বিশেষ প্রতিবেদক:
আধুনিকতার এই সময়ে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বেড়েছে বটে তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে রোগ-ব্যাধীও। বড় রোগ ছাড়াও নানা ধরণের রোগ-ব্যাধী এখন মানুষের নিত্য সঙ্গী। তাই এখন প্রায় মানুষকে বলতে শোনা যায়, ‘ডাক্তার খরচ আর ওষুধ কিনতে চলে যাচ্ছে সব টাকা’। হাসপাতাল আর ফার্মেসীতে গেলে মিলবে সেই প্রমাণটুকু! হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকও গুলো যেন ডাকাতির আসর বসিয়েছে! তাইতো চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে অনেক পরিবার ঠিকমতো দিনাতিপাত করতে পারছে না। অনেকে হয়েছেন নি:স্বও! নিন্ম-মধ্যবিত্তরাই এমন দুর্দশার শিকার। ঠিক এমন প্রেক্ষাপটে কক্সবাজারের মানুষের জন্য আশার আলো হয়ে দাাঁড়িয়ে আছে কক্সবাজার ‘হোপ হসপিতাল’। নিন্ম-মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য ত্রাতা হয়ে দীর্ঘ দেড়যুগ ধরে স্বল্প ও বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে এই হাসপাতালটি। এক সময় ক্ষুদ্র পরিসর নিয়ে যাত্রা করা এই মানবসেবার তীর্থ কেন্দ্র আজ যেন মহীরূপ! এই হাসপাতালটির সেবা আজ কক্সবাজারের বিপুল জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। এতে দিকে দিকে ছড়িয়ে গেছে একটি নাম ‘হোপ হসপিটাল’।
কক্সবাজার সদরের অদূরে রামুর চেইন্দায় কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কে অবস্থিত কক্সবাজার ‘হোপ হসপিটাল’। বিশাল এলাকা নিয়ে দু’টি বিশাল ভবন নিয়ে চিকিৎসা সেবার এক মজবুত ভিত গড়ে তোলেছে কক্সবাজার ‘হোপ হসপিটাল’। সরকারি-বেসরকারি বিশেষায়িত হাসপাতালের মতো সব ধরণের আধুনিক ও যথোপযুক্ত সেবা এই হাসপাতালে রয়েছে। তবে মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবার জন্য আলাদা গুরুত্ব রয়েছে সেখানে। মূলত মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে যাত্রা করা হাসপাতালটি সময়ের প্রয়োজনে সব ধরণের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করেছে। এমনকি ফিস্টুলা ও জরায়ুর জটিল চিকিৎসাও অনায়সে মিলছে এই হাসপাতালে।


হাসপাতাল সূত্র জানায়, হোপ ফাইন্ডেশনের উদ্যোগে ১৯৯৯ সালে ঝিলংজার বাংলাবাজারে একটি ভাড়া ঘরে ক্ষুদ্র পরিসরে ‘কক্সবাজার মা ও শিশু হসপিটাল’ নামে যাত্রা শুরু করে। কক্সবাজারের কৃতিসন্তান আমেরিকা প্রবাসী ডা. ইফতিখার মাহমুদ এই হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠান করেন। মানবিক ও কার্যকরী স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে শুরু থেকেই হাসপাতালটি আলোচনায় আছে। বিশেষ করে মা ও শিশু স্বাস্থ্য এবং গরীব ও অসহায় রোগীদের মানবিক সেবা দিয়ে এতদঞ্চলের মানুষের আস্থায় পরিণত হয় হাসপাতালটি। এতে ধীরে ধীরে মানুষের চাহিদা বাড়তে থাকে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ২০০৬সালে রামুর দক্ষিণমিঠাছড়ির চেইন্দায় স্থায়ী ভবন নির্মাণ করে ‘হোপ হসপিটাল’ নামে স্বাস্থ্যসেবার বৃহৎ পরিসর তৈরি করা হয়। এই স্থায়ী ভবন হলে রামু, কক্সবাজার ও উখিয়ার একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মাঝে সাড়া পড়ে যায়। সরকারি-বেসরকারি নানা হাসপাতালের পরিবর্তে ‘হোপ হসপিটাল’ এসব মানুষের নির্ভরতায় প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও বিনামূল্য এবং স্বল্পমূল্যে নির্বিগ্নে এই বিপুল জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করেন। তাই সামান্য জ্বর কিংবা বড় কোনো রোগ বা দুর্ঘটনার সংকটময় রোগীও ছুটে আসেন এই হোপ হাসপাতালে!
পাওয়া যায় সেসব সেবা: সাধারণ জ্বর থেকে নানা ধরণের অপারেশন, সিজার ও নরমাল ডেলিভারি, ফিস্টুলা, জরায়ু অপারেশন, শিশু সেবাসহ সব ধরণের স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হয় ‘হোপ হসপিতাল’। কক্সবাজারের একমাত্র এই হাসপাতালেই ফিস্টুলার অপারেশন করা হয়। তারও অর্ধেকের কম মূল্যে। এছাড়া অপারেশনের ক্ষেত্রে এই পর্যন্ত ইনফেকশনের সংখ্যা শূন্য। এই কৃতিত্বের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে পুরস্কৃত করেছে হাসপাতালটিকে।


