এদিকে ইসলামী ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান ফেসবুকে এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার (১১ মে) বেলা আড়াইটার সময় একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। স্ট্যাটাসে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘ব্যাংকের হাতেগোনা কয়েকজন (দুই ডজনের কম) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যাদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ও রাষ্ট্রবিরোধী কাজের মামলা রয়েছে, তারাই ইসলামী ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনা দখল করে নিয়েছে। প্রথমে তারা পরিচালনা পর্ষদের মধ্যে ভাঙন ধরাতে চায়। পরবর্তীতে তারা পর্ষদের সম্পূর্ণ অবাধ্য হয়ে পড়েন। কেবলমাত্র বিভিন্ন পর্ষদে তাদের উত্থাপিত এজেন্ডার বাইরে কোনও নির্দেশনা পরিপালন করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। সরকারবিরোধী কার্যকলাপে সক্রিয় কর্মচারীদের ভালো ভালো পোস্টিং দিয়ে রাষ্ট্রবিরোধী রাজনীতির সুযোগ করে দেওয়া হয়। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকর্তাদের ঢাকার বাইরে অন্যত্র বদলির নির্দেশনা অগ্রাহ্য করা হয়।’
এ বিষয়ে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক মেজর জেনারেল (অব) ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল মতিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমিও শুনেছি, সৈয়দ আহসানুল আলম পতদ্যাগের কথা ভাবছেন।’ তিনি বলেন, ‘আমরা একটি পেক্ষাপটে এই ব্যাংকে দায়িত্ব নিয়েছি। কোনও কারণে হয়তো তিনি (সৈয়দ আহসানুল আলম ) মনক্ষুণ্ন হয়েছেন। তবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া তার পদত্যাগ করা হবে না। আগামী রবিবার পর্ষদের সভা আছে। সেখানে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যারা এখন এই ব্যাংকের পর্ষদে আছি, তারা সবাই চেয়েছি ব্যাংকটিকে কিছু দেওয়ার। এখান থেকে কিছু নিতে চাই না।’
ইসলামী ব্যাংকের পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদের মেয়াদ এক বছরও হয়নি। এরইমধ্যে পর্ষদে দেখা দিয়েছে অবিশ্বাস ও সন্দেহ। শুরু হয়েছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি দায়িত্ব নেওয়া পর্ষদে বর্তমানে ভাঙনের সুর বাজছে। সরকার সমর্থিত ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ আহসানুল আলম বৃহস্পতিবার (১১ মে) ব্যাংকটি থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, গত ৫ জানুয়ারি রাজধানীর একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত পরিচালনা পর্ষদের সভায় এই ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ে ব্যাপক রদবদল করা হয়। পুনর্গঠন করা হয় পরিচালনা পর্ষদ। পর্ষদের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মোস্তফা আনোয়ারকে সরিয়ে নতুন চেয়ারম্যান করা হয় সাবেক সচিব আরাস্তু খানকে। পদত্যাগে বাধ্য করানো হয় ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ আবদুল মান্নানকে। নতুন এমডির দায়িত্ব দেওয়া হয় ইউনিয়ন ব্যাংকের এমডি মো. আবদুল হামিদ মিঞাকে।
এর আগে পরিচালনা পর্ষদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে জামায়াত ঘনিষ্ঠদের। ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৩ সালে। শুরু থেকেই এই ব্যাংকটির ওপর ছিলো জামায়াতে ইসলামীর ব্যাপক প্রভাব।
