মহসীন শেখ

“মনে বড় আশা ছিল যাব মদিনায়। ছালাম আমি করবো গিয়ে নবীর রওজায়”…. আব্দুল হালিমের কন্ঠে যতবার এ ইসলামিক গানটি শুনেছি ততবারই হারিয়ে যেতাম কল্পনার রাজ্যে। এছাড়াও ‘আমি মদিনায় হারিয়ে যাবো, এই মদিনা আমার ঠিকানা, আমি উম্মত আখেরী নবীজির, আমি সত্যের রাহাগীর।’ কবি নজরুলের কণ্ঠে, তোরা দেখে যা আমেনা মায়ের কোলে, মধু পূর্ণিমার-ই সেথা চাঁদ দোলে এবং কবি মতিউর রহমান মল্লিকের কণ্ঠে, এলো কে কাবার ধারে, আধাঁর চিরে চিনিস না কিরে, ওকে ওমা আমিনার কোল জুড়ে চাঁদ জানিস না কিরে, আরো কত গান-গজলএ বিচ্ছূরিত হচ্ছে হৃদয়ের আকুতি, প্রেম-ভালোবাসা। মহানবী‘র পবিত্র রওয়া শরীফে গিয়ে অন্তত একটিবার জিয়ারত এবং সালাম করার প্রাণপন ইচ্ছে সে ছোটবেলার।

আল্লাহ্পাকের অসীম করুনায় ওমরাহ্ হজ্জ পালন করতে গিয়ে জীবনের সবচাইতে বড় আশা নবীজীর রওয়া মোবারক দেখার ইচ্ছে পূরণ হয়েছে, সুবহানাল্লাহ। গত মে মাসের ১১তারিখ স্বস্ত্রীক আমাকে পবিত্র মদিনায় নিয়ে যান মক্কায় প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী নিকটাতœীয় প্রিয় ছোট ভাই রেজাউল করিম কাজল এবং রামু উপজেলার বাসিন্দা গিয়াস উদ্দিন।

গত ১১মে এশারের নামাজের পর পবিত্র মক্কা থেকে মদিনায় রওনা করি আমরা। প্রাইভেট কার যোগে দীর্ঘ ৪২৩ কি.মি. দূরত্বের পথ অতিক্রম করে ফজরের আজান চলাকালেই সুষ্টভাবে মদিনায় পৌঁছি। সোজা হেরাম শরীফে গিয়ে আমরা ফজরের নামাজ ও দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করি যথারীতি। এতদিন বিভিন্নভাবে আসছিলাম সোনার মদিনার ইতিহাস এবং নানা গল্প। কিন্তু নিজের চোঁখে দেখলাম সে এক অবিশ্বাস্য সৌন্দর্য্যে ঘেরা মদিনার পবিত্র হেরাম শরিফ ও মসজিদে নববী। যেন চারিপাশ সোনায় মোড়ানো। চাকচিক্যে ঝকঝকে এমন সৌন্দর্য্যে ভরা পবিত্র স্থান কখনও কোথাও দেখা মিলবেনা। এমন শৃংখলা এবং আতিতিয়তা মিলবেনা বিশ্বজুড়ে। আরবের অন্যান্য স্থানের ন্যায় মদিনায় মানুষের আচার আচরণ ও দৈনন্দিন জীবনযাপন পুরোপুরি ভিন্ন। মদিনার স্থানীয় বাসিন্দা, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে হাজী ছাড়াও দেশ বিদেশ থেকে আসা মানুষ সবকিছুর প্রতি খুব বেশি সম্মান রেখে চলেন। দেখেই বুঝা যায় বিশ্ব নবী উম্মতে মুহাম্মদ(স.) এর রওজা মুবারকে সম্মান করে চলছেন আল্লাহ্র সকল সৃষ্টি।

যথারীতি নামাজ শেষ করে সেই ছোটবেলা থেকে একটিমাত্র মনের বাসনা পূরণ করতে প্রিয় নবীজী বিশ্ব নবী মুহাম্মাদ(স.) এর পবিত্র রওজা মুবারকে জিয়ারত এবং সালাম জানাতে সু-শৃংখল দীর্ঘ লাইনে দাড়িয়ে ধীরে ধীরে দরুত শরীফ পাঠ করতে করতে পৌঁছে যাই। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা লাখ লাখ মুসলমান উম্মাহর সাথে আমরাও প্রাণভরে দেখি নবীজীর রওজা, সালাম করেছি প্রিয় রসুল(স.) এর রওজা। সোনায় মোড়ানো নবীজীর পবিত্র রওজা সহ দুই পাশে থাকা হযরত আবুবকর(রাঃ) এবং হযরত ওসমান(রাঃ) রওয়া মুবারক জিয়ারত করি। ওসময় বিশ্ব নবী’র রওজা মুবারক চোঁখে পড়তেই সে এক অন্যরকম অনুভুতি কাজ করছিল পুরো শরীরজুড়ে। কত যে সুন্দর মুহাম্মদ(স.) এবর রওজা। ইসলামের বিধানানুযায়ী লক্ষ লক্ষ মুসলমান জিয়ারত করতে যান মদিনা মসজিদের অভ্যন্তরস্থ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর রওজা শরীফ। মহানবীর রওজার দু’পাশে রয়েছে হযরত আবুবকর (রাঃ) ও হযরত ওসমান (রাঃ)-এর কবর।

