মিনার হাসান:
“জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ,
মুমুর্ষ সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?”

ঈদ আরবী শব্দ। ঈদ শব্দের অর্থ খুশি। মুসলমানদের জন্য এধরনের দুটি খুশির দিন রয়েছে। একটি হচ্ছে ঈদুল ফিতর আর একটি হচ্ছে ঈদুল আজহা। এ দু’টি দিবসই অত্যন্ত মর্যাদাশীল, আনন্দ ও খুশির দিবস।একমাস সিয়াম সাধনার পর আসে কাঙ্খিত ঈদ মুসলিম উম্মাহর জন্য খুশির সওগাত নিয়ে। তাই দীর্ঘ এক মাসের সংযম সাধনার শেষে আনন্দময় উৎসব ঈদুল ফিতর সমাগত।

“ঈদ পবিত্র, ঈদ খুশির, ঈদ আনন্দের, ঈদ ক্ষমার, ঈদ প্রার্থনার। সব ভেদাভেদ ভুলে একে অপরকে বুকে জড়ানোর দিন; সাম্য, সৌহার্দ্য, ভালোবাসা, মিলনের দিন।”

এক মাসের রোজার অবসানে তাই ঈদুল ফিতরের উৎসব কেবল ভোজনের মাধ্যমে ইন্দ্রিয়তৃপ্তির উৎসব নয়, বিশুদ্ধ আত্মা নিয়ে জীবনকে নতুন করে সাজানোর অঙ্গীকারেরও উৎসব। আত্মিক পরিশুদ্ধির ফলে দূর হয়ে যাবে সব সংকীর্ণতা ও ভেদাভেদ। পুরো রমজান মাস আমরা যে সংযমের অনুশীলন করেছি, তা আমাদের জীবন চলার সব ক্ষেত্রে সীমা লঙ্ঘনের নেতিবাচক প্রবণতা থেকে রক্ষা করবে—এমনই প্রত্যাশা। অন্যায়, অবিচার, ঘৃণা, বিদ্বেষ, হিংসা, হানাহানি—মানুষের সব নেতিবাচক প্রবণতার রাশ টেনে ধরবে।
ঈদুল ফিতরের আগমনী সুরে বেজে চলেছে মানুষে মানুষে মিলনের এই আকুতি। তাই মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ সব ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের প্রতিবেশীদের নিয়ে তাদের সবচেয়ে বড় উৎসব বরণের জন্য প্রস্তুত।
কিন্তু এত আনন্দের মাঝেও, কারো কারো ঈদ বিষাদের। কারো কাছে ঈদের নতুন চাঁদ সুকান্ত ভট্টাচার্য’র কবিতার লাইন-
“চাঁদ যেন ঝলসানো রুটির মত”।
গত ঈদে নামাজ পড়েছি গ্রামের মসজিদে। নামাজ শেষে স্বভাবত কোলাকুলি, সালাম বিনিময় ও বাসায় আত্মীয়দের আপ্যায়ন শেষে জুহুরের নামাজ আদায় করে একটু খোলা জায়গায় হাটতে গেলাম। দেখলাম একসাথে, এককাতারে নামাজ আদায় করা প্রতিবেশীটি নাঙ্গল-জোয়াল নিয়ে মাঠে হাল চাষ করতে, সাথে তার ১৫-১৬ বছরের সন্তানটি, যার এই ঈদে রঙ্গিন কাপড় পরে পাড়ার ছেলেদের সাথে ঘুরে বেড়ানোর কথা। জিজ্ঞেস করলাম চাচাকে ঈদের দিন কাজ করছেন কেন? চাচা হেসে উত্তর দিলেন “আরাত্তু ত’ পত্তিন ঈদ, হাজ নগইল্লে হায়ুম কি??
প্রতিউত্তর দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম। সমাজের চরম ব্যবধান চোখের সামনে ভেসে আসল। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, দরিদ্র, হত দরিদ্র সবার জন্য’ত ঈদ সজ্ঞা এক নয়। এই কি ঈদের শিক্ষা। ধনী -দরিদ্র, কালো-সাদা একইকাতার, এক ঈদগাহে নামাজ পড়লাম কোন শিক্ষায়-

