বীপবাসীর জন্য সঠিক নীতিমালা ঘোষণার দাবি করেন।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মুজিবুর রহমান জানান, আমরা আদালত ও সরকারের সিদ্ধান্তকে সব সময় শ্রদ্ধা করি। দ্বীপে যারা বাস করেন, সবাই পৈতৃক খতিয়ানভুক্ত জমিতেই কাঁচা বা সেমিপাকা ঘর করেছেন। এখানে প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া ইট-বালু আনা সম্ভব নয়। বহুতল ভবন ছাড়া বাকিগুলো প্রশাসনের অনুমতিতেই হয়েছে। দ্বীপে বাস করতে একটি নির্দিষ্ট নীতিমালা না করা পর্যন্ত ধোঁয়াশা কাটবে না বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, সরকার পরিকল্পিতভাবে যৌথ উদ্যোগে ও ব্যবস্থাপনায় মাস্টারপ্লানের মাধ্যমে দ্বীপের উন্নয়ন করলে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এ সেন্টমার্টিন দ্বীপ হতে পারে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম পর্যটন কেন্দ্র।