শাহেদ মিজান

এক কঠিন পরিস্থিতির উপর দাঁড়িয়ে কালারমারছড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেন সাবেক চেয়ারম্যান ওসমান গণির পুত্র তারুণ্য জ্বলমল তারেক বিন ওসমান শরীফ। নির্বাচনে তিনি শুধু বিজয় হননি, পেয়েছেন ঐতিহাসিক ম্যান্ডেট। ২৩ মে অনুষ্ঠিত এই ঐতিহাসিক নির্বাচনে গণমাধ্যম ক্যাটাগরি থেকে পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছি আমি।
তারেক বিন ওসানের সাথে পরিচয়টা অনেক দিনের। আত্মীয়তায় তিনি ‘বোন জামাই’ হয়। তবে আমাদের মধ্যে সে সম্পর্কটার তেমন প্রভাব নেই আদৌ। মূলত তারেক শরীফের সাথে সম্পর্কটা আমার পেশাগত কারণে। বিগত পাঁচ বছরে মিডিয়ার সংবাদের খাতিরে তারেকের সাথে অনেক কথা হয়েছে। তাকে নিয়ে আমি অনেক প্রতিবেদনও করেছি। ২০১৬ সালে ফেব্রুয়ারিতে দলীয় মনোনয়নের বিড়ম্বনার সময়ে তাঁর একটি সাক্ষাতকার আমি নিয়েছিলাম। এই সাক্ষাতকারটা অনেক পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিলো।


যাপিত সময়ে শুনে এসেছি, তারেক শরীফ অনেক জনপ্রিয় একজন তরুণ নেতা। কক্সবাজারের দেখা হলে কালারমারছড়ার মানুষেরা তার জনপ্রিয়তার কথা জানাতেন। শুধু কালারমারছড়ার মানুষ নয়; মহেশখালীর উপজেলা; বিশেষ করে উত্তর মহেশখালীর মানুষগুলো তারেকের অনেক জনপ্রিয়তার বয়ান করতেন। আমি জনগণের মুখে শুনে তারেককে বিপুল জনপ্রিয় বলে বিশ্বাস করতাম।
তবে ২৩ মে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে গিয়ে যা দেখেছি তা অবিশ্বাস্য! এটা মানুষে মুখে শোনা জনপ্রিয়তার চেয়ে অনেক অনেক উপরে। ওইদিন স্বাভাবিকভাবে সব কেন্দ্র কয়েকবার করে পরিদর্শন করার সুযোগ হয়েছে। সবখানে দেখেছি তারেকের মোটরসাইকেল প্রতীকের মানুষের পদচারণা। শুধু এক জায়গায় দেখেছি নৌকা প্রতীকের কয়েকজন সমর্থককে। ধানের শীষেরটা তেমন চোখে পড়েনি। এমনকি ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীর কেন্দ্রে দেখেছি লাইনে দাঁড়ানো ভোটাররা মটরসাইকেলের শ্লোগান দিচ্ছে। এ এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার বটে!
এ গেলো শুধু কালারমারছড়ার কথা। কিন্তু আশ্চর্য্য হওয়ার বিষয়টি অন্য জায়গায়। কালারমারছড়ার নির্বাচন নিয়ে মাতামাতি শুধু সেখানে সীমাবদ্ধ থাকেনি। পুরো উত্তর মহেশখালীর মানুষ এই নির্বাচন নিয়ে শুরু থেকেই সরব ছিলেন। কিন্তু ভিন্নতা অন্য জায়গায়।
সাংবাদিক হিসেবে নির্বাচনে যাওয়ায় ওই দিন বাইরের ইউনিয়নের অনেক ধরণের পরিচিত মানুষ প্রতিমুহূর্ত আমাকে ফোন করে নির্বাচনের খবরা-খবর জানতে চেয়েছেন। কিন্তু একটি মানুষও পাইনি যিনি নৌকা বা ধানের শীষে ভোট কেমন পড়ছে জানতে চেয়েছেন। সবার একটা প্রশ্ন- মটর সাইকেলে ভোট কেমন পড়ছে। আরেকটি বিষয়ে জানতে চেয়েছেন ওই মানুষগুলো। সেটি হলো- ভোট কী কেটে নিবে। ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত সবাই এই দু’বিষয়ে বারবার ফোন করে জানতে চেয়েছেন। এসময় সবাইকে খুব বেশি উদ্বিগ্ন শুনতে পেয়েছি। যেন নিজের খুব কাছের কেউ নির্বাচন করছে।


নির্বাচন শেষ করে নিজ ইউনিয়ন হোয়ানকে ফিরেছি ৫টার দিকে। দেখি রাস্তার মোড়ে মোড়ে মানুষের জটলা। আমাকে পেয়ে সবাই যেন অস্থির! কি হবে, তারেক কী চেয়ারম্যান হবে? অনেকে যেন টেনশনে চুল ছিড়ে খাবে! কিন্তু কেউ জানতে চায়নি সেলিম চৌধুরী বা এখলাস কি চেয়ারম্যান হবে? এই এক আশ্চর্য্য ব্যাপার। তবে আমি সবাইকে আশ্বস্ত করতে পেরেছিলাম- তারেক চেয়ারম্যান হবে। কেননা ভোটের চিত্রটা আমি সেভাবে দেখেছি।
২৫ মে পর্যন্ত নিজ এলাকা হোয়ানকে ছিলাম। এই তিন দিনে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরেছি। মনে হয়েছে নির্বাচন হোয়ানকে হয়েছে। তারেক হোয়ানকের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। কী আশ্চর্য্য! এত মাতামাতি আমি কখনো হোয়ানকের নির্বাচন নিয়েও দেখিনি। খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি উত্তর মহেশখালীর অন্যান্য ইউনিয়ন মাতারবাড়ি, ধলঘাটা শাপলাপুরের মানুষও তারেককে নিয়ে এমন মশগুল রয়েছেন।
নির্বাচনের দিন থেকে শেষ পর্যন্ত তারেকের যে জনপ্রিয়তা সচক্ষে আমি দেখিছি তার সাথে মানুষের মুখে শোনা জনপ্রিয়তার ব্যবধান আকাশ-পাতাল। সবে রাজনীতি শুরু করা এক তরুণ কিভাবে অর্জন করলো এত মানুষের ভালোবাসা? আমি অনেককে জিজ্ঞেস করেছি কেন তারা তারেককে এত ভালোবাসে। অধিকাংশই ভালোবাসার কারণটা স্পষ্ট করে বলতে পারেনি। তাদের মতো আমিও বোঝে উঠতে পারিনি, একটি তরুণ কিভাবে হঠাৎ এতো জনপ্রিয় হয়ে উঠলো?


