মাহফুয আহমদ
আজকাল কিছু কিছু বন্ধু কারও কারও কথা শুনে কিংবা কোনো কোনো লেখা দেখে সংশয়ে পড়েন যে, আদৌ পনেরো শাবানের রাত্রির কোনো ফজিলত বা বিশেষত্ব আছে কি না। বাস্তব কথা হলো, শাবানের পুরো মাসটাই ফজিলতপূর্ণ এবং বরকতময়।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ মাসের বরকত কামনা করে দোয়া করতেন। রমজান মাসের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে এই মাসে তিনি বেশি বেশি রোজা রাখতেন। হজরত আয়িশা (রা.) বলেন, “নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজান ছাড়া কখনও পূর্ণ কোনো মাস রোজা রাখতে আমি দেখিনি। আর শাবান মাসে তিনি যেভাবে অধিকহারে রোজা রাখতেন, বৎসরের অন্য কোনো মাসে এমনটা করতেন না। ” (সহিহ বোখারি: ১৬৮৬, সহিহ মুসলিম: ১৯৫৬) হজরত উসামা ইবনে জায়দ (রা.) নবীজিকে শাবান মাসে অধিক রোজা রাখার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “অধিকাংশ মানুষ এ মাসের ব্যাপারে উদাসীন থাকে। অথচ এটি এমন একটি মাস; যখন আল্লাহ তায়ালার নিকট বান্দাদের আমলনামা পেশ করা হয়। অতএব আমি চাই, আমার আমলনামা এমন অবস্থায় পেশ করা হোক; যখন আমি রোজাদার। ” (মুসনাদে আহমাদ: ২১৭৫৩, নাসায়ি: ২৩৫৭)
এরকম নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উম্মতকে এই মাসের একটি রাত সম্পর্কে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তখন দোয়া কবুল হয়। হজরত মুআয ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “অর্ধ শাবানের রাতে আল্লাহ সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। অতপর শিরককারী ও বিদ্বেষপোষণকারী ছাড়া তার সমগ্র সৃষ্টিকে ক্ষমা করে দেন। ” (সহিহ ইবনে হিব্বান: ৫৬৬৫)
আজকাল আমাদের যে সকল বন্ধু এ সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টি করে চলছেন, তারা যেসব মনীষীর অনুসরণ ও অনুকরণ করে থাকেন; তাদের সেই সব বরেণ্য আলেমও কিন্তু পনেরো শাবানের রাত্রির ফজিলত আছে বলে স্বীকার করেছেন এবং এ সংক্রান্ত হাদিস গ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন। উদাহরণ স্বরূপ এখানে কয়েকজনের উদ্ধৃতি পেশ করা হল:
১. শায়খুল ইসলাম হাফিয ইবনে তাইমিয়া রাহ. (মৃ. ৭২৮ হি.) বলেন, “পনেরো শাবানের রাতের ফজিলত সম্পর্কে একাধিক ‘মারফু’ হাদিস এবং সাহাবিদের ‘আসার’ বা উক্তি বর্ণিত হয়েছে। এগুলো দ্বারা ওই রাতের ফজিলত ও মর্যাদা প্রমাণিত হয়। সালাফে সালিহিনের কেউ কেউ এ রাতে নফল নামাজের ব্যাপারে যত্নবান হতেন। আর শাবানের রোজার ব্যাপারে তো সহিহ হাদিসসমূই রয়েছে। কোনো কোনো আলেম যদিও এই রাতের ফজিলত অস্বীকার করেন; কিন্তু হাম্বলি ও অহাম্বলি অধিকাংশ আলেমই এই রাতের ফজিলতের কথা স্বীকার করে থাকেন। ইমাম আহমাদ (রহ.)-এর মতও তা-ই। কেননা এর ফজিলত সম্পর্কে একাধিক হাদিস বর্ণিত হয়েছে এবং এগুলোর সমর্থনে সালাফ (সাহাবি ও তািবয়ি)-এর উক্তিও বিদ্যমান আছে; যেগুলো ‘সুনান’ ও ‘মুসনাদ’ শিরোনামে সংকলিত হাদিসের কিতাবে (বরং কতক ‘সহিহ’ শিরোনামের কিতাবেও যেমন সহিহ ইবনে খুযায়মা, সহিহ ইবনে হিব্বান প্রভৃতিতে) রয়েছে। ” (দেখুন: ইকতিযাউস সিরাতিল মুসতাকিম, ২/৬৩১, মাকতাবাতুর রুশদ, রিয়াদ, এ বিষয়ে তার আরো উক্তি জানতে দেখুন: মাজমুউল ফাতাওয়া, ৩/১৩১-১৩২)
২. মুহাদ্দিস আবদুর রাহমান মুবারকপুরি রহ. (মৃ. ১৩৫৩ হি.) বলেন, “শাবানের পনেরো তারিখের রাত্রির ফজিলতের ব্যাপারে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে; যেগুলোর সমষ্টি থেকে বুঝা যায় যে, এর একটা ভিত্তি রয়েছে। ” তিনি এ সংক্রান্ত কয়েকটি হাদিস উল্লেখ করে বলেন, “যারা এ রাতের ফজিলত ভিত্তিহীন বলে মনে করেন তাদের বিরুদ্ধে এসব হাদিস অকাট্য দলিল। ” (দেখুন: তুহফাতুল আহওয়াজি শারহু সুনানিত তিরমিজি, ৩/৪৪১-৪৪২, দারুল ফিকর, বয়রুত, ১৩৯৯ হি.)
