সাফ্ফাত ফারদীন চৌধুরী

ইতিহাস কথা বলে এটা চিরন্তন সত্য। ইতিহাস অমোচনীয় একটি স্মরণীয় অধ্যায় হিসেবে স্বাক্ষ্যবহন করে এটাও সত্য।জন্ম জন্মান্তরের অবিস্মরণীয় নির্দেশনা হচ্ছে ইতিহাস।ইতিহাস ভুল ভাবে পেশ করা যেমন অপরাধ,ইতিহাস বিকৃত করা আরোও বেশি অপরাধ। ইতিহাস শ্রুতি নয়, দলিল দস্তাবেজ বা লিখিত ডকুমেন্ট তার প্রধান স্বাক্ষ্য।ইতিহাস অতীতের কথা বলে।উখিয়া থানা প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানানোর জন্যই আমার এই প্রয়াস।আশা করি সবাই পড়বেন এবং নিজেদের ইতিহাস ভান্ডার সমৃদ্ধ করবেন।

সময়টা অনেক আগের। এই জনপদ যখন ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে। বর্তমান উখিয়া টেকনাফ এবং রামু থানার কিছু অংশ নিয়ে সেসময় “টেকনাফ ” নামের একটি থানা ছিল।কালের বিবর্তনে যখন ধীরে ধীরে জনসংখ্য বাড়তে থাকে সে সময় জাগতিক নিয়ম অনুযায়ী সমাজে কলহ বিরোধও বাড়তে থাকে।তাই সময়ের এবং সমাজের প্রয়োজনের তাড়নায় উখিয়ায় একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন অতীব জরুরি হয়ে পড়ে।পরবর্তীকালে নিজ প্রচেষ্ঠায় তৎকালীন বৃহত্তর রাজাপালং (বর্তমান রাজাপালং এবং পালংখালী) ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট এবং দক্ষিণ চট্টলার প্রসিদ্ধ জমিদার মকবুল আহমদ সিকদার (যিনি ব্রিটিশ খেতাবপ্রাপ্ত চৌধুরী এবং সি,এস খতিয়ানভুক্ত জমিদার এবং উখিয়ার একমাত্র মুসলিম জমিদার মছন আলী সিকদারের জ্যেষ্ঠ সন্তান) ব্রিটিশ সরকারের অনুমতিক্রমে উনার জমিতে নিজ অর্থায়নে উখিয়ায় একটি পুলিশ ফাঁড়ি প্রতিষ্ঠা করেন।যেটি সেসময় লোকমুখে “উখিয়া বিট” হিসেবে পরিচিত ছিল।এভাবে সময় সামনের দিকে গড়াতে থাকে।পরবর্তীতে জনসংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাওয়ায় পুলিশ ফাঁড়ির পক্ষে এই বিশাল জনপদের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ কষ্টকর হয়ে উঠে।তাই সারা উখিয়া জুড়ে একটি পূর্নাঙ্গ থানা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। সেই আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন “উখিয়া থানা বাস্তবায়ন ” কমিটির সভাপতি তৎকালীন বৃহত্তর রাজাপালং ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট জমিদার মকবুল আহমদ সিকদার।উনার সভাপতিত্বে সর্বপ্রথম “থানা বাস্তবায়ন” কমিটির বৈঠক হয়।পরবর্তীতে আন্দোলন ব্যাপক রূপ ধারণ করলে ব্রিটিশ সরকারের কালেক্টর “থানা বাস্তবায়ন” কমিটির সদস্যদের চট্রগ্রামে ডেকে পাঠান এবং থানা প্রতিষ্ঠার বিষয় নিয়ে উনাদের সাথে বৈঠকে বসেন।সেখানে কালেক্টর সাহেব থানা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যথাসাধ্য সহযোগিতার আশ্বাস দেন।তবে সেখানে একটি শর্ত জুড়ে দেন যে থানা প্রতিষ্ঠার জন্য জমি এবং ভবন নির্মানের অর্থ স্থানীয়দের দিতে হবে সরকার শুধুমাত্র “টেকনাফ” থেকে আলাদা করে উখিয়ায় পূর্ণাঙ্গ থানা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অনুমতি দেবে।এরপর থানা বাস্তবায়ন কমিটি উখিয়ায় এসে পুনরায় বৈঠকে মিলিত হন।সে বৈঠকটি ছিল মূলত থানা প্রতিষ্ঠার স্থান নির্বাচনের বৈঠক।কোর্টবাজারের স্বনামধন্য ব্যক্তি হোসেন আলী মাতবর “থানা” বর্তমান কোর্টবাজার এ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তাবণা দেন।