তারেকের জনপ্রিয়তার পিছনের কথা তালাশ করতে গিয়ে জানতে পারি, তিনি গরীব-দুঃখী ও অসহায় মানুষের জন্য অতন্দ্র থাকতেন। যেকোনো বিপদে কেউ তাঁর কাছে গেলে কখনো খালি হাতে বা হতাশ হয়ে ফিরেনি। গোরকঘাটা-জনতাবাজার সড়কের কালারমারছড়া ইউনিয়ন অংশে সড়ক ডাকাতি পুরো উপজেলার মানুষ ভুক্তভোগী। খুব নিকট এই সড়কে রাত নামলেই শুরু হতো যানবাহনে গণডাকাতি। পান, লবণসহ মহেশখালী থেকে রপ্তানি হওয়া বিভিন্ন পণ্যের গাড়ি এবং দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আমদানি হওয়া বিভিন্ন মালামালের গাড়ি ডাকাতির শিকার হতো। এছাড়াও যাত্রীরা ডাকাতির শিকা হয়ে স্বর্ণালঙ্কার ও টাকাসহ বিভিন্ন জিনিষ হারাতেন। বিগত কয়েক বছর এই ডাকাতির মাত্রাটা অনেক কমে এসেছে। এই ডাকাতি রোধে তারেকই ভূমিকা রেখেছেন বলে লোকজন জানিয়েছেন। তারপরও মাঝে-মধ্যে ডাকাতি হতো। তবে ডাকাতি হলেও বিগত দু’তিন বছরে লুট হওয়া জিনিসপত্র ফিরে পেয়েছে অনেক ভুক্তভোগী। খবর পেলে তারেক নিজে উদ্যোগী জিনিষগুলো উদ্ধার করতেন এবং নিখুঁতভাবে তা ফিরিয়ে দিতে ভুক্তভোগীর হাতে। বর্তমানে এই সড়কে ডাকাতি শতভাগ নির্মূল হয়েছে।
তারেকে জনপ্রিয়তার পেছনের গল্পের দ্বিতীয় কাহিনী খোঁজে দেখা গেছে, তিনি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি না হয়েও কালারমারছড়ার বিভিন্ন স্তরের বিচার-সালিশের সমাধান করে দিয়েছেন। লোকজন কোনো সমস্যায় পড়লেই তার কাছে ছুটে যান। যত বড় সমস্যাই হোক ন্যায়নিষ্ঠ ও সুন্দর সমাধান করে দিয়েছেন। বিচারের কাছে তিনি আপন-পর ভেদাভেদ কখনো করেননি।


কোনো গরীব অসহায় মানুষ আর্থিক কোনো সমস্যা ছুটে যান তারেকের কাছে। তিনি কখনো কাউকে খালী হাতে ফেরত দেননি বলে জনশ্রুতি রয়েছে। বিশেষ করে অসহায় মেয়েদের বিয়ে ও অসুস্থ মানুষের জন্য আর্থিকতার হাত বাড়িয়ে রাখেন। এছাড়াও এলাকার নানা সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রেখে এসেছেন। উপরোক্ত এসব কারণে তারেকের জন্য মানুষ পাগল। তিনি আচরণেও অনেক ভদ্র ও অমায়িক।
মাঠ পর্যালোচনা এবং যাত্রাগতিতে বোঝা যাচ্ছে উত্তরমহেশখালীর মানুষ তারেককে আগামীর অনেক বড় সম্ভাবনা হিসেবে দেখছেন। কারণ তারা মনে করেন, রাজনৈতিকসহ নানাভাবে উত্তর মহেশখালী সব সময়ে অবহেলিত। তারেকের মাঝেই তারা উত্তরমহেশখালীকে অবহেলার হাত থেকে উত্তরণের প্রতিচ্ছবি দেখছেন। যেটা তার মরহুম বাবা ওসমান গণির মাঝে মানুষ দেখেছিল। মানুষের আগ্রহ আর চাহিদা স্পষ্টই বোঝা যায়, মহেশখালী বা মহেশখালী-কুতুবদিয়ার আগামী নেতৃত্বের যোগ্য হয়ে উঠছে তারেক। এমনকি সেদিনটাও খুব বেশি দূরে নেই।
তবে তারেক নিয়ে অনেককে আশঙ্কা প্রকাশ করতে দেখেছি। অনেক মানুষ তাঁর প্রাণের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। কারণ শত্রুর কালো হাত তাড়া করছে তাঁকে। সবমিলে নিজেকে নিরাপদ রেখে আগামীর আরো বড় নেতৃত্বের জন্য তৈরি হতে হবে কালারমারছড়ার নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান তারেক বিন ওসমান শরীফরকে। তবে মনে রাখতে হবে পথটা বড় কন্টকাকীর্ণ!

লেখক: গণমাধ্যম কর্মী, কক্সবাজার।