বাংলাট্রিবিউন:
গত ১১ মে তাজের একটি ছবি প্রকাশ হয় ইরাকের নিনওয়া প্রদেশের ক্বাওয়াফেল আশ-শুহাদা মিডিয়ায় এবং আইএসের অফিসিয়াল টেলিগ্রাম চ্যানেল নাশির নিউজ এজেন্সিতে। তাজের ছবি প্রকাশ  করা হলেও তার মৃত্যুর স্থান-কাল ও কারণ কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। আরবিতে শুধু বলা হয়, ‘আল-আখ আবু ইসমাঈল আল-বাঙালি তাক্বাব্বালহা আল-আল্লাহ’, অর্থাৎ ‘ভাই আবু ইসমাঈল আল-বাঙালি, আল্লাহ তাকে কবুল করুন’। পরবর্তীতে এই ছবি বাংলা ভাষায় আইএস অনুসারীদের আত্ব-তামকীন ওয়েব সাইটেও প্রকাশ করা হয়। সাধারণত আইএস যোদ্ধাদের কারও মৃত্যু হলে ‘আল্লাহ তাকে কবুল করুন’ উল্লেখ করে সম্মান জানানো হয়।

আবু ইসমাঈল আল-বাঙালির ছবিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেন বিদেশে আইএসের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখা তোহা মোজাম্মেল হোসেন। তিনি বলছিলেন, ‘আইএস সাধারণত তাদের শত শত সাধারণ সৈনিকের মৃত্যুতে কোনও ছবি বা বিবৃতি প্রকাশ করে না। শুধুমাত্র নেতৃস্থানীয়দের এবং আত্মঘাতী হামলাকারীদের ক্ষেত্রেই ছবি,বিবৃতি বা ভিডিও প্রকাশ করে। কিন্তু আত্মঘাতী হামলা করলে সাধারণত ছবির নিচে সেটা উল্লেখ থাকে। আবু ইসমাঈল আল-বাঙালির ছবি যেদিন প্রকাশ করা হয়, সেদিন কয়েকজন ইরাকি যোদ্ধার ছবিও প্রকাশ করা হয়েছিল, যাদের নিচে লেখা ছিল তারা ইসতিশহাদী হামলায় শহীদ হয়েছে। কিন্তু তাজের ক্ষেত্রে কিছু লেখা ছিল না। এসব মিলিয়ে ধারণা করা যেতে পারে, হয়তো সে তাদের ভাষায় বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে মারা গেছে। অথবা আত্মঘাতী হামলা করার উদ্দেশ্যে বের হয়েছিল। কিন্তু সফল হওয়ার আগেই ইরাকি ফেডারেল পুলিশ তাকে মেরে ফেলে।’ আবু ইসমাঈল আল-বাঙালির মৃত্যুর পর ইরাকি ফেডারেল পুলিশের পক্ষে কিছু পেজে তাদের সমর্থকদের উল্লাস করতে দেখা গেছে বলে জানান তোহা মোজাম্মেল হোসেন। এ থেকে তিনি ধারণা করছেন, ইরাকি ফেডারেল পুলিশের হাতেই তাজের মৃত্যু হয়েছে। .

বডি বিল্ডার তাজ (বাঁয়ে)ওই ছবির সূত্র ধরে ফিনল্যান্ড প্রবাসী এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। যিনি আবু ইসমাঈল আল-বাঙালিকে তাজ রহমান হিসেবে শনাক্ত করেন। তাজের ওই বন্ধু বলেন, ২০০০ সালে সাইপ্রাসে তারা একসঙ্গে একটি কলেজে হোটেল ব্যবস্থাপনার ওপরে পড়াশোনা করেছেন। এমনকি তারা একসঙ্গেই বসবাস করেছেন।

ফিনল্যান্ড প্রবাসী ওই ব্যক্তি তাজের বাসা ঢাকার মোহাম্মদপুরে জানালেও তার স্বজনদের কারও যোগাযোগের নম্বর দিতে পারেননি। তবে তাজের এক ভাই একটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের বিপণন বিভাগে কাজ করেন বলে জানান। এর বাইরে তিনি তাজের আরেকজন আত্মীয়ের সন্ধান দেন, যিনি শোবিজ মিডিয়ায় কাজ করেন। গত চার দিনের অনুসন্ধানে এই প্রতিবেদক তাজের সেই বড় ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন। আইএস প্রকাশিত সেই ছবি পরিবারের সদস্যদের দেখালে তারাও তাজ হিসেবেই আবু ইসমাঈল আল-বাঙালিকে শনাক্ত করেন।

