মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ :
আইয়ান হিরসী বর্তমান বিশ্বের অন্যতম মুসলিম বংশোদ্ভুত শকিশালী বুদ্ধিজীবী। সোমালীয় একটি মুসলিম রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম গ্রহণকারি এই ভদ্র মহিলা বিশ্বব্যাপী প্রভাবশালী ও পান্ডিত্যপূর্ণ জ্ঞান রাখেন এমন একজন রমনী। তিনি নিজেকে এখন নিরেশ্বরবাদি হিসেবে পরিচয় দিতে অধিক পছন্দ করেন। লেখালেখি করেন, ভাষণ দেন, সভা-সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, বই লিখছেন ও বিশ্ব পান্ডিত্য জগতে বিচরণ করছেন সদর্পে। ইসলাম ধর্মের সকল বিষয়ে তাঁর জ্ঞান অত্যন্ত টনটনে। আর রাজনীতি, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, বিশ্ব পরিস্থিতি, সন্ত্রাসবাদ, সভ্যতার সংঘাত, নারী অধিকার, মুসলমান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীগণের বিশ্বাস এবং দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদিতা প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর মত দ্বিতীয় কোন বিদূষী নারী ব্যাক্তিত্ত্ব সমসাময়িক বিশ্বে বিরল। তবে, সালমান রুশদী যেমন স্যাটানিক ভার্সেস লিখে মুসলিম বিশ্বে বিতর্কের ঝড় তুলেছিলেন, আইয়ান হিরসীও কম নন। স্বধর্ম ইসলাম ত্যাগ করে নিরশ্বরবাদী পরিচয় ধারণ করে তিনি এখন অনেকটা সালমান রুশদীর মত অবস্থায় পড়ে গেছেন। আর মুসলমানদের জন্য দুর্ভাগ্য বলা যায়, তাঁর মত একজন বর্ষিয়ান নারীকে ইসলামের বিশ্বাসের ধারায় ধরে রাখা সম্ভব হয় নি। তিনি মুসলমান পরিচয়ে থাকতে পারলে, ইসলাম ও বিশ্ব জগতের অনেক উপকার হত বলে আমি মনে করি। তাঁর পিতা তাঁকে বাল্য বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কিশোরী আইয়ান হিরসী তা মেনে নিতে পারেন নি। তিনি অনেক বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে নিকট আত্নীয়-স্বজনের সহায়তায় নেদারল্যান্ডে এসে অভিবাসী হন। সেখানে তিনি খ্রিস্টানদের অনেক ধরণের প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে বড় হন এবং পড়াশোনা করেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করে তিনি ডাচ পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন। এভাবে তাঁর জীবন ও বিশ্বাস পাল্টে যায়। আর মনের মধ্যে গেঁথে থাকা সে কিশোরী বয়সের ক্ষোভ-বিক্ষোভ তাঁকে স্বধর্ম ইসলাম ত্যাগে উদ্বুদ্ধ করে তুলে। মুসলিম যখন ছিলেন, তাঁর পরিচায় ছিল আইয়ান হিরসী মাগান। আর তিনি যখন নিরস্বরবাদী হয়ে যান এবং একজন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী লেখক-ইতিহাসবিদকে বিয়ে করে সংসার শুরু করেন, তখন তাঁর নামে আলী বা মাগান মুছে যায় নি। বর্তমানেও তিনি আইয়ান হিরসী আলী বা হিরসী মাগান হিসেবে বেশি পরিচিত। এ নিবন্ধে তার জীবনের নানা উত্থান-পতনের ঘটনাক্রম এবং তাঁর ভাবনা-চিন্তা তুলে ধরা হব। আর আইয়ান হিরসী মাগানের বহুল আলোচিত বইগুলোর পরিচয় তুলে ধরে ইসলাম কেন তাঁর দৃষ্টিতে বিশ্ব রাজনৈতিক-সভ্যতার কাছে গ্রহনযোগ্য হতে পারছেনা, তাঁর সংক্ষিপ্ত একটি পর্যালোচনা তুলে ধরার প্রয়াস চালানো হবে।
