এইচ এম আবু ছিদ্দিক
স্রষ্টার অনবদ্য সৃষ্টি, মেরিন ড্রাইভ সড়কের দুই পাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে অন্যতম আকর্ষণ সবুজ পাহাড় ও সমুদ্র সৈকতের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য বিশ্ববাসীকে আনন্দ দিতে একটুও কার্পণ্য করেনা। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের তুলনায় বাংলাদেশের আয়তন কিছুটা ছোট হলেও মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর সবুজ পাহাড় ও বিশ্বসেরা দীর্ঘ সমুদ্র সৈকতের মতো কিছু অমুল্য সম্পদ দান করেছেন। লেখার শুরুতেই সেই মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও শোকরিয়া আদায় করছি। আমার পূর্বের কয়েকটি লেখায় কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সম্পদের গুরুত্ব তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আজকের লেখায় পর্যটন শিল্পের সৌন্দর্য্য ও দেশী-বিদেশী পর্যটকদের চাহিদাসহ বিভিন্ন সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে লেখার চেষ্টা করব, ইনশাআল্লাহ। পর্যটন শিল্প হচ্ছে ভ্রমনকারীদের চাহিদার উপর নির্ভর করে গড়ে উঠে। এই শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে, পর্যটকদের যাতায়ত সুবিধা, থাকা-খাওয়া, নিরাপদ পরিবেশ ও রাস্তা-ঘাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্নসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। বিশেষ করে পর্যটকরা যা দেখতে আসে সেগুলোকে যতœ সহকারে নিরাপদ রাখা। বেশ কয়েকজন দেশী-বিদেশী পর্যটকের সাথে কথা বলে কক্সবাজারের প্রকৃতি সম্পর্কে তাদের অনুভূতি জানার চেষ্টা করেছি। প্রায় সকলেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখে খুবই আনন্দিত। তাছাড়া থাকা-খাওয়া ও নিরাপত্তা নিয়ে তাদের কোন অভিযোগ নেই। তবে প্রধান সড়কে অতিরিক্ত গাড়ীর চাপ, উপসড়কে কাঁচা রাস্তার কাদা ময়লা-আবর্জনা ও ঢাকা-কক্সবাজার মহাসড়কে দীর্ঘ সময় গাড়ীতে বসে থাকাসহ যানজট নিয়ে প্রচুর আপত্তি রয়েছে তাদের। বিধায় অনতিবিলম্বে এই গুরুত্বপূর্ণ সড়কটি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার চার লেনে সম্প্রসারণসহ বিকল্প আরও একটি মহাসড়কের পরিকল্পনা নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। বিশ্বসেরা দীর্ঘ সমুদ্র সৈকতকে কেন্দ্র করেই পর্যটন শিল্প গড়ে উঠেছে। সুতরাং কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প হচ্ছে, বিশ্ব মানের। অনেকেই আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন শিল্প গড়ে তুলার কথা বলে বিশ্বসেরা প্রকৃতির মহাদানকে ছোট করে দেখার চেষ্টা করে। আমি তাদেরকে আহবান জানাব, কক্সবাজার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকতের বিকল্প অন্য কোথাও থাকলে আমাদেরকে দেখানোর জন্য। পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করব, আগামীতে যতগুলো আন্তর্জাতিক মানের সেমিনার হবে সবগুলো যেন, কক্সবাজার সাগর পাড়ের মনোরম পরিবেশে অস্থায়ী শামিয়ানা নির্মাণ করে আয়োজনের ব্যবস্থা করা হয়। যাতে করে সারা বিশ্বের মানুষ কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে মনোমুগ্ধকর দৃশ্য উপভোগ করতে পারে। কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প হচ্ছে, প্রকৃতি নির্ভর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য যতদিন সংরক্ষণ থাকবে, ততদিন প্রকৃতি প্রেমী মানুষ কক্সবাজার বেড়াতে আসবে। যত্রতত্র স্থাপনা নির্মাণ করে প্রকৃতির শোরুম নষ্ট করলে অদুর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্থ হবে। কক্সবাজারের মতো বিশ্বের অনেক দেশে সমুদ্র সৈকতকে পুঁজি করে পর্যটন শিল্প গড়ে উঠেছে। আমার দীর্ঘ প্রবাস জীবনে বেশ কয়েকবার বিদেশের মাটিতে সমুদ্র সৈকতে বেড়ানোর সৌভাগ্য হয়েছে। সেখানে পর্যটন এলাকায় যাতায়ত ব্যবস্থা খুবই সুন্দর ও সহজ। তাছাড়া পর্যটকদের বিনোদনের জন্য মানব তৈরী আকর্ষণীয় বিভিন্ন কারুকার্য ও বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে। তবে সেগুলো দেখতে প্রথম ২/১ বার ভাল লাগলেও তৃতীয়বার আর দেখতে আকর্ষণীয় মনে হয়না। কিন্তু কক্সবাজারের প্রাকৃতিক দৃশ্য এতই সুন্দর যতই দেখি ততই নিজেকে উৎফুল্ল ও সতেজ মনে হয়। বারবার দেখা সত্ত্বেও আবার দেখতে ইচ্ছে করে। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে চাই, অন্যান্য দেশে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তুলা পর্যটন শিল্পের তুলনায় কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে গুরুত্ব অনেক বেশী। আমার মতো অসংখ্য মানুষের কাছে প্রাকৃতিক সম্পদের গুরুত্ব বেশী হলেও কিছু লোভী মানুষের দৃষ্টিতে তার বিপরীত হতে পারে। হয়তো প্রকৃতির চেয়ে মানব তৈরী বহুতল ভবনের লোভ থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাদের প্রতি আমার অনুরোধ থাকবে, সৈকতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ধ্বংস করে বহুতল ভবন নয়, অন্য কোথাও করলে জাতি অশনি সংকেত থেকে রক্ষা পাবে। বিষয়টি সহজভাবে বোঝানোর জন্য একটু পিছনের দিকে ফিরে যেতে