আতিকুর রহমান মানিক

পবিত্র মাহে রমজানের ১৮ দিন গত হচ্ছে  আজ। আমাদের দ্বারে সমাগত বরকতময়  ইতিক্বাফ। আগামী শুক্রবার অর্থাৎ ২০ রোজার দিন সূর্যাস্তের আগেই পরবর্তী ১০ দিনের জন্য মসজিদে অবস্হান নেবেন ইতিক্বাফ প্রত্যাশীরা। সংযম ও আত্নশুদ্ধির প্রতীক রমজান মাসের অন্যতম নিয়ামত হল ইতিক্বাফ। আর এ মাসেই রয়েছে পবিত্র লাইলাতুল কদর, যা হাজার রাতের চেয়েও উত্তম। অারবী শব্দ ইতিক্বাফের আভিধানিক অর্থ হলো বাধ্যতামূলকভাবে কোনো কিছুকে ধরে রাখা। আর আহকামে শরীয়াহর পারিভাষায়, আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে মসজিদে অবস্থান করার অপর নাম ইতিক্বাফ।
ইতিক্বাফের মূলভাবধারা হলো নির্দিষ্ট লক্ষ্যবিন্দুতে মন-মগজকে এমন দৃঢ়ভাবে নিবদ্ধ রেখে অবস্থান করা যে, সেদিক থেকে দৃষ্টি মোটেও অন্যকোনো দিকে ফিরবে না। অর্থাৎ মসজিদে অবস্থান করাই হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যে। অন্য কোনো দিকে দৃষ্টি দিতে গেলে লক্ষ্যে পৌঁছা বিঘ্নিত হবেই।
ইতিক্বাফ মূলত লাইলাতুল কদরের ফায়দা অর্জন ও নাজাত লাভের এক ঐশী আয়োজন। অন্য কথায় বলতে গেলে ইতিক্বাফ অনেকটা দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য অবস্থান ধর্মঘটের মতো। যতক্ষণ দাবি-দাওয়া আদায় না হবে ততক্ষণ অবস্থান থেকে একটুও নড়া হবে না। অনুরূপভাবে আল্লাহ তায়ালা যতক্ষণ পর্যন্ত লাইলাতুল কদরের বরকত ও ফজিলত লাভের সুযোগ না দিবেন ততক্ষণ পর্যন্ত আমি রমজান মাসে এই মসজিদ ছাড়া কোথাও নড়ব না, এই হল ইতিক্বাফ।
ইতিক্বাফকে বলা যায় বান্দাহকে রিলিফ দেয়ার জন্য আল্লাহতায়ালার ধার্যকৃত একটি সময়কাল। আল্লাহতায়ালার অনুগ্রহ ও সান্নিধ্য লাভ, গুনাহ-খাতা মাফ এবং বড় মাফের মর্যাদা অর্জনের জন্য একটি বিশেষ ওয়ার্কশপ।
ইতিক্বাফের আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে। তা হল,
১. ইতিক্বাফ রোজার ত্রুটিসমূহের ক্ষতিপূরণ করে। ২. আল্লাহপাক ইতিক্বাফকারীদের গুনাহর দরজা বন্ধ করে দেন। ৩. কুচিন্তা, কুকথা ও কুকাজ থেকে বিরত থাকার এক মহা প্রশিক্ষণ ইতিক্বাফ। ৪. সকল বিষয়ে সংযম শিক্ষা দেয়। ৫. ইতিক্বাফে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রয়োজনে ঘরবাড়ি, স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়-স্বজন, চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য সকল কিছু ত্যাগের জজবা পয়দা হয়। ৬. ইতিক্বাফ হলো রোজাদার বান্দার কাছ থেকে লাইলাতুল কদরের মতো মূল্যবান রাতটি যাতে হাতছাড়া হয়ে না যায়, মনিবের তরফ থেকে তারই হিকমতপূর্ণ ব্যবস্থা। ৭. হাদীসে বলা হয়েছে, ইতিক্বাফকারী যাবতীয় গুনাহ থেকে বেঁচে যায়। তার জন্য নেকীহসমূহ লিখা হয় ঐ ব্যক্তির মতো যে যাবতীয় নেক কাজ করে। ( ইবনে মাজাহ)