শৈশবকাল ও পড়াশোনা:
আইয়ান হিরসী সোমালিয়ার রাজধানী মুগাসিুতে ১৯৬৯ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হিরসী মাগান ছিলেন, সোমালিয়ার একজন পরিচিত রাজনীতিক ছিলেন। আইয়ান হিরসীর জন্মের পর পরই তৎকালিন সোমালীয় সরকার প্রধান সাঈদ বারীর বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী হওয়ায়, তাঁর বাবা কাররুদ্ধ হন। আর হিরসী আলীর পিতা বিদেশে উচ্চতর পড়াশোনা সমাপনকারি আধুনক মানুষ হিসেবে নারী শিশুর খতনা করার বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু কারবরণ করার কারণে পিতার অবর্তমানে পিতামহ আইয়ান হিরসী আলীকে খতনা করিয়ে দেন ৫ বছর বয়সে। আর কাজটি একজন পুরুষ চিকিৎসক কতৃক সম্পাদিত হওয়ায়, হিরসী আলীর ভাষায় কাজটি করার সময় তার তেমন কষ্ট হয়নি। আর এ কাজটি কোন মহিলা দ্বারা করা হলে, তাঁর কষ্ট বেশি হত বলে তিনি মনে করেন। কারারুদ্ব আইয়ান হিরসী আলীর পিতা ১৯৭৭ সালে জেল হতে পালিয়ে স্বপরিবারে সৌদি আরবে পালিয়ে যান। সেখান হতে তাঁর পরিবার ইথোপিয়া হয়ে কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবীতে ১৯৮০ সালে স্থায়ীভাবে বসতি গড়ে তুলেন। আইয়ান হিরসী আলীর পিতা নাইরোবীতে স্বপরিবারে ভালই দিন কাটাচ্ছিলেন। এসময় হিরসী আলী সেখানকার একটি ইংরেজি মাধ্যম হাই স্কুলে পড়াশোনা করছিলেন। তখনকার প্রেক্ষাপটে সৌদি আরব সরকার কেনিয়াসহ অনেক মুসলিম দেশে ধর্মীয় শিক্ষার প্রসারকল্পে অর্থ সহায়তা দিচ্ছিল। আর হিরসী আলীর স্কুলে পড়াতে এলেন, একজন ভাল ধর্মীয় শিক্ষক। তিনি বালিকা হিরসী আলীর মত অনেক শিক্ষার্থীকে সৌদি ভাবধারার ধর্মীয় শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াস চালান। এসময় হিরসী আলী মহাগ্রন্থ আল কুরআন অধ্যয়ন করা সুযোগ পান এবং দীর্ঘদিন কুরআন বিষয়ে পড়াশোনা করেন ও তা চর্চা করেন। মিশর ভিত্তিক মুসলিম ব্রাদারহুড আদর্শে অনুগত হয়ে আইয়ান হিরসী আলী স্কুল বালিকা হিসেবে হিজাব পরিধান করা শুরু করে। সোমলিয়া বা কেনিয়াতে স্কুল ছাত্রীদের জন্য এ ধরণের পোশাক পরিধান অস্বাভাবিক ঠেকলেও, হিরসীর মত অনেক মেয়েই এধরণের পোশাক ব্যবহার করতে থাকেন। সেসময়টাতে ইরানী ধর্মীয় নেতা ইমাম খোমেনী কতৃক সালমান রুশদীর বিরুদ্ধে স্যাটানিক ভার্সেস গ্রন্থ রচানার জন্য মৃত্যুদন্ডের ফতোয়া জারি করলে, আইয়ান হিরসী আলীও অন্য অনেকের মত এ ফতোয়ার স্বপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিল। আর এ ফতোয়া ঘোষণার প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা মুসলমানদের আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতি তিনিও সমর্থন জানিয়েছিলেন। মাধ্যমিক স্তরের পড়াশোনা শেষ করে আইয়ান হিরসী আলী নাইরোবির একটি কলেজে এক বছর মেয়াদী একটি সাচিবিক বিদ্যা বিষয়ক কোর্সে ভর্তি হন। বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে তিনি ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। তিনি সেসময় ‘ন্যান্সি ড্রিউ’-এর মত ইংরেজি রোমাঞ্চকর কল্পকাহিনীর বই প্রচুর সংখ্যায় পড়েন। আর তাঁর দাদী মা ছিলেন একজন সাহসী মহিলা, যিনি দস্যূ প্রকৃতির মানুষজন ও সোমলীয় সেনা সদস্যদের মুখে ছোরা নিয়ে দাড়ানোর মত দু:সাহসী ছিলেন। তাঁর দাদীর এধরণের সাহসসিকতাও আইয়ান হিরসী আলীর কৈশোরিক জীবনে প্রভাব ফেলে এবং নিজেকেও তিনি সাহসী নারী হিসেবে সমাজে-রাষ্ট্রে দাঁড়ানোর প্রেরণা পান। ইতোমধ্যে তার পরিবার জার্মানের ডুসেলডর্ফ এবং বন শহরে চলে গেছে।