মহাখালীর একটি করপোরেট ভবনে বসে আধুনিক এক তরুণের জঙ্গি হয়ে ওঠার গল্প বলতে থাকেন তার বড় ভাই, যিনি বারবার পরিবারের সদস্যদের নাম প্রকাশ না করার জন্য অনুরোধ জানান এই প্রতিবেদককে। তাজের বড় ভাই বলেন, তাজ যে পথে গেছে সেই পথের সঙ্গে তাদের কোনও যোগসূত্র নেই। তাজের এই পথকে তারা মেনেও নিতে চান না। গত কয়েক বছর যোগাযোগহীন তাজকে তারা ভুলে থাকতে চান সবসময়।

একটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের বিপণন বিভাগের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী তাজের বড় ভাই বলেন,বিষয়টি জানার পর তিনি কেবল তাদের প্রকৌশলী বড় ভাইকে জানিয়েছেন। পরিবারের আর কোনও সদস্যকে বিষয়টি জানানো হয়নি। কারণ, তাদের বাবা-মা বৃদ্ধ এবং পেস মেকার লাগানো এক বোন হয়তো তাজের এই পরিণতি সহ্য করতে পারবেন না।

বিপথগামী এই তরুণের ভাই বলেন,ঢাকাতেও আধুনিক জীবন-যাপন করতো তাজ। একটি ব্যান্ডের সঙ্গে ড্রামার হিসেবে কাজ করত সে। সাইপ্রাসে গিয়েও তাজ একইভাবে জীবন-যাপন করতো।শরীরে একাধিক ট্যাট্টু ছিল তার। হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি পড়ে ঘুরে বেড়াত যে ছেলে, সে হঠাৎ এভাবে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়বে তা অকল্পনীয়। তিনি বলেন, ও কিন্তু বিয়েও করেছিল এক  লাটভিয়ান তরুণীকে ওর স্ত্রীর নাম ছিল ডিটা।.

কয়েক বছর আগে বন্ধুদের সঙ্গে তাজ রহমানতাজের বড় ভাই আরও বলেন, লাটভিয়ান তরুণী ডিটাকে বিয়ের পর ২০০৯ সালে তাকে ঢাকায় নিয়ে আসে। ঢাকায় তাদের বিবাহপরবর্তী  সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়। বিয়ের বছর দুয়েকের মাথায় তাদের বিচ্ছেদ ঘটে। তবে বিচ্ছেদের আগে সাইপ্রাস থেকে ফিনল্যান্ডে গিয়ে বসবাস শুরু করেছিল তারা।’

ফিনল্যান্ড প্রবাসী তাজের সেই ঘনিষ্ঠ বন্ধু নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, সাইপ্রাসের নিকোসিয়ায় কলেজ অব ট্যুরিজম অ্যান্ড হোটেল ম্যানেজমেন্ট নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একসঙ্গে তারা পড়াশুনা করতেন।দুই সেমিস্টার পরই তাজ পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে পাফোস এলাকার ইমপেরিয়াল বিচ হোটেলে বার ম্যান হিসেবে কাজ শুরু করে। চাকরিতে আয়ের পুরো অর্থই সে পানাহার ও ক্যাবারে গিয়ে আনন্দ-ফূর্তি করে খরচ করতো। তাজের ওই বন্ধু বলেন, ভীষণ দুষ্টামি করে সময় কাটানো একটি ছেলে কিভাবে ধর্মীয় জঙ্গিবাদে জড়িয়ে জীবন দিলো, তা তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। অবশ্য শেষ কয়েক বছর আগে দাড়ি আর টুপি পরিহিত অন্য এক তাজকে দেখেছিলেন তিনি।

স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পরই পাল্টে যায় তাজ

স্ত্রী ডিটার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর থেকেই পাল্টে যেতে শুরু করে তাজ। এসময় তার সঙ্গে পরিচয় হয় ফিনল্যান্ডের ওলুয়্যুর একটি মসজিদের ইমাম ড. আব্দুল মান্নানের সঙ্গে। এই মান্নানের সাহচর্যে এসেই জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে সে। তখনও পর্যন্ত পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল তাজের। এক পর্যায়ে ড. আব্দুল মান্নানের মেয়ে সামিয়াকে বিয়ে করে সে।