ইসলামী ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান ফেসবুকে যে স্ট্যাটাস দিয়েছেন তা হুবহু তুলে ধরা হলো- ‘বন্ধুরা ও ইসলামী ব্যাংকের কোটি কোটি সম্মানিত গ্রাহক,আসসালামু আলাইকুম। গত ৬ই মে ২০১৭ ইসলামী ব্যাংকে স্বতন্ত্র পরিচালক, ইসি চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে আমার এক বছর পূর্ণ হয়েছে। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের বৃহত্তম ব্যাংক। এই ব্যাংক দেশের ৩২ শতাংশ অর্থনীতির ওপরে প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন গভর্নর বিভিন্ন সময় বলেছেন, ইসলামী ব্যাংকের ওপর নির্ভর করে উন্নয়নের অর্থনীতি এবং উন্নয়নের রাজনীতির ওপর নির্ভর করে রাষ্ট্র ক্ষমতার ভারসাম্য।
এক কোটি ২০ লাখের বেশি আমানতকারীর সর্বস্ব ১০ লাখ বিনিয়োগ গ্রহীতাকে দেওয়া হয়েছে। কাকে দেওয়া হয়েছে, তারা ওই টাকা পুনরায় জঙ্গি অর্থায়ন, অথবা সরকারবিরোধী রাজনীতিতে দিয়েছেন কিনা তা আমরা মনিটর করতে শুরু করি।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ‘সোনার বাংলাদেশ” বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন “সোনার বাংলাদেশ” সেই ভিশনকে সামনে নিয়ে আমি ও নতুন পর্ষদ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-মুসলমান পাঁচ লাখ হতদরিদ্র মানুষকে ঋণ দেওয়ার কার্যক্রম শুরু করি। আরও পাঁচ লাখ এসএমই (ক্ষুদ্র মাঝারি) যুবক ও নারী উদ্যাক্তাদের বিনিয়োগ প্রদানের নির্দেশ দেই। যাতে গরিব হঠানোর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর ভিশন ২০২১ বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সুবিধা বঞ্চিত মানুষের সমর্থন আদায় করতে পারি। তখনই শুরু হয় ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে প্লাস-মাইনাসের ষড়যন্ত্র।
যেহেতু এককোটি ২০ লাখ আমানতকারী তাদের আমানত, বিশ্বাস ও সেন্টিমেন্ট আমাদের কাছে গচ্ছিত রেখেছেন। আমি ও নতুন পর্ষদ যখন তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে উন্নয়নের অর্থনীতির কাজে নেমে পড়ি তখনই শুরু হয় ষড়যন্ত্র। রাষ্ট্রবিরোধী এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত আছেন ব্যাংকের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং দুর্নীতিগ্রস্ত কিছু সরকারি অফিসার। ষড়যন্ত্রটি এত জটিল যে, অনতিবিলম্বে গোয়েন্দাদের সাঁড়াশি তৎপরতা রাষ্ট্রের স্বার্থে অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। এখানে শুধু কয়েকটি স্পর্শকাতর বিষয় তুলে ধরা হলো-
প্রথমত: মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি নিয়ে যখন পরিচালনা পর্ষদ গঠিত হয়, তখন এ সরকার ইসলাম বিদ্বেষী এবং এই পর্ষদও ইসলাম বিদ্বেষী বলে সারাদেশে প্রচারণা চালানো হয়। এবং এই প্রচারণা সত্য প্রমাণ করার জন্য উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ইসলামী ব্যাংকের ক্যালেন্ডার থেকে ‘শরিয়াহভিত্তিক পরিচালিত ব্যাংক” শব্দটি সরিয়ে দিয়ে নতুন পরিচালনা পর্ষদকে বেকায়দায় ফেলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ভোট নষ্ট করার ষড়যন্ত্র শুরু করা হয়। আমি ও নতুন পর্ষদ এই ষড়যন্ত্রকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও আমাদের অমতে ওই সব (৫ থেকে ৭ লাখের বেশি) ক্যালেন্ডার বাজারে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