ইতিক্বাফ সুন্নতে মুয়াক্কাদা কিফায়া। ইতিক্বাফ বিনা ওজরে ত্যাগ করা ঠিক নয়। তবে মসজিদ এলাকায় কোনো একজন যদি ইতিক্বাফ করে তাহলে এলাকার সবাই দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবে। আর কেউ না করলে সকলের ঘাড়েই দায়িত্ব চেপে থাকবে। আমরা ছোটখাট অজুহাত যোগাড় করে এমন একটি ফজিলতপূর্ণ কাজে অবহেলা করি। ফলে বিরাট মর্তবা থেকে বঞ্চিত হই।
বিশ্ব ইতিহাস সাক্ষী এ পৃথিবীতে রাসূলে করীমের (সা.) মতো এতবড় ও এত কঠিন কোনো কাজের আঞ্জাম কেউ দিতে পারেনি। তিনি হাজারো বাধা বিপত্তি, ঘাত-প্রতিঘাত পায়ে দলে নিজ পরিবার থেকে শুরু করে আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী, সমাজ ও রাষ্ট্র সকলের হক আদায় করেছেন অতি সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে। আবার আল্লাহতায়ালার ইবাদত-বন্দেগীতেও তিনি ছিলেন সকলের অগ্রগামী। এতদসত্ত্বেও তিনি ইতিক্বাফ জীবনে খুব কমই ছেড়েছেন। তিনি যদি জীবনে ইতিক্বাফ দু’একবার ত্যাগ না করতেন তাহলে তাঁর উম্মতের ওপর ইতিক্বাফ করা ফরজ হয়ে যেতো। অনেকের পক্ষেই তা আদায় করা কঠিন হয়ে পড়তো। তাই যাদের তেমন কোনো ওজর নেই তাদের উচিত এই মর্তবাপূর্ণ ইবাদতে শামিল হয়ে লাইলাতুল কদরের রহমত, বরকত ও ফজিলত হাসিল করে আল্লাহতায়ালার প্রিয়ভাজন হবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা।
ইতিক্বাফকারীদের জন্য কয়েকটি কাজ নিষেধ আছে।
১. প্রাকৃতিক প্রয়োজন ছাড়া মসজিদ থেকে বের হওয়া যাবে না। ২. স্ত্রী সহবাস করার সুযোগ নেই। ৩. রোগী দেখার জন্য যাওয়া যাবে না। ৪. দূরে কারো জানাজায় যাওয়া যাবে না। ৫. রোজা ভঙ্গ করা যাবে না। তাহলে ইতিক্বাফ হবে না। ৬. পুরুষেরা জামে মসজিদ ছাড়া ইতিক্বাফ করতে পারবে না।
লাইলাতুল কদর বা শবে কদর।
কদর শব্দের দু’টি অর্থ : ১. মর্যাদা নির্ধারণ,  ২. লাইলা বা শব অর্থ : রাত। সে হিসাবে লাইলাতুল কদর বা শবে কদর অর্থ হলো মর্যাদার রাত্রি, ভাগ্য নির্ধারণের রাত্রি।
লাইলাতুল কদরে ইবাদত করে পাপী-তাপী বহু মর্যাদাহীন মানুষও পাপ-তাপ মুক্ত হয়ে মর্যাদাবান হয়ে যায়। আবার এই রাতেই মানুষের সারা বছরের ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়। তাই এই রাতের নাম লাইলাতুল কদর বা শবে কদর। শবে বরাতকে ভাগ্য রজনী বলা হয়। কিন্তু কথাটা সঠিক নয়। কারণ এক বছরে আল্লাহর দু’বার ভাগ্য নির্ধারণের বিষয় কুরআন হাদীসে পাওয়া যায় না।
রাসূল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমান এবং ইতিসাবের জন্য কদরের রাতে দাঁড়ায় (দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করে) আল্লাহতায়ালা তার পূর্বের গুনাহসমূহ মাফ করে দেন। (বুখারী)
আল্লাহতায়ালা বলেন, কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও শ্রেয়। আল কদর : ৩.