নেদারল্যান্ডে হিরসী আলী:
১৯৯২ সালে আইয়ান হিরসী আলী সোমালিয়র শরণার্থী রূপে নেদারল্যান্ডে এসে পৌঁছান। একই বছর তিনি কেনিয়া হতে জার্মানে অবস্থানরত তাঁর পরিবারের কাছে যান। সেখানে তাঁকে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলে এবং একজনের সাথে বিয়েও হয়েছিল তাঁর। কিন্তু তিনি তা মেনে নিতে না পেরে নেদারল্যান্ডে পালিয়ে চলে আসেন বলে বিভিন্ন সময় দাবি করেন। নেদারল্রান্ডে চলে আসার পর তাঁর স্বামী তাঁর নিকট এসছিলেন, যা তিনি অস্বীকার করেন। এক পর্যায়ে হিরসী আলী নেদারল্যান্ডে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন এবং সেদেশে স্থায়ী বসবাসের অনুমতিপ্রাপ্ত হন। এসময় তাঁর পূর্ব পুরুষের টাইটেল আলী তাঁর নামের সাথে যুক্ত করে নেন, তিনি। তিনি এখন আইয়ান হিরসী আলী হিসেবেই পাশ্চাত্যে সুপরিচিত। নেদারল্যান্ডে এসে তিনি প্রথমে ছোটখাট চাকুরি করে জীবন-যাপন করেন। তিনি নেদারল্যান্ডে অবস্থান করতে গিয়ে প্রচুর পড়াশোনার সুযোগ পেয়ে যান এবং ‘সিগমন্ড ফ্রয়েড’সহ বড় বড় লেখকের উচ্চমার্গীয় সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অবাধে অধ্যয়ন করেন। পাশ্চাত্য সমাজ ব্যবস্থা এবং ডাচ সমাজ ব্যবস্থা তাঁকে বেশ প্রভাবিত করে, এসময়। আর তিনি বিভিন্ন ধরণের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহন শুরু করেন। এক পর্যায়ে ২০০০ সালে, আইয়ান হিরসী আলী ‘লীডেন ইউনিভার্সিটি’ হতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৯৫ সালে হতে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি সোমালীয় অভিবাসীদের মাঝে দোভাষী হিসেবে কাজ করেন। আর অভিবাসী সোমালীদের প্রতি ডাচ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ তাঁর মন:পুত না হওয়ায়, তিনি তাদের জন্য আন্দোলনমুখি হয়ে উঠেন। আর ডাচ, সোমালীসহ অন্যান্য অভিবাসীদের সাথে কাজ করতে গিয়ে তাঁর পড়াশোনায় গভীরতা বৃদ্ধি পায় এবং তিনি ভাষা জ্ঞান সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। আর তিনি ইংরেজি, সোমালী, আরবী, সোয়াহী, আমহারিক এবং স্থানীয় ডাচ; এ ৬টি ভাষায় বেশ পারদর্শীতা অর্জন করেন।
রাজনৈতিক জীবন:
ইউরোপীয় দেশ নেদারল্যান্ডে বসবাস করার সুবাধে আইয়ান হিরসী আলী আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়ে তাঁর জীবন দর্শনে ব্যাপক পরিবর্তন বয়ে আনেন। তিনি ইসলাম ধর্মের প্রতি অনুরাগ হারিয়ে ফেলছিলেন, এ সময়। বিশেষত: ২০০১ সালে ৯/১১-এ নিউইয়র্ক শহরে টুইন-টাওয়ার ধ্বংস প্রক্রিয়া ও হাজারো মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় মুসলামনদের সম্পৃক্ততা তাঁর ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস