শাহেদ মিজান, সিবিএন: 
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক এখন ভয়ংকর মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। প্রতিমূর্হত এই সড়কে ঝরে পড়ছে অনেক মানুষের তাজা প্রাণ। দীর্ঘদিন এভাবে মৃত্যুর হিড়িক চললেও কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিচ্ছে না সংশ্লিষ্টরা। এতে এই সড়কে মৃত্যু যেন মহামারীতে পরিণত হয়েছে। তাই সড়কে চলাচলকারীরা এখন চরম আতঙ্ক নিয়ে চলাচল করছে।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)’র এক জরিপে মতে, ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সালের ২১ অক্টোবর পর্যন্ত কক্সবাজার জেলায় ছোট-বড় মিলে প্রায় ১৯৬৪ টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর ৮০ শতাংশই ঘটেছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ২৭৬ জন। আহত হয়েছে প্রায় ৪০৯৫ জন। এসব দুর্ঘটনায় নিহতদের তালিকায় সেনা সদস্য, ব্যাংক কর্মকর্তা, স্কুল শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, মন্ত্রীপুত্র এবং ব্যবসায়ীও রয়েছেন।
পরিসংখ্যান মতে, এসব দুর্ঘটনার মধ্যে বেশি ঘটেছে চকরিয়া উপজেলা অংশে। এই উপজেলার খুটাখালী থেকে শুরু করে হারবাং পর্যন্ত প্রতিটি পয়েন্টে ঘটেছে দুর্ঘটনা।
আরেক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারিতে দেড়মাসে কক্সবাজার জেলায় ঘটেছে ৩০টি সড়ক দুর্ঘটনা। সেময় একদিনে তিনটি দুর্ঘটনাও ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় মর্মান্তিকভাবে প্রাণহানি ঘটে ৩৮ জনের। আহত হয়েছে অন্তত ৩০০জন। আহতের অধিকাংশই বরণ করেছে পঙ্গুত্ব। সংঘটিত দুর্ঘটনার ৮০ভাগ ঘটেছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়ায়।
সূত্র মতে, কক্সবাজারের সবচেয়ে বেশি মর্মস্পর্শী সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছিল ২০১২ সালের ০১ জুন। ওইদিন চকরিয়ার মালুমঘাট এলাকায় শ্যামলী বাসের ধাক্কায় মাইক্রোবাসবাহী একই পরিবারের সাত জনসহ আটজন নিহত হয়েছিল। নিহতরা ছিলো কক্সবাজারের অতি পরিচিত হোসেন ব্রাদার্স পরিবার। এই ঘটনাটি দেশে-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। বড় দুর্ঘটনা আরেকটি দুর্ঘটনা ঘটে ২০১৩ সালে। ওই সময় চকরিয়ার একটি ব্রীজের রেলিং ভেঙে একটি পর্যটকবাহী বাস খালে পড়ে ২৩ জন পর্যটক নিহত হয়েছিল।
সর্বশেষ গত ১৫ মে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের ছগিরশাহ কাটা এলাকায় মাইক্রোবাসের ধাক্কায় নিহত হয়েছেন পেকুয়ার ওমর হানিফ চৌধুরী (৪৫)। আহত হয়েছেন তাঁর এক ভাগনি। একই দিন চকরিয়ার বদরখালীতে বাসের ধাক্কায় প্রাণ হারায় মহেশখালীর এক বৃদ্ধ। ১৬ মে কক্সবাজার শহরের কলাতলীয় বাইপাস সড়কে ডাম্পারের ধাক্কায় প্রাণ হারায় আনোয়ার হোসেন নামে এক বৃদ্ধ।
এমন অনিয়ন্ত্রিত মৃত্যুর ঘটনা যাত্রীসহ সাধারণ মানুষ সবাই আতঙ্ক রয়েছে। এই বিষয়টি সচেতন মহলকে ভাবিয়ে তোলেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে দীর্ঘদিন ধরে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে চলছে। প্রায় সময়ই দুর্ঘটনায় মানুষের তাজা প্রাণ ঝড়ে পড়ছে এই সড়কে। ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক, প্রতিযোগিতামূলক ওভারটেক করা, অদক্ষ চালক, অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহণ, সড়কে হাঁটার সময় মোবাইল ফোনে আলাপ, মাদক সেবনরত অবস্থায় গাড়ি চালানো, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, ট্রাফিক সিগন্যাল না মানা, মহাসড়েকর উপর হাট-বাজার বসানো ইত্যাদি কারণে ঘটছে এসব দুর্ঘটনা। এর মধ্যে সব চেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক, প্রতিযোগিতামূলক ওভারটেক করা, চালকের অদক্ষতার কারণে। এছাড়াও বাহির থেকে আসার পর্যটকবাহী নানা রকম গাড়ির বেশি দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার সোসাইটির সভাপতি কমরেড গিয়াস উদ্দীন বলেন, ‘শুধু কক্সবাজারে নয়; পুরো দেশে সড়ক দুর্ঘটনা এক মহামারীতে পরিণত হয়েছে। এটি ঘাতকটি আমাদের সম্ভাবনাময়ী অনেক মানুষ কেড়ে নিচ্ছে। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কর্তৃপক্ষের কোনো সদিচ্ছা আছে বলে মনে হয় না। তাহলে আমরা কি বলতে পারি, আর কত মৃত্যু চাই?’
ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ পরিদর্শক নূরুল আমিন বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় চালক ও প্রশাসন সমানভাবে দায়ী। একই সাথে পথচারীরা দায়ী অনেক ক্ষেত্রে। যেমন, সড়কের পাশে পর্যাপ্ত জায়গা নেই, অনেক স্থানে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকে সতর্কতা মুলক সাইনবোর্ড নেই। এতে চালকেরা নিয়ন্ত্রণ হারায়। অন্যদিকে বেপরোয়া ওভারটেকিং, অবৈধ গাড়ি রোধ, অদক্ষ ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় প্রশাসন। এসব কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। পাশপাশি পথচারীদেরও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তবেই দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা যাবে।’
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)’র কক্সবাজার জেলা সভাপতি জসিম উদ্দীন কিশোর বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনা এখন মানুষের আতঙ্কে প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা-ই একটি পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি করছে। এই ক্ষতি কখনো পুষিয়ে উঠা সম্ভব নয়।’
তিনি বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করতে হলে দুর্ঘটনার কারণ জানতে হবে। কারণ খোঁজে বের করে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। একই সাথে সবাইকে নিয়ম মানতে হবে। চালক, যাত্রী, পথচারী ও গাড়ীর মালিক থেকে শুরু করে সবাই সচেতন হয়ে দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করতে হবে।’
রামু তুলাবাগান হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির পরির্দশক (ওসি) ইউসুফ মিয়া বলেন, ‘অদক্ষ-অপ্রাপ্ত চালক, অবৈধ ও ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এসব অপরাধে মাসে আমার এরিয়ায় ৮০/৯০ টি মামলা হচ্ছে। এছাড়াও সচেতনতামুলক সভা-সেমিনারসহ নানা কর্মসূচী আয়োজন করা হচ্ছে । সর্বোপরি সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সবাইকে সচেতন হতে হবে।’