বাংলাট্রিবিউন:

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ছাত্রদলের ২৪৩ জনের কমিটিতে পদ পাওয়া ৫০ জনকেও চেনেন না বলে জানিয়েছেন ঊর্ধ্বতন অনেক নেতা। তাদের অভিযোগ, নতুন কমিটিতে অছাত্র ও প্রবাসীদের পাশাপাশি ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িতরাও স্থান পেয়েছেন।

গত ১৮ মে ঘোষিত বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রদল। নতুন কমিটির ঊর্ধ্বতন যুগ্ম-সম্পাদক পদ পাওয়া মামুনুর রশিদ মামুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২৪৩ জনের কমিটিতে ৫০ জনের বেশি নেতাকে আমরা চিনিই না। এদেরকে কখনও আন্দোলন-সংগ্রামে দেখা যায়নি।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গঠনতন্ত্রে ৮১ সদস্যের কমিটি গঠনের নির্দেশনা থাকলেও তা অমান্য করে পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে ২৪৩ জনকে স্থান দেওয়া হয়েছে। আবার যাদের পদ দেওয়া হয়েছে তাদের অনেকেই ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন। এমনকি, সদ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছেন, কিন্তু এখনও ক্লাস শুরু হয়নি এমন কয়েকজন ছাত্রকেও নতুন কমিটিতে স্থান দেওয়া হয়েছে। এতে ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতারা উপেক্ষিত হয়েছেন।

ঊর্ধ্বতন যুগ্ম-সম্পাদক পদ পাওয়া মামুনুর রশিদ মামুন বলেন, ‘যারা জেল-জুলুম, মামলা-হামলায় নির্যাতিত হয়েছেন তাদের মূল্যায়ন করা হয়নি। কমিটিতে জেষ্ঠ্যতা উপেক্ষা করা হয়েছে। এখনও নবীন বরণ হয়নি এমন অনেকেই কমিটিতে আছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কমিটি হওয়ার আগেই বলেছিলাম, ছাত্রদলে শিবিরের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। কমিটিতে ঠিক তার প্রতিফলন ঘটেছে। বেলাল উদ্দিন নামে একজন কমিটি আছেন, যার বিরুদ্ধে লোহাগাড়ায় শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ আমরা পেয়েছি।’

নতুন কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যারা বিগত সময়ে ক্যাম্পাস রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল তাদের মূল্যায়ন হয়নি। উল্টো যারা আমাদের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুল হুদা মুসাকে হত্যা করেছে তাদের উত্তরসূরি শিবির নেতা-কর্মীরা কমিটিতে স্থান পেয়েছে। আমি নিজেও শিবির নেতাকর্মীদের আক্রমণের শিকার হয়েছি। শিবিরের এজেন্টদের সঙ্গে কোনও আপস নেই। প্রয়োজনে জাতীয়তাবাদী আদর্শকে সমন্নিত রাখতে পদত্যাগ করবো।’

চবি ছাত্রদলের কমিটিতে শিবির বলে যাকে সন্দেহ করা হচ্ছে ( গোল চিহ্নিত)গত বছরের ১৩ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের (২০০৪-০৫ সেশন) শিক্ষার্থী খুরশেদুল আলমকে সভাপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের (২০০৮-০৮ সেশন) শিক্ষার্থী শহিদুল ইসলামকে সাধারণ সম্পাদক করে ৬৯ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রদল। সাত মাস পর গত ১৮ মে ওই কমিটিকে ২৪৩ সদস্যে উন্নীত করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়।

পূর্ণাঙ্গ এ কমিটিতে সহ-সভাপতি পদে স্থান দেওয়া হয়েছে আব্দুস শাকুরকে। অভিযোগ রয়েছে, আব্দুস শাকুর দুবাই প্রবাসী; তার ছাত্রত্ব নেই। একই কমিটিতে যুগ্ম-সম্পাদক পদ দেওয়া হয়েছে এইচ এম বেলাল উদ্দিনকে। অভিযোগ রয়েছে, বেলাল উদ্দিন চট্টগ্রামের লোহাগাড় উপজেলার চুনতি ইউনিয়ন সাতগড় এলাকায় ছাত্র শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তিনি ওই এলাকায় সংগঠনটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া কমিটিতে একমাত্র নারী সদস্য হিসেবে যুগ্ম-সম্পাদক পদে স্থান পেয়েছেন জান্নাতুল আরিফা সুইটি। নতুন কমিটির সদস্যরা এই নারী সদস্যদের পরিচয়ই জানেন না। এই নারী সদস্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন বিভাগে পড়েন, এ ব্যাপারেও কমিটির নেতাদের কাছে কোনও তথ্য নেই।