ও জীবন দর্শনকে বেশ নাড়া দেয়। তিনি টুইনটাওয়ার ধ্বংসযজ্ঞ এবং পরবর্তী ঘটনাক্রম ভালভাবে বুঝার চেষ্টা করেন। আল-কায়েদা এবং ওসামা বিন লাদেনের বক্তব্য এবং তাদের তৎপরতা তাঁর কাছে ভাল লাগে নি। আইয়ান হিরসী আলী পবিত্র কুরআন শরীফ এবং হাদীস শরীফ অধ্যয়ন করে ইসলামী জ্বিহাদ, আল-কায়েদা ও লাদেনদের কুরআন-হাদীস উদ্ধৃত করে সন্ত্রাসবাদের পক্ষে প্রদত্ত্ব নানা যুক্তি-তর্ক প্রদর্শন প্রভৃতিতে অসরতা খেুঁজে পান। অতপর, তাঁর ধর্ম বিশ্বাসসহ সবকিছুকে তিনি তাঁর মত করে অনুধাব ও ব্যাখ্যা দানে সক্রিয় হন। পাশাপাশি, তিনি নিরশ্বরবাদিতাসহ অন্যান্য দার্শনিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসমূহও অধ্যয়ন করেন। তাঁর লীডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হার্মান ফিলিপস-এর উৎসাহে এবং ডাচ দার্শনিক-চিন্তাবিদগণের ভাবনা-চিন্তা ও নিরেশ্বরবাদিতার দর্শনে প্রভাবিত হয়ে আইয়ান হিরসী আলী নিজেকে সেদিকে নিয়ে যান। তিনি ইসলাম ধর্মের কট্ট্রর সমালোচক হয়ে ওঠেন এবং এসব নিয়ে প্রচুর লেখালেখি করেন ও টেলিভিশন টক শো’সহ বিভিন্ন ফোরামে তাঁর ভানা-চিন্তা তুলে ধরতে থাকেন। অপরদিকে, তাঁর এসব মতামত প্রকাশ; তাঁকে মুসলিম সমাজ এবং ডাচ সমাজে অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয় এবং তিনি জীবনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করেন। আইয়ান হিরসী আলী এ পরিস্থিতি হতে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন এবং রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় খোঁজার চেষ্টা করেন। ২০০৪ সালে ২৪ এপ্রিল মুসলমানরা তাঁর বক্তব্য-বিবৃতির তীব্র প্রতিবাদ করা শুরু করে এবং ডাচ কর্তৃপক্ষের নিকট তারা লিখিতভাবে অভিযোগ করে যে, আইয়ান হিরসী আলী ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে অবমাননাকর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। ডাচ বিচার বিভাগ ও সরকার মুসলমানদের দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে তেমন কোন ব্যবস্থা না নিয়ে, তাঁকে নিরাপত্তা দেয়ার ব্যবস্থা নেয়। এরমধ্যে আইয়ান হিরসী আলী ২০০৪ সালে একটি চলচিত্রে ইসলামে নারীদেরকে যথাযথ মর্যাদা দেয়া হয় নি, এমন বক্তব্য দেন প্রকাশ্যে। এটি প্রকাশ হওয়ার পর মুসলামানরা তাঁর বিরুদ্ধে আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ডাচ সরকার তাঁর ব্যাক্তিগত নিরাপত্তা আরও জোরদার করে। ২০০৬ সালের মে মাসে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে আইয়ান হিরসী আলী মিথ্যা তথ্য দিয়ে ডাচ সরকারের নিকট হতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন, বলে অভিযোগ তোলা হয়। এ অনুষ্ঠানে তাঁর পরিবারের সদস্যবর্গ, বাবা, মা এবং সোমালীয় সরকারি কর্তৃপক্ষের বক্তব্য উদ্ধৃত করে ‘আইয়ান হিরসীর দাবি তাকে জোর করে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা বা তাঁকে সোমালীয় সরকারের অন্যায়মূলক আচরণ করার দাবিসমূহ অন্তসারশূন্য বলে’ উল্লেখ করা হয়। তাছাড়া, ডাচ সরকারের নিকট তাঁর রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার করার আবেদনে আইয়ান হিরসী আলী তাঁর নাম, বয়স, ঠিকানা ইত্যাদি সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছেন বলেও টেলিভিশন অনুষ্ঠানটিতে অভিযোগ তোলা হয়। আর হিরসী আলী এসব বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে নিজের অবস্থানকে সমর্থন করেন বার বার। এসব বিতর্ক চলাকালে আইয়ান হিরসী আলী নেদারল্যান্ড ছেড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাওয়ার চেষ্টা চালাতে থাকেন। পরিশেষে, তিনি ২০০৬ সালে ওয়াশিংটন ডিসি-তে আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্স্টিটিউটে একটি চাকুরি নেন। ডাচ সরকার তাঁর নিরাপত্তা ব্যবস্থা অব্যাহত রাখে। আইয়ান হিরসী আলী যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে আরও ভাল অবস্থান পাওয়ায় মুসলমানরা অধিকতর প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করতে শুরু করে। তিনি যেখানেই যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন বা আমন্ত্রণ পাচ্ছিলেন, সেখানকার মুসলিম সম্পদায় তীব্র প্রতিবাদ এবং প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে তাকে প্রতিরোধ করার প্রয়াস চালাচ্ছিলেন। ২০০৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর আইয়ান হিরসী আলী আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি পান। এতসব প্রতিক্রিয়া সত্বেও, তিনি ইসলামের সমালোচনা করে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। ২০০৩ সালে, আইয়ান হিরসী আলী হযরত মুহাম্মদ (দ:) সম্পর্কে মারাত্বক সব আপত্তিকর সমালোচনা করেন। নেদারল্যান্ডের একটি পত্রিকায় তাঁর এসব বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছিল। যাহোক, আইয়ান হিরসী আলী আস্তে আস্তে ইসলাম ধর্ম বিশ্বাস হতে ইতোমধ্যে পুরোপুরি সরে যান এবং তাঁর বাবা, মা’সহ পরিবারের সদস্যদের ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী হওয়া নিয়েও, তিনি কটূক্তি করতে থাকেন। আর মা-বাবার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সমালোচনা করেন। পাশাপাশি, আইয়ান হিরসী আলী ইউরোপীয় এবং পাশ্চাত্য দেশগুলোকেও তাদের অভিবাসী নীতি নিয়ে তীব্র সমালোচনা করে যাচ্ছিলেন, এসময়। তিনি তখন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এবং অন্যন্য মাধ্যমে বিভিন্ন প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখে ইসলাম ধর্ম, নারী অধিকার, অভিাবাসন ব্যবস্থা, তার পরিবার কতৃক তাঁর প্রতি আচরণ প্রভৃতি বিষয়ে খোলামেলা সমালোচনা করছিলেন। এরমধ্যে তিনি ইসরাইল এবং ফিলিস্তিন সফর করেন। আর ইসরাইলী নীতি এবং ফিলিস্তিনীদের সাথে ইসরাইল সরকারের আচার-আচরণ ও আগ্রাসী মনোভাব প্রদর্শনের প্রতি তাঁর সমর্থন ব্যাক্ত করেন। অপরদিকে, তিনি ফিলিস্তিনী মুসলিম নেতুবৃন্দের তীব্র সমালোচনা করেন। আর ফিলিস্তিনী মুসলমানদের দুর্দশার জন্য ফিলিস্তিনের নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তিবর্গকে দায়ি করেন।