অন্যদিকে সকল রোগের প্রয়োজনীয় আধুনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষাও রয়েছে এই হাসপাতালে। ইসিজি, ইউসিজি, প্যাথলজী, এক্সরে, আল্ট্রাসোনোগ্রাফীসহ ২৫টি পরীক্ষা করা হয়। অপারেশনের জন্য রয়েছে আধুনিক অপারেশন থিয়েটার।
হাসাতালের দাপ্তরিক সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালে ২২২৭ জন পুরুষ, ১১৪২৩জন মহিলা, ৭৫৫৫ জন শিশুসহ মোট ২১২০৫জনকে চিকিৎসা দেয়া হয়। তার মধ্যে ১৩৯৪৫জনকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়া হয়। ৩৭৭জনকে নানা ধরণের রোগীকে অপারেশন করা হয়। ১৬০ জন সিজার ও ৩২০জন মহিলার নরমাল ডেলিভারি করানো হয়। ২২জন পোড়া রোগীকে চিকিৎসা দেয়া হয়। ২০১৭ সালে এই হারে চিকিৎসা সেবা চলছে।
হাসপাতালে প্রধান চিকিৎসক লে. কর্ণেল নূর হোসেন জানান, সকল রোগীর ক্ষেত্রে মাত্র ১০০ টাকা ফি নেয়া হয়। তবে গরীব রোগী হলে বিনা ফিতে দেখা হয়। গরীব রোগীদের বিনামূল্যে ওষুধ দেয়া হয়। ডেলিভারিসহ মহিলাদের জন্য বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়।
৮ মে হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, মূল ভবনে রয়েছে সুসজ্জিত রোগী ওয়ার্ড। তার মধ্যে রয়েছে শিশু ওয়ার্ড, মহিলা ওয়ার্ড, সিজার ওয়ার্ড, সাজারী ওয়ার্ড, পুরুষ ওয়ার্ড, ডায়রিয়া ওয়ার্ড। সব ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি রয়েছে। তবে মহিলা ও শিশুর রোগী বেশি দেখা গেছে। এছাড়া দু’জন ফিস্টুলা রোগীও তিনজন জরায়ু অপারেশন রোগী দেখা গেছে।
নবজাতকের চিকিৎসা নিতে আসা রামুর রশিদ নগরের গৃহবধূ রশিদা বেগম বলেন, ‘রশিদ নগর থেকে রামু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দূরত্ব ‘হোপ হসপিটাল’ থেকে বেশ কম। তারপরও আমরা সেখানে চিকিৎসা নিতে যাই না। এমনকি কক্সবাজার যাওয়াও সহজ। তারপরও হোপ হসপিটালে চিকিৎসা নিতে আসি। কারণ আমার বিশ্বাস এখানে কম মূল্যে ভালো ও নির্ভুল চিকিৎসা দেয়া হয়। তার চেয়ে বড় বেশি ভালো লাগে ডাক্তার ও নার্সদের আচরণ। তারা রোগীদের সাথে অত্যন্ত সুন্দর আচরণ করেন।’


উখিয়া উপজেলার মরিচ্যার থেকে আসা খালেদা আকতার বলেন, ‘গর্ভবতী হওয়ার শুরু থেকেই এই হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু করি। নিয়মিত চেকআপ করিয়েছি। আল্লাহর রহমতে সুষ্ঠুভাবে নরমাল ডেলিভারি হয়েছে। এই দীর্ঘ চিকিৎসায় যা খরচ হয়ে তা অনেক কম বলে আমি মনে করি।’

‘হোপ হসপিটালের কো-অর্ডিনেটর রাকিবুল হক জানান, হাসপাতালে সার্বক্ষণিক আট জন অভিজ্ঞ চিকিৎসক সেবা প্রদান করে থাকেন। এর মধ্যে তিনজন গাইনি চিকিৎসক, একজন নাক-কান-গলা ও শিশু চিকিৎসক, তিনজন মেডিসিন ও একজন এনেসটিসিয়াল। হাসপাতালের রক্ষণাবেক্ষণে রয়েছেন কান্ট্রি ডাইরেক্টরসহ সাতজন কর্মকর্তা এবং নার্সসহ ১৩০ জন কর্মচারী । শিফটে ২৪ ঘণ্টা স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়।
চিকিৎসা সেবাও ছাড়াও একটি আধুনিক মেডিকেল শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করছে এই প্রতিষ্ঠানটি। এই হাসপাতালের অধীনে নিয়মিত ধাত্রী বিদ্যাসহ আরো কয়েকটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তার মধ্যে যাত্রী বিদ্যা প্রশিক্ষণ স্থায়ী ও পেশাদারভাবে চলছে। তিন বছরের কোর্সের এরই মধ্যে ২৯ জনের এক ব্যাচ বের হয়ে গেছে। ২৯ ও ২০ জনের আরো ব্যাচ প্রশিক্ষণ চলছে। বের হওয়া ২৯ জনের মধ্যে ২৫জনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অস্থায়ী নিয়োগ হয়েছে। তবে তাদেরকে পূর্ণাঙ্গ করে নেবেন বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন।

‘হোপ হসপিটালের প্রতিষ্ঠাতা ইফতেখার মাহমুদ।

হোপ ফাইন্ডেশনের কান্ট্রি ডাইরেক্টর এস.এম ফেরদৌসুজ্জামান পিএসপি বলেন, ‘মূলত গরীব ও অস্বচ্ছল রোগীদের টার্গেট করে ‘হোপ হসপিটাল’ চিকিৎসা সেবা। আমাদের মাননীয় প্রতিষ্ঠাতা ইফতিখার মাহমুদ তাঁর জন্মস্থান কক্সবাজারের মানুষের জন্য হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। আমরা তাঁর নির্দেশনা মতো অত্যন্ত সুন্দর পরিবেশে সুষ্ঠু ও ভালো চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করেছি। আমরা চাই শুধু গরীব সব ধরণের রোগী আমাদের কাছে চিকিৎসা নিতে আসুক। আমরা গরীবদের বিনামূল্যেসহ সবার জন্য স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা দিয়ে যাবো।’