“কোথায় ইমাম? কোন সে খোৎবা পড়িবে আজিকে ঈদে?
চারিদিকে তব মুর্দার লাশ, তারি মাঝে চোখে বিঁধে
জরির পোশাকে শরীর ঢাকিয়া ধণীরা এসেছে সেথা,
এই ঈদগাহে তুমি ইমাম, তুমি কি এদেরই নেতা?”
সমাজের এই চরম ব্যবধান কি আমরা কমাতে পেরেছি, স্বাধীনতার এত বছর পরও। যে স্বাধীনতার উদ্দেশ্য ছিল সাম্য, যে স্বাধীনতার বীজ বপন হয়েছিল অর্থনৈতিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে। কিন্তু কেন আমাদের মাঝে এত ব্যবধান??
বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। দেশের শতকরা ৮০ ভাগ লোক প্রত্যক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এ দেশের অধিকাংশ লোকের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উপায় হচ্ছে কৃষি। কারণ কৃষক ও কৃষির উন্নতির ওপর দেশের উন্নতি নির্ভর করে। কৃষি ও কৃষক হলো বাংলাদেশের প্রাণ। পলিমাটি সমৃদ্ধ বাংলার মাঠে ময়দানে যে বিশাল সবুজের সমারোহ দেখা যায় তার প্রায় সবই কৃষিজাত দ্রব্য। আর সারাক্ষণ হাড়ভাঙ্গা খাঁটুনি দিয়ে যেসব মানুষ বিপুল ফসল উৎপাদন করে তারাই কৃষক নামে পরিচিত। বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। বাংলাদেশ মানেই গ্রাম বাংলা, পল্লীবাংলা, মাটি ও মানুষের বাংলা।এক কথায় গোটা বাংলাই কৃষিক্ষেত্র। কিন্তু সেই রুদ্রে পুড়া কৃষকদের ঈদের কথা কি, শহুরে মনিবদের মনে থাকে। যারা শহুরে সাহেব হয়েছে, তাদের নাড়ীর শিকর’ত গ্রামে। চাকচিক্যময় চারদেয়ালে সোডিয়াম বাতি জ্বালিয়ে আমারা যে শস্যদানা আহার করি, তার পিছনের ইতিহাস কি আমরা মনে করি? যাদের শ্রমে, যাদের ঘামঝরা পরিশ্রমে আমাদের অর্থনীতির চাকা চলমান, তাদের প্রতি কি আমাদের দায়িত্ব নেই?

” হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়,
পাহাড়-কাটা সে পথের দু’পাশে পড়িয়া যাদের হাড়,
তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি,
তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি;
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান। ”
যে অর্থে রাহমানুর রাহিম এই ধরাতে ঈদের বার্তা পাঠিয়েছেন, তাহা আজ বড়ই অপরিপূর্ণ। যে ঈদ ভ্রাতৃত্বের, বন্ধনের, ভালবাসার ও ত্যাগের বার্তা নিয়ে আসে, আজ তাহা ধনী -গরিবের ব্যবধানের চিত্র ফুটিয়ে তুলে। এই ঈদ মহামানব মুহাম্মদের নয়। নয় আবু বক্কর, ওমর,ওসমান,আলী (রা)’র, এই ঈদ বড়ই ব্যবধানের।

“কোথা সে মহা- সাধক আনিবে যে পুন ঈদ?
ছিনিয়া আনিবে আসমান থেকে ঈদের চাঁদের হাসি,
ফুরাবে না কভু যে হাসি জীবনে, কখনো হবে না বাসি।
সমাধির মাঝে গণিতেছি দিন, আসিবেন তিনি কবে?
রোজা এফতার করিব সকলে, সেই দিন ঈদ হবে। ”

পরিবেশ ও মানবাধিকার কর্মী
fb// kamrul.hasan.minar