জিয়ারত শেষ করে বের হয়ে আমরা মসজিদে নববী’র দক্ষিণ পূর্ব দিকে অবস্থিত পবিত্র জান্নাতুল বাকি কবরস্থান জিয়ারত করি এবং যতটুকু সম্ভব ঘুরে দেখার চেষ্টা করি। এ কবরস্থানে মুহাম্মদ(সা.) এর অনেক আতœীয় ও সাহাবিকে দাফনকরা হয়েছে।

এরপর মদিনায় আমরা বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মসজিদ, ইসলামের মহান সেবক ও সৈনিক হযতর আমীর হামজা(রা.) এর কবর জিয়ারত ও উহুদের পাহাড় ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি ইসলামের নিদর্শন দেখতে সক্ষম হয়েছি, সুবহানাল্লাহ।

মহান স্রষ্টা আল্লাহ্র ঘর ও হায়াতুন নবী (স.) এর রওজার সান্নিধ্য যারা একবার পেয়েছেন তাদের হৃদয় মন সর্বদা সেখানে পড়ে থাকে, কখন আবার এ জান্নাতের দৃশ্য দেখবো সে আশায়। কবির ভাষায় বলতে হয় আমাদের দেশে অনেকের ধারণা জোয়ান বয়সে হজ্জ, ওমরা করলে আর দূর্নীতি করা যাবে না, শৃংখলার মাঝে বাকী জীবন কাটাতে হবে। শুধু সৎ জীবনে ফিরে আসার ভয়ে অনেকে এ দুর্লভ সুযোগ থেকে নিজেদের বঞ্চিত রেখেছেন। অনেক ধণাঢ্য ব্যক্তিকে দেখেছি যারা পৃথিবীর বহু দেশ বিদেশ ভ্রমণ করেছেন কিন্তু খানায়ে কাবা ও মহানবী (স.) এর রওজা মোবারক জিয়ারত না করে দুনিয়া থেকে চলে গেছেন।

নবীজীর রওজামোবারক ও মসজিদে নববী:

মসজিদে নববী (আরবি ভাষায়: المسجد النبوي‎) মুহাম্মদ (সা.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মসজিদ যা বর্তমান সৌদি আরবের মদিনায় অবস্থিত। গুরুত্বের দিক থেকে মসজিদুল হারামের পর মসজিদে নববীর স্থান। মুহাম্মদ (সা) হিজরত করে মদিনায় আসার পর এই মসজিদ নির্মিত হয়। এটি পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ মসজিদ। মসজিদ দিনরাতের সবসময় খোলা থাকে।

মুহাম্মদ (সা) এর বাসগৃহের পাশে এই মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে মসজিদের নির্মাণকাজে অংশ নিয়েছিলেন। সেসময় মসজিদ সম্মিলনস্থল, আদালত ও মাদ্রাসা হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। পরবর্তীকালের মুসলিম শাসকরা মসজিদ সম্প্রসারণ ও সৌন্দর্যবর্ধন করেছেন। ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে আরব উপদ্বীপের মধ্যে এখানেই সর্বপ্রথম বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানো হয়। মসজিদ খাদেমুল হারামাইন শরিফাইনের নিয়ন্ত্রণে থাকে। মসজিদ ঐতিহ্যগতভাবে মদিনার কেন্দ্রস্থলে

অবস্থিত। মসজিদে নববী অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থান বিধায় হজ্জের সময়ে আগত হাজিরা হজ্জের আগে বা পরে মদিনায় অবস্থান করেন। উমাইয়া খলিফা প্রথম আল ওয়ালিদের শাসনামলে সম্প্রসারণের সময় মুহাম্মদ(সা.) এবং প্রথম দুই খুলাফায়ে রাশেদিন আবু বকর ও উমরের কবর মসজিদের অংশ হয়। মসজিদের দক্ষিণপূর্ব দিকে অবস্থিত সবুজ গম্বুজ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এটি আয়িশার বাড়ি ছিল। এখানে মুহাম্মদ(সা.) এবং তার পরবর্তী শাসক দুইজন খলিফাকে দাফন করা হয়। ১২৭৯ খ্রিষ্টাব্দে কবরের উপর একটি কাঠের গম্বুজ নির্মিত হয়। এটি পরবর্তীতে ১৫শ শতাব্দীতে কয়েকবার এবং ১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দে একবার পুনর্নির্মিত ও সৌন্দযর্বধির্ত করা হয়।

মদিনার ইতিহাস ও বিশ্বনবীঃ-

একজন মুসলমান হিসেবে আমি নিজেকে অনেক নগন্য ও সেইসাথে ভাগ্যবান মনে করছি কারণ পবিত্র মদিনা নগরী স¤পর্কে কিছু তথ্য আপনাদের সাথে শেয়ার করতে পারছি বলে। পরমকরুনাময় সহায়।

মদিনা নগরী আল মদিনা-আল মুনাওয়ারা নামে পরিচিত যার বাংলা অর্থ আলোকিত নগরী। এই শহর মদিনা – আন – নবী বা নবী হযরত মুহাম্মদ(সাঃ) এর শহর নামে পরিচিত। এর আরও নাম আছে যেমন, তাইবাহ, ইয়াসরিব, নবীর শহর, দার আল হিজরা (হিজরতকারীদের বাসস্থান)।

এইটি ইসলামের দ্বিতীয় পবিত্র শহর যেখানে মুসলমানদের শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কবর স্থান। এইটি ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) হিজরতের পরে মদিনায় বসবাস করেছেন।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক সকালের কক্সবাজার। মোবাইল:- ০১৬১৯০৭০৫১৩