কিন্তু পরবর্তীতে বিভিন্ন ভৌগোলিক কারণে এবং মকবুল আহমদ সিকদার এর থানা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে পূর্ব থেকেই আন্তরিক প্রচেষ্ঠার কারণে ( যেহেতু উখিয়া পুলিশ ফাঁড়িও উনি নির্মাণ করেছিলেন) সকলের সর্বসম্মতিক্রমে উখিয়ায় “থানা” নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দানবীর মরহুম মকবুল আহমদ সিকদার উনার মালিকানাধীন ওয়ালাপালং মৌজার ৭১২৫ নং দাগের আর,এস ১৩৯৫ নং খতিয়ানভুক্ত ১.৩৮ একর (প্রায় ৩.৫০ কানি) জমির উপর থানা নিজের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠা করেন যা বর্তমানে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের নামে বি,এস ৭০৭৯, ৭০৮২,৭০৮৩ নং দাগভুক্ত আছে।যে জমির বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকা।বর্তমান মডেল থানা সহ উখিয়া পুলিশের সকল স্থাপনা এই জমিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ।সে সময় মকবুল আহমদ সিকদার নিজ অর্থায়নে কাঠ এবং মায়ানমার থেকে নিয়ে আসা গোলপাতা ও বাশঁ দিয়ে প্রাথমিকভাবে থানা নির্মাণ করেন।যেটি বর্তমান মডেল থানা নির্মাণের আগ পর্যন্ত স্থায়ি ছিল।প্রসঙ্গত মকবুল আহমদ সিকদার এর সেসময় লঞ্চের ব্যবসা ছিল।উনার ৬ টি লঞ্চ ছিল।যার মধ্যে ৪ টি পণ্যবাহী এবং ২ টি যাত্রীবাহী।সেসময় সড়কব্যবস্থা অনুন্নত থাকার কারণে বাণিজ্য এবং ভ্রমণের জন্য মানুষ পানিপথ ব্যবহার করত।মকবুল আহমদ সিকদার মায়ানমারের রেঙ্গুন,মন্ডু এবং আকিয়াব থেকে সূতা,বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য, কাপড়,বাশঁ,গোলপাতা ক্রয় করে ঢাকা,চট্রগ্রাম, ভারতের হুগলি,মুম্বাই এবং কলকাতায় নিয়ে রপ্তানি করত।এবং সেখান থেকে আমাদের এলাকায় প্রয়োজনীয় বিভিন্ন দ্রব্যাদি নিয়ে এসে আমাদের অঞ্চলে এবং মায়ানমারে আমদানি করত।তিনিই কলকাতা থেকে প্রথম টিউবওয়েল এনে উখিয়া বর্তমান ভূমি অফিসের সামনে স্থাপন করেন এবং সেখানে একটি বাজার প্রতিষ্টা করেন যেটি “পাইপ বাজার” বাজার নামে এখনো জনশ্রুতি আছে ।সে সময় দেশ ভাগ না হওয়াতে ব্যবসায় সুবিধে ছিল অনেক।মূলত পণ্যের আমদানি-রপ্তানি উনার পৈতৃক ব্যবসা ছিল।তাই নিজ মালবাহী লঞ্চ নিয়ে মায়ানমার থেকে উনার ক্রয়কৃত বাশঁ এবং গোলপাতা কলকাতায় রপ্তানির সময় থানা নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণে বাশঁ এবং গোলপাতা উনি বর্তমান বালুখালী বাজার এর “উখিয়া ঘাট” থেকে খালাস করে নিয়েছিলেন। তখন সেখানে নাফ নদীর গভীর শাখা ছিল যেখানে লঞ্চ ভিড়ত।উখিয়া ঘাটটি ও মকবুল আহমদ সিকদার প্রতিষ্ঠা করেন ওনার জমিতে বালুখালীতে। সেখান থেকে মালামাল বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা হত।এভাবে থানা নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হলে ১ মাস পর ব্রিটিশ সরকার উখিয়া থানায় একজন দারোগা এবং পুলিশের সিপাহী নিয়োগ দেন।আর এভাবেই মূলত মকবুল আহমদ সিকদার উখিয়া থানার মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য দীর্ঘ দিনের আন্দোলন এর মাধ্যমে একটি স্বাধীন এবং পূণার্ঙ্গ থানা প্রতিষ্ঠা করেন।যার ফলশ্রুতিতে আজকে আমরা একটি আলাদা উপজেলার অধিবাসী। আমরা বুক ফুলিয়ে বলতে পারি আমরা উখিয়া উপজেলার মানুষ।মকবুল আহমদ সিকদারই মূলত আধুনিক উখিয়া উপজেলার স্বপ্নদ্রষ্টা। পরবর্তীতে উনার দেখানো পথ ধরে উনার উত্তারাধিকারীরাও উনার মত বিভিন্ন জনহিতৈষী কর্মকান্ডে জড়িত হন।