তাজের বড় ভাই বলেন, দ্বিতীয় বিয়ের পর ২০১২ সালের দিকে তাজ একদিন আমাকে ফোন করে। আমি তখন আমার মেয়েকে গানের স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে যাচ্ছিলাম। তাজ এ কথা শুনে ‘নাউজুবিল্লাহ’ বলে গানের স্কুলে ভর্তি করাতে নিষেধ করে। আমি সেসময় তার সঙ্গে এ নিয়ে তর্কও করি। বুঝতে পারি, আমাদের সেই তাজ ধর্মীয় গোঁড়ামির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে।

ঢাকায় বসে আমাদের আসলে কিছুই করার ছিল না। আমরা ব্যস্ত ছিলাম আমাদের কাজ নিয়ে। মাঝে-মধ্যে ফোনে কথা হতো। তার বিয়ের খবরে আমরা খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু বিয়ের পর তার স্ত্রীর সঙ্গে আমাদের কখনও কথা বলিয়ে দেয়নি।ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী এটা নাকি হারাম। এমনকি আমাদের পরিবারের মেয়েদের কারও সঙ্গে তাজের স্ত্রী কথা বললেও দূর থেকে আমাদের কারও কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেই ফোনের লাইন কেটে দিত। বলছিলেন তাজের বড় ভাই।

তিনি বলেন,তাজের শ্বশুর আব্দুল মান্নানকে আমরা চিনি না। শুনেছি, তারা ২৫-৩০ বছর ধরে ফিনল্যান্ড প্রবাসী। ঢাকার পান্থপথে তাদের এক আত্মীয়ের ঠিকানা দিয়েছিল। সেখানে গিয়ে সেই নামে কাউকে পাওয়া যায়নি।

তাজের সেই ফিনল্যান্ড প্রবাসী বন্ধু বলেন, আব্দুল মান্নানের পরিবার বাংলাদেশে আগে জামায়াতপন্থী ছিল। ফিনল্যান্ডেও তিনি জামায়াতের লোকজনের সঙ্গে মিশতেন বেশি। স্থানীয় রাজনীতিও করেছেন কিছুদিন। তবে বাংলাদেশে আব্দুল মান্নানের পরিবারের বিস্তারিত তথ্য জানাতে পারেননি তিনি।

তাদের ধারণা, ২০১৪ বা ২০১৫ সালের কোনও এক সময়ে তাজ সিরিয়ায় পাড়ি জমান। সিরিয়া থেকে ফেরত আসা বাংলাদেশি এক তরুণ গাজী সোহান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর ‘আবু ইসমাঈল আল-বাঙালি’ নামে এক তরুণের সঙ্গে সিরিয়ার রাক্কায় দেখা হওয়ার কথা বলেছিলেন। সেই আবু ইসমাঈল আল-বাঙালি-ই এই তাজ রহমান কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। গাজী সোহান বর্তমানে কারাবন্দি রয়েছেন। গাজী সোহানের ভাষ্য থেকে অনুমান করা হয়, ২০১৫ সালের প্রথম দিকেই সিরিয়ায় চলে যায় তাজ রহমান।

খোঁজ নেই তাজের শ্বশুর-শাশুড়ি ও স্ত্রীরও

তাজের ঢাকায় বসবাসকারী স্বজনরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে তাজ তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করতো না। মাঝে মধ্যে ফোন করে পরিবারের খোঁজখবর নিলেও নিজের বিষয়ে কিছুই বলতো না। পরিবারের সদস্যরা ভেবেছিলেন হয়তো ভালোই আছে তাজ। যদিও তারা বুঝতে পেরেছিলেন, তাদের সেই ভাইটি চলে গেছে ধর্মীয় উগ্রপন্থার পথে। কিন্তু তাদের আসলে কিছুই করার ছিল না। তাজের বড় ভাই বলেন, তাজের মোবাইল ফোন বন্ধ। এমনকি তার শ্বশুর-শাশুড়িসহ অন্যদের মোবাইল ফোনও বন্ধ। ফলে তাদের কাছে ফোন করে তাজের খোঁজ নেওয়ারও উপায় ছিল না।

তাজের এক বন্ধু জানান, স্ত্রী সামিয়া এবং শিশু সন্তানকে নিয়ে সিরিয়ায় পারি জমায় তাজ। তবে স্ত্রী ও সন্তানের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানাতে পারেননি তিনি। নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি তাজের শ্বশুর-শাশুরি সম্পর্কেও।