এদিকে, কমিটি গঠনে ছাত্রদলের গঠনতন্ত্র লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। ছাত্রদলের গঠনতন্ত্রের ১২ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের কমিটিকে সাতজন সহ-সভাপতিসহ ৮১ জন সদস্য বিশিষ্ট হতে হবে। এতে একজন আইন বিষয়ক সম্পাদক থাকবেন। কিন্তু সদ্য ঘোষিত বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে এই নির্দেশনা মানা হয়নি। উল্টো গঠনতন্ত্রে উল্লেখিত সংখ্যার চেয়ে তিনগুণ বেশি সদস্যকে (২৪৩ জন) স্থান দেওয়া হয়েছে। এছাড়া গঠনতন্ত্রে সাতজন সহ-সভাপতি থাকার কথা থাকলেও নবগঠিত কমিটিতে ৭১ জনকে এ পদ দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, নতুন কমিটিতে ২৪৩ জনকে পদ দেওয়া হলেও বাস্তবে তাদের কোনও সক্রিয়তা নেই। কমিটি ঘোষণার দুই দিন পর ২০ মে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে পুলিশি তল্লাশির প্রতিবাদে নগরীতে বিক্ষোভ-মিছিল বের করে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল। ওই মিছিলে মাত্র ২০ থেকে ২৫ জন নেতাকর্মীকে উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে। শুধু ২০ মে’র বিক্ষোভ মিছিল নয়; গত ৮ বছরে ছাত্রদলের কোনও মিছিলে ৪০-৫০ জনের বেশি সংখ্যক সদস্যকে উপস্থিত থাকতে দেখা যায়নি।

এ সম্পর্কে নতুন কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. শহিদুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রায় এক যুগ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। তাই যারা ত্যাগী ছিল, তাদেরকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে কমিটির আকার বড় হয়েছে। সম্ভবত ৪-৫ জনের মতো আছেন যাদের ছাত্রত্ব নেই। আমরা তাদেরকে কমিটিতে রেখেছি, কারণ তারা দুঃসময়ে ক্যাম্পাসে ছাত্রদলকে আগলে রেখেছিলেন।’

আব্দুস শাকুর নামে একজন প্রবাসী পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সহ-সভাপতি পদে রয়েছেন বলে স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘শাকুর ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রান্তিকালে ছাত্রদলকে সুসংগঠিত করেছেন। এ কারণে তাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। মামলা-হামলার ভয়ে বছর খানেক আগে দুবাই চলে যান। এখন তিনি দেশে রয়েছেন।’

চবিতে ছাত্রদলের বিশাল কমিটি হলেও মিছিলে নেতা-কর্মীর স্বল্পতাজেষ্ঠ্যতা লঙ্ঘনের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ‘রাজনীতিতে সিনিয়র-জুনিয়র নির্বাচন করা হয় মাঠে সক্রিয়তার ওপর। আমরাও সেটাই করেছি। তারপরও আমরা সেশনকে প্রাধান্য দিয়েছি।’

মিছিলে সামান্য সংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতির ব্যাপারে শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের আরও ৪ মাস ১১ দিন মেয়াদ আছে। কমিটিতে যতজন আছেন তার চেয়ে দ্বিগুণ সংখ্যক নেতা-কর্মী নিয়ে মিছিল করতে না পারলে আমরা নিজ থেকে পদত্যাগ করবো।’

নতুন কমিটির সভাপতি খুরশেদুল আলম বলেন, ‘এসব অভিযোগের কোনও ভিত্তি নেই। বড় একটা সংগঠনে এ ধরনের অভিযোগ থাকবেই। তারপরও যদি কারও বিরুদ্ধে অন্য সংগঠনে জড়িত থাকার প্রমাণ পাই তবে আমরা তাকে কমিটি থেকে বাদ দেবো।’

তিনি আরও বলেন, ‘পূর্ণাঙ্গ কমিটি হোক তা আমাদের কেউ কেউ চায়নি। তাই তারা এখন ষড়যন্ত্র করছেন।’

কমিটিতে ২৪৩ জনকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে সভাপতি বলেন, ‘কেন্দ্রীয় সংগঠনের নির্দেশে যারা ১/১১ থেকে এ পর্যন্ত দলের জন্য অবদান রেখেছেন যারা তাদের সবাইকে মূল্যায়ন করা হয়েছে।’