ডেস্ক নিউজ:
প্রস্তাবিত ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের বাজেটকে জীবনের ’সর্বশ্রেষ্ঠ’ বাজেট বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। জীবনের শ্রেষ্ঠ এ বাজেটে বিভিন্ন খাতে যেমন করের আওতা বাড়িয়েছেন, তেমনই ১৫ শতাংশ হারে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকরেরও ঘোষণা দিয়েছেন।

এছাড়া ব্যাংকে আমানতের উপর আবগারি শুল্ক প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। সাবান, ফাস্টফুটসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের উপর বাড়িয়েছেন শুল্কহার। এর মানে বিশাল ব্যয়ের এ নির্বাচনী বাজেটের খরচ মেটাতে অর্থমন্ত্রী কর ও ভ্যাটের যে জাল পেতেছেন, তাতে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে ব্যাপকহারে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে বেশ কিছু অসঙ্গতিও রয়েছে। একই ধরনের পণ্যে আমদানি শুল্ক কমিয়ে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। কাঙ্ক্ষিত হারে কর্মসংস্থানে বিনিয়োগ বাড়াতে নেই কোন স্পষ্ট নির্দেশনা। সব মিলিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য এ বাজেট আরও চাপ বাড়াবে।

বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে আগামী অর্থ বছরের বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী।যার শিরোনাম দেয়া হয়েছে ‘উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ : সময় এখন আমাদের’। আকার ধরা হয়েছে ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। বিশাল এ বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে এক লাখ ১২ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বিশাল বাজেটের ব্যয় মেটাতে রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে দুই লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এ অবাস্তব বাজেট কখনও বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার যে বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে এটি নিতান্তই উচ্চাভিলাষী ও অবাস্তব।দেশের ইতিহাসে এমন বাজেট কখনও ঘোষণা হয়নি। কেননা বাজেট বাস্তবায়নে অর্থ সংগ্রহের মতো ভালো ব্যবস্থা নেই। কিংবা ব্যয়েরও সামর্থ নেই।

বাজেটে ভর্তুকি, প্রণোদনা ও ঋণ পরিশোধে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু ভর্তুকি বাবদ থাকছে ৯ হাজার কোটি টাকা। মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দরপতন এবং সরকার কয়েক দফায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণে নতুন অর্থবছরে ভর্তুকির পেছনে সরকারের অর্থ খরচ কম হবে। কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে।

প্রস্তাবিত বাজেটে নতুন আইনে ভ্যাট হার ১৫ শতাংশই বহাল থাকছে। অর্থমন্ত্রী বলেন, ১৯৯১ সাল থেকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপিত হয়েছে এবং তাতে ভোক্তা ও ব্যবসায়ীরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন।আমি ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশেই বহাল রাখার প্রস্তাব করছি। তবে মূল্য সংযোজন কর এক ও অভিন্ন হারে প্রয়োগ করা হবে এবং আগামী তিন বছর তা অপরিবর্তিত থাকবে বলে তিনি জানান।

এ প্রসঙ্গে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, ভ্যাট থেকে রাজস্ব আদায় কতটা বাস্তবায়িত হবে তা নির্ভর করছে এনবিআর ও ভ্যাট প্রদানকারীর দক্ষতার ওপর। ধরে নিতে হবে সবাই অনলাইনে ভ্যাট পরিশোধ করবে, এই সবকিছু ধরে নিয়ে এ লক্ষ্য পূর্ণ হবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।

তিনি বলেন, অর্থায়ন করতে এনবিআরের ওপর চাপ বেশি পড়বে। এনবিআর-বহির্ভূত আয়ে গত বছরের চেয়ে প্রবৃদ্ধি একদমই নেই। অর্থাৎ সরকারের নিজের প্রতিষ্ঠানে দক্ষতা কম এটাই দেখা যাচ্ছে। সরকারি ব্যাংক থেকে কোনো আয়ই হয় না। ফলে জনগণের ওপর চাপ পড়ছে।

এতদিন বছরের যেকোনো সময় ব্যাংক হিসাবে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত থাকলে আবগারি শুল্ক আরোপ করা হতো না। এখন ১ লাখ টাকার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে। ব্যাংক হিসাবে এক লাখ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত থাকলে আবগারি শুল্ক (এক্সাইজ ডিউটি) দিতে হবে ৮০০ টাকা, যা বর্তমানে রয়েছে ৫০০ টাকা। আর ১০ লাখের ওপর থেকে এক কোটি টাকায় বর্তমানে দেড় হাজার টাকা আবগারি শুল্ক দিতে হয়। এখন তা বাড়িয়ে আড়াই হাজার টাকা করা হয়েছে। এক কোটির ওপর থেকে পাঁচ কোটি রাখার ক্ষেত্রে বর্তমানে আবগারি শুল্ক দিতে হয় বছরে সাড়ে সাত হাজার টাকা। শুল্কহার বাড়ানোয় এখন দিতে হবে ১২ হাজার টাকা। আর পাঁচ কোটি টাকার ওপরে থাকলে এক বছরে আবগারি শুল্ক ১৫ হাজার টাকার পরিবর্তে ২৫ হাজার টাকা দিতে হবে। বছরে একবার এই হার কাটা হবে।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বাজেটে ব্যাংক হিসাবে কমপক্ষে ১ লাখ টাকা থাকলে আবগারি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে, যা একদম নীতিবহির্ভূত।’ তিনি বলেন, আমরা আর্থিক খাতের বিস্তৃতি বাড়াতে চাচ্ছি। এ সিদ্ধান্ত সেই লক্ষ্যের পরিপন্থী হচ্ছে। টেলিযোগাযোগের ডেটা ব্যবহারের ওপরও কর বাড়ানো হয়েছে। এটা এ শিল্পের জন্য ক্ষতিকর। ব্যবসা-সহায়ক ইনপুটে আমরা কেন কর আরোপ করব? এগুলো ব্যবসাবান্ধব সিদ্ধান্ত নয়।

অন্যদিকে মোবাইল সেট, ইমিটেশন জুয়েলারি, ব্যাটারি, কিচেনওয়্যার, বিড়ি-সিগারেট, টুথব্রাশ, শ্যাম্পুর দাম বাড়বে। এছাড়া আরও দাম বাড়তে পারে, জর্দা-গুল, জানালার পর্দা, জামা-কাপড়, জুতা, সিরামিকের তৈরি ইট, কম্বল, রেজার, ব্লেড, রঙিন টেলিভিশন, টিভি কার্ড, আসবাবপত্র, স্যানিটারি টাওয়াল, শ্যাম্পু, প্রসাধনসামগ্রী, ডিউড্রেন্ট ইত্যাদি।এর মানে নিত্য প্রয়োজনীয় প্রায় অনেক পণ্যের দাম বাড়ছে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহ উদ্দিন বলেন, বাজেটের যে গাণিতিক হিসাব রয়েছে, তা থেকে এবারের বাজেটও ভিন্ন কিছু নয়। এ বাজেট হচ্ছে সরকারের টাকা আয়ের বাজেট। সরকার টাকা আয় করবে আর সরকারই ভোগ করবে। তিনি আরও বলেন, বেসরকারি বিনিয়োগের কোনো ক্ষেত্র তৈরি হবে না। শিল্পের উন্নয়নে কোনো উদ্যোগ নেই। এক পোশাক শিল্পের উপরেই বাজেটে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এতে অন্য শিল্প গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে।

শিল্প-বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে না উল্লে¬খ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এ গভর্নর বলেন, বিশাল বাজেটের জন্য সাধারণ মানুষের পকেট কেটে টাকা আদায় করা হবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে বাজেটে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।