৩. বর্তমান সময়ের আমাদের সালাফি বন্ধুগণের নন্দিত মুহাদ্দিস, মরহুম শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানি (মৃ. ১৪২০ হি.) পনেরো শাবানের রাত্রির ফজিলত বিষয়ক একটি হাদিস সম্পর্কে “সহিহ হাদিস” বলে মন্তব্য করেছেন। (দেখুন: সিলসিলাতুল আহাদিসিস সাহিহা, ৩/১৩৫, হাদিস: ১১৪৪, শাবাকা)
এইরাতে কবর জিয়ারত করা প্রসঙ্গেও কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এইরাতে বাকী’ কবরস্থানে গিয়ে মৃতদের জন্য দোয়া করেছেন। (সুনানে তিরমিজি: ৭৩৯, সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৩৮৯) অতএব কেউ চাইলে কবর জিয়ারতেও যেতে পারে। কিন্তু নবীজি এমনটা করেছেন বলে তাঁর সারাজীবনের একটিমাত্র রাতেরই বর্ণনা পাওয়া যায়, ফলে এটাকে নিয়মিত সুন্নত বা কর্মে পরিণত করার অবকাশ নেই। তা ছাড়া সংঘবদ্ধ হয়ে কিংবা নারীপুরুষ একত্রিত হয়ে সম্মিলিত জিয়ারতেরও কোনো ধারণা সুন্নতে নববি অথবা সাহাবা ও তাবিয়িন থেকে মিলে না। এরকম কর্ম মূলত প্রত্যাখ্যাত।
পনেরো শাবান রোজা রাখার বিষয়েও কোনো কোনো বর্ণনায় উৎসাহিত করা হয়েছে। যদিও ওসব বর্ণনার সনদ নিয়ে হাদিস বিশেষজ্ঞদের কিছু কথা আছে, তথাপি ওইদিন সাধারণ নিয়ম ও নিয়তে কেউ রোজা রাখলে অসুবিধার কিছু নেই। অন্যদিকে এ বিষয়ক হাদিসগুলো মওজু বা একেবারে ভিত্তিহীন এমন তো নয়! আর পূর্বোক্ত হাদিসগুলোর ভাষ্যমতে নবীজি তো শাবানের শেষ কিছুদিন ব্যতীত বাকি সবদিনই রোজা নিজে রাখতেন এবং অন্যকে রাখতে অনুপ্রাণিত করেছেন।
বস্তুত প্রতি ইসলামি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজা রাখার বিশেষ সওয়াবের কথা একাধিক সহিহ হাদিসে বিধৃত হয়েছে; যেগুলোকে ‘আইয়ামে বীয’-এর রোজা বলা হয়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে তিনটি জিনিসের ওসিয়্যত করে গেছেন। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে, প্রতি মাসের এই তিনটি রোজা রাখা। (সহিহ বোখারি: ১১২৪, সহিহ মুসলিম: ১১৮২)
মোটকথা, এই রাতে আমাদের করণীয় কী বা কেমন হওয়া উচিত- আল্লামা ইবনে রজব রহ. (মৃ. ৭৯৫ হি.)-এর ভাষায়: “মুমিনের কর্তব্য এই যে, এ রাতে খালেস দিলে তওবা করে জিকির, দোয়া ও ইস্তেগফারের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে। যত্নের সঙ্গে নফল নামাজ পড়বে। কেননা কখন মৃত্যু এসে যায় বলা যায় না। তাই কল্যাণের মওসুম শেষ হওয়ার আগেই তার মূল্যায়ন করা জরুরি। আল্লাহ তায়ালার নিকট থেকে সওয়াব লাভের আশা নিয়ে পনেরো তারিখের রোজাও রাখবে। তবে অত্যন্ত জরুরি বিষয় হল, ওইসব গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা, যেগুলো এ রাতের সাধারণ ক্ষমা ও দোয়া কবুল হওয়া থেকে মানুষকে বঞ্চিত করে দেয়। যথা: শিরক, হত্যা, হিংসা-বিদ্বেষ। এ সবগুলোই কবিরা গুনাহ। আর হিংসা-বিদ্বেষ তো এতই গর্হিত বিষয় যে, এটা অধিকাংশ সময়ই মানুষকে আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। যেকোনো মুসলমান সম্পর্কেই বিদ্বেষ পোষণ করা অত্যন্ত মন্দ প্রবণতা। তবে সাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে সালিহিন সম্পর্কে অন্তরে হিংসা ও বিদ্বেষ বিদ্যমান থাকা অত্যন্ত ভয়াবহ ও গর্হিত অপরাধ। এজন্য মুসলমানদের কর্তব্য হলো, সর্বদা অন্তরকে পরিষ্কার রাখা এবং হিংসা-বিদ্বেষ থেকে পাক-পবিত্র রাখা। বিশেষত উম্মাহর পূর্বসূরী ব্যক্তিদের সম্পর্কে অন্তর পুরোপুরি পরিষ্কার থাকা অপরিহার্য, যাতে রহমত ও মাগফিরাতের সাধারণ সময়গুলোতে বঞ্চিত না হতে হয়। ” (লাতাইফুল মাআরিফ, পৃ. ২৬৫-২৬৬, দারু ইবনি কাসির, বয়রুত, ৫ম সংস্করণ ১৪২০ হি./১৯৯৯ ঈ.)
লেখক : লন্ডনপ্রবাসী তরুণ আলেম
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।