আইয়ান হিরসী আলী স্কটল্যান্ডের নাগরিক ও ইতিহাসবিদ নিয়াল ফার্গুসনকে বিয়ে করেন। ২০১১ সালে তাঁদের সন্তান থমসন জন্ম গ্রহন করে। ইংরেজিভাষী বিজ্ঞজনরা আইয়ান হিরসী আলীর তৎপরতাকে ভূয়সী প্রশংসা এবং সমালোচনা করে থাকেন। সাহিত্য সমালোচক ও সাংবাদিক ক্রিস্টোফার হিচেনস তাঁকে আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী পাবলিক বুদ্ধিজীবী বলে অভিহিত করেন। লস এন্জেলেস টাইমস পত্রিকার সাংবাদিক প্যাট মরিসন আইয়ান হিরসী আলীকে কট্রর ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে নারী মুক্তির পক্ষে একজন লড়াকু নারীবাদী লেখক-ব্যাক্তিত্ত্ব হিসেবে উল্লেখ করেন। মার্কিন ঔপন্যাসিক রজার এল সাইমন নারীবাদী বলিষ্ট ভূমিকা পালনের জন্য আইয়ান হিরসী আলীর ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, তিনি আমাদের সময়ের জোয়ান অব আর্কের মত। দ্যা গার্ডিয়ান পত্রিকার সাংবাদিক এন্ড্রু এ্যান্থনী ইসলামী মৌলবাদী এবং পাশ্চাত্যের অনেক লেখক কতৃক আইয়ান হিরসী আলীর বিরোধীতা প্রমাণ করে যে, সকল প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে তিনি পাশ্চাত্যে উদারবাদকে স্বাগত জানিয়ে অনেক বড় কাজ করেছেন। আবার কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশন্স-এর মুখপাত্র ইব্রাহিম আইয়ান হিরসী আলীর কর্মকান্ডের তীব্র নিন্দা প্রকাশ করে বলেন, ‘ইসলামের সবচেয়ে জঘন্য ক্ষতিকারক মহিলাটি এখন শুধু আমেরিকায় নয়, সারাবিশ্বে চসে বেড়াচ্ছে। তিনি ইসলামে অনেক বড় ক্ষতি করছেন।’
আইয়ান হিরসী আলীর বই রচনা:
আইয়ান হিরসী আলী তাঁর চিন্তা-ভাবনা প্রকাশ করেছেন তাঁর বহুল আলোচিত বইগুলোতে। তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহ হলো; কেইজড ভার্জিন (অবরুদ্ধ কিশোরী), ইনফিডেল (আমার জীবন), নোমাড (সভ্যতার সংকটের মধ্যদিয়ে ইসলাম হতে আমেরিকায় গমন) ও হেরেটিক (কেন ইসালামের সংস্কার প্রয়োজন) ।
১. আইয়ান হিসী আলী তাঁর প্রথম বইটিতে ‘কেইজড ভার্জিন’ (অবরুদ্ধ কিশোরী) তিনটি বিষয় আলোচনা করার চেষ্টা করেছেন। ১৭টি প্রবন্ধের সংকলন করা হয়েছে, এতে। প্রথমত: তিনি উপজাতীয়তা বোধ এবং কুসংস্কার থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসার কথা বলেছেন। দ্বিতীয়ত: তিনি ইউরোপে মুসলিম অপরাধীদের নিত্য নৈমিত্যিক খারাপ কাজগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, এবং তৃতীয়ত: ডাচ সরকার কতৃক নারীদের প্রতি বিরূপ আচরণ মেনে নেয়া ও অভিবাসীদের প্রতি দুর্ব্যবহার করার বিষয়গুলো তিনি তুলে ধরার প্রয়াস চালিয়েছেন।
২. ‘ইনফিডেল ’বইটিতে সোমালিয়ার মত দেশগুলোতে গৃহযুদ্ধ, নারীদের প্রতি দুর্ব্যবহার, পরিবার কতৃক জোর করে বাল্য বিয়ে দেয়ার প্রবণতা, ধর্মীয় সহিংসতা এবং নেদারল্যান্ডের মত ইউরোপীয় দেশগুলোতে অভিবাসীদের প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন প্রভৃতি বিষয় স্থান পেয়েছে।
৩. নোমাড (যাযাবর) গ্রন্থে আইয়ান হিরসী আলীর সোমালিয়ায় জন্ম গ্রহনকারি একজন মুসলিম কিশোরী কিভাবে মুক্তির সন্ধান করতে করতে কীভাবে ইসলামী কট্টর দৃষ্টিভঙ্গি হতে একজন নারীবাদী মার্কিন মুল্লুকে পৌঁছে নিজেকে মুক্ত করেছেন, নারীদের মুক্তি দেয়ার সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছেন এবং এখনো লড়ে যাচ্ছেন; তাঁর সরেস বর্ণনা দিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি বুঝাতে চেয়েছেন, ইসলামের চেয়ে নারীদের প্রতি পাশ্চাত্যের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য, উদার এবং আধুনিক।
৪. চতুর্থ গ্রন্থটিতে আইয়ান হিরসী আলী বুঝাতে চেয়েছেন; ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে যেভাবে আমরা জানি ও ইসলামী শরিয়ত এবং বিধিমালার যে রূপ আমরা বিশ্বব্যাপী দেখছি;তা এখন আর সার্বজনীন নয়। এটাকে পুরোপুরি পরিবর্তন করতে হবে ও সংস্কার করতে হবে। অন্যথায়, ইসলামের নামে সন্ত্রাসী ও সহিংসতা ছড়ানোর অপচেষ্টাকারিরা এ বিশ্বকে অশান্তি ও হানাহানির তান্ডব লীলায় পরিণত করতে চেষ্টা করবে। তাই ইসলামের উৎসসমূহকে সংস্কার করা প্রয়োজন।
আইয়ান হিরসী আলী কী ইসলামের শত্রু না মিত্র:
ইসলামকে ঘুরেফিরে খারাপ একটি ধর্ম বা রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে তুলে ধরার জন্য নিত্য প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন, তিনি। কিন্তু আইয়ান হিরসী আলী কুরআন-হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে যেভাবে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করেন, মনে হয় যেন তিনি ইসলামকেই তুলে ধরছেন। তিনি যতই বলতে চেষ্টা করেন; ইসলাম এ যুগের ধর্ম নয়, মুসলমানরা আল্লাহ ও রসূলের নামে অবলিলায় মানুষ হত্যাসহ সকল ধরণের অপকর্মে লিপ্ত, মুসলিম আলেম-ওলেমারা ভাল ভাল কথা বলে আসলে সাধারণ মানুষকে ভুল পথে পরিচালত করছেন, তাঁদের নেতারা চাঁদাবাজি চালিয়ে যেতে ইসরাইলসহ পাশ্চাত্য সভ্যতাকে বিরূপভাবে তুলে ধরছে, মুসলিম অপকর্মকারিদের তৎপরতা চালানোর জন্যই ইসলামের কথা বলে–তাঁরা, তখন তাঁকে মনে হয় যেন তাঁর মনের অগোচরে তিনি ইসলামের পক্ষেই বলছেন। তিনি যখন তারেক রমদানের ন্যায় মুসলিম পন্ডিতজনের সাথে ইসলামে বিপক্ষে বলার জন্য জান-প্রাণ দিয়ে অপচেষ্টায় লিপ্ত হন, তিনি তাঁর কথার ফুলজুরিতে কেই হারিয়ে হ্যাঁ হ্যাঁ করে ইসলামের মৌলিক সব অবস্থানকে সমর্থন করেন। আর মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া এবং এককালের ইসলামী রাজনীতির কট্টর সমর্থক ও ইসলামী অনুশাসন নিষ্ঠার সাথে মেনে চলা বর্তমান নিরেশ্বরবাদী আইয়ান হিরসী আলী পম্চিমাদের নিকট কখনো গ্রহনযোগ্য হবেন না। তাঁরা হয়ত তাঁর এখানকার অবস্থানকে কিছুটা নমনীয় সমর্থন জানাচ্ছে। অচিরেই আবার তিনি ইসলামের পথেই আসবেন। কারণ কুরআন-হাদীসের আলোয় যিনি একবার অলোকিত হয়েছিলেন, তিনি কখনো অন্য কিছুতে শান্তি-স্বস্তি পাবেন না। আপাতত; আইয়ান হিরসী আলী সোমালীয় শরণার্থী পরিচয় ঢেকে রাখার জন্য ইসলাম বিরোধী শক্তির পুতুল সেজে তাদের কোলে উঠে বসার সুযোগ পেয়েছেন, বৈ কি!
*মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ্
সহকারি উপজেলা শিক্ষা অফিসার
মহেশখালী, কক্সবাজার।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।