বছর হিসেবে হাজার মাস ৮৩ বছর ৪ মাস আর রাত হিসেবে ৩০ হাজার রাত। যে ব্যক্তি এই একরাতে ইবাদত করবে সে ৩০ হাজার রাতের ইবাদত থেকে বেশি নেকী অর্জন করবে। আসলে আরবীতে হাজার শব্দ ব্যবহার করা হয় আধিক্য বুঝাবার জন্য। আল্লাহতায়ালাই জানেন এই হাজারের আধিক্য কত বেশি।
লাইলাতুল কদরের এত বরকত ও ফজিলত ঐ সকল ব্যক্তিদের জন্য যারা নিয়মিত নামাজ-রোজা করে। যারা সারা বছর নামাজ, রোজা করেনি কেবল কদরের এক রাত ইবাদত করেই হাজার মাসের ফায়দা হাসিল করে ফেলবে এটা কি করে হতে পারে? তবে হ্যাঁ, যে ব্যক্তি তাওবা করে ওয়াদা করবে যে, আজ থেকে নামাজ, রোজা ছাড়ব না, হে আল্লাহ! তোমার সকল প্রকার নাফরমানী থেকে বেঁচে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করব। হয়তো দয়াময় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে তার ইবাদত কবুল করতে পারেন। কদর রাতের ইবাদতে বহুত বরকত ও ফজিলত রয়েছে। কেউ যদি উক্ত রাতে ইবাদত না করে সে ফজিলত থেকে বঞ্চিত থাকতে পারে, কিন্তু গুনাহগার হবে না। পক্ষান্তরে দিনে রাতে পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের এক ওয়াক্ত ইচ্ছে করে কাজা করলে বহুকাল দোজখের আগুনে জ্বলতে হবে। যারা সারা বছর নামাজ পড়ে না তারা কদর রাতের ফজিলত কতটুকুই বা আশা করতে পারে? তবে তাদেরকে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ করতে চাই না। পরামর্শ দিতে চাই এই মহামুক্তির রাতে তাওবা করে শপথ নিতে হবে যে, জীবনে আর কখনো নামাজ-রোজা ও ইসলামের বিধিবিধান মেনে চলতে গাফেলতি করবো না।
কদরের রাতে যে দু’আটি বেশি বেশি পড়তে হয় তা হলো, আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন গাফুরা, তুহিব্বুল আফুউয়া, ফাআফুআন্নী। হে আল্লাহ! নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতেই ভালোবাসেন অতএব, আমাকে ক্ষমা করে দিন।
হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা লাইলাতুল কদর তালাশ করবে রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে। (বুখারী)।
মুসলিম শরীফের একটি হাদীসে ২৭ রমজানের রাতকেই কদরের রাত হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে।
আমরা শুধু রমজানের ২৭ রাতই নয় অন্যান্য বেজোড় রাত যেমন : ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ রাতেও কদর খুঁজবো। আর এ জন্য সর্বোত্তম পন্হা হলো ইতিক্বাফ। জাগতিক, সাংসারিক ও বৈষয়িক সব ঝুট-ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে চলমান রমজান মাসের শেষ দশদিন ইত্বেকাফ করে আল্লাহ আমাদের কদর রাতের বরকত ও ফজিলত হাসিলের তাওফিক দান করুন। আমীন। ইতিক্বাফ শুরু হতে আরো ৮ দিন বাকী আছে। এরি মধ্যে যে কেউ প্রস্তুতি নিতে পারেন। ইদানীং তরুনরাও প্রচুর সংখ্যায় ইতিক্বাফে বসছেন। প্রতিবছর রমজানে শহর ও পাড়া-মহল্লার মসজিদ গুলোতে এমন দৃশ্যই চোখে পড়ে। চলতি রমজানে ইতেক্বাফের জন্য আপনাকেও আল্লাহ কবুল করুন, আমিন।

==========================

আতিকুর রহমান মানিক
ফিশারীজ কনসালটেন্ট ও সংবাদকর্মী,
চীফ রিপোর্টার,
দৈনিক আমাদের কক্সবাজার।
মুঠোফোন ০১৮১৮-০০০২২০