দ্বিতীয়ত: ইসলামী ব্যাংকের সাড়ে ১৩ হাজার কর্মকর্তার মধ্যে ৯৯ শতাংশ আদর্শ ও নিবেদিত ব্যাংকার। ইসলামী ব্যাংকিংকে ব্রত হিসেবে নিয়ে সারাজীবন উৎসর্গ করেছেন এদের অনেকে। ইসলামী ব্যাংকটাকে সর্বজনীন ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে এই ৯৯ শতাংশ কর্মকর্তা নতুন পরিচালনা পর্ষদকে সহযোগিতা করছেন। কিন্তু ব্যাংকের হাতে গোনা (দুই ডজনের কম) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যাদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ও রাষ্ট্রবিরোধী কাজের মামলা রয়েছে, তারা এসে ইসলামী ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনা দখল করে নেন। প্রথমে তারা পরিচালনা পর্ষদের মধ্যে ভাঙন ধরাতে চায়। পরবর্তীতে তারা পর্ষদের সম্পূর্ণ অবাধ্য হয়ে পড়েন। কেবলমাত্র বিভিন্ন পর্ষদে তাদের উত্থাপিত এজেন্ডার বাইরে কোনও নির্দেশনা পালন করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। সরকারবিরোধী কার্যকলাপে সক্রিয় কর্মচারীদের ভালো ভালো পোস্টিং দিয়ে রাষ্ট্রবিরোধী রাজনীতির সুযোগ করে দেওয়া হয়। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পরামর্শে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকর্তাদের ঢাকার বাইরে অন্যত্র বদলির নির্দেশনাও অগ্রাহ্য করা হয়।
তৃতীয়ত: বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবসে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে পরিচালনা পর্ষদকে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা অমান্য করা হয়। একইভাবে ২৬ মার্চ যথাযথ মর্যাদায় পালন করা হয়নি।উপরন্তু, শুরু হয়ে যায় ব্রাঞ্চে ব্রাঞ্চে অফিসের পরে গোপন মিটিং, ইয়ানত অর্থাৎ চাঁদা সংগ্রহ ও ক্যাডারদের মধ্যে বিতরণ।
চতুর্থত: এ বছরের মুনাফা থেকে ৭০ কোটি টাকা ট্রান্সফার করা হয় ইসলামী ব্যাংকের বিতর্কিত জাকাত ফান্ডে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তির সকলে আমাকে প্রশ্ন করেন ইসলামী ব্যাংক হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানদের নিট মুনাফা থেকে কেন জাকাত কেটে নেওয়া হয়? মুসলমান আমানতকারীরা প্রশ্ন করেন, আমার জাকাত আমি দেবো যাকে ইচ্ছা তাকে দেবো। কেন আমার জাকাত বিতর্কিত জায়গায় বিতরণ করা হচ্ছে।
এমতাবস্থায় সর্ব সাধারণ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্তরের কাছে দাবি করছে ব্যাংকটি যেন স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না হয় এবং পুনরায় যেন ব্যাংকটির ম্যানেজম্যান্ট রাষ্ট্রবিরোধী শক্তির হাতে ফিরে না যায়।
বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের এত বিরাট প্রত্যাশা আমার পক্ষে পূরণ করা সম্ভব কি?
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ, ইসলামী ব্যাংক বহুল আলোচিত ও সমালোচিত ব্যাংকও বটে। শত জল্পনা-কল্পনার মাঝে আমার স্থান থেকে আমি ব্যাংকটিকে বদনামের বাইরে আনতে চেষ্টা করেছি। চেষ্টা করেছি ব্যাংকটিকে যেন কেউ রাষ্ট্রবিরোধী কাজে ব্যবহার করতে না পারে। আমি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নির্ভীকভাবে কাজ করেছি। সফলতা-বিফলতার বিচার ইতিহাসের কাছে দিলাম।
আমার শত চেষ্টার পরেও রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি এখানে পুনর্বাসিত হয়েছে এবং জাতির পিতার খুনিদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা ফিরে আসছেন নেতৃত্বে। আগামী বছর এই ব্যাংকটিকে রাষ্ট্রবিরোধী কাজে ব্যবহার করার নীল নকশা সম্পাদন হচ্ছে।
অপর পক্ষে আমার ওপর সরে দাঁড়ানোর চাপ বাড়ছে। ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকে নিয়ে প্লাস-মাইনাসের ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। তাই পরিচালনা পর্ষদ ও ভাইস চেয়ারম্যানের পদে দায়িত্ব পালন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার সরে যাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।’
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।