উনার সুযোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে উনার পুত্র বৃহত্তর রাজাপালং ইউনিয়ন বোর্ডের সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট আবুল কাশেম চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ সন্তান শাহজাহান চৌধুরী ১৯৭৯ সালে (উখিয়া-টেকনাফ-রামু) আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হলে ইতিহাসের প্রথমবারের মত উখিয়ার প্রথম সন্তান হিসেবে জাতীয় সংসদে যান।১৯৯১ সালে ২য় বারের মত সাংসদ নির্বাচিত হলে উনাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের স্থায়ী কমিঠির সদস্য করা হয়।তখন থেকেই মূলত তিনি উখিয়ায় একটি মডেল থানা ভবন নির্মাণের জন্য স্বপ্ন দেখতে থাকেন।জেলার মধ্যে সরকারী দলের একমাত্র সাংসদ হওয়ায় উনি সংসদে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষন করে কক্সবাজার জেলায় একটি আলাদা কারাগার নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।মূলত উনার প্রস্তাবনা থেকেই কক্সবাজার জেলা কারাগার প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল।পরবর্তীতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সদস্য হওয়ার কারণে কারাগারের জন্য অনুমোদন এবং অর্থ বরাদ্দ করতে উনার অসুবিধে হয়নি।যার ফলস্বরূপ তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আব্দুল মতিন জেলা কারাগারের ভিত্তি প্রস্তর উদ্ভোদন করে কারাগার নির্মাণের কাজ শুরু করেন।২০০১ সালে শাহজাহান চৌধুরী ৪র্থ বারের মত সাংসদ নির্বাচিত হলে উনি উখিয়ায় থানাকে রূপান্তরিত করে একটি মডেল থানা নির্মানের জন্য সিদ্ধান্ত নেন এবং সেই অনুযায়ী মন্ত্রনালয়ে কাজ শুরু করেন।উনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ২০০৫ সালে উখিয়া সফরে আসলে উখিয়ায় মডেল থানা নির্মানের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দেন এবং ঢাকায় গিয়ে দাপ্তরিক কাজ আরম্ভ করেন।এবং ২০০৬ সালে মন্ত্রীপরিষদ বৈঠকে উখিয়া মডেল থানার প্রস্তাবনা চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করে এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ও বরাদ্দ দেওয়া হয়।পরের বছর মডেল থানার টেন্ডার হয়।শুধু তাই নয় উপকূলীয় এলাকার মানুষের নিরাপত্তার জন্য সে সময় উনি ইনানী পুলিশ ফাঁড়ি প্রতিষ্ঠা করেন।এভাবে উখিয়া উপজেলার মানুষের নিরাপত্তা বিধানের জন্য এই পরিবারটি সেই ব্রিটিশ আমল হতে অদ্যাবধি নিরলসভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছে
প্রাচীন আমল থেকেই উখিয়ার ঐতিহ্যবাহী এই পরিবারটি নিরলসভাবে জনগণের জন্য পকৃত ভালবাসার নিড়িকেই কাজ করে যাচ্ছে।আজকে উখিয়ায় থানা আছে বলেই আমরা নিরাপদে রাতে নিশ্চিন্তভাবে ঘুমাচ্ছি।বাড়িতে মূল্যবান জিনিষ,দোকানপাট সহ রাস্তাঘাটে নির্ভয়ে চলাচল করছি।সুতরাং আমাদের এই নিরাপদ জীবনযাপন এবং নির্বিঘ্নে চলাচলের সুযোগ যিনি করে দিয়েছেন সেই মহান মানুষ দানবীর মকবুল আহমদ সিকদারকে জানায় বিনম্র শ্রদ্ধা এবং উনার সুযোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে সাবেক সাংসদ শাহাজাহান চৌধুরীর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা উনার দাদার প্রতিষ্ঠিত থানাকে আধুনিক মডেল থানায় রূপান্তরে মাধ্যমে আমাদের নিরাপত্তা জোরদারের জন্য।আমি মকবুল আহমদ সিকদার এর উখিয়া থানার জমিটির আর,এস খতিয়ানের দলিল তথ্য প্রমাণস্বরূপ দিলাম।
এখানেই শেষ নয়, আরও চলবে।সামনে আসবে উখিয়া উপজেলার শিক্ষা বিস্তারের ইতিহাস।

চোখ রাখুন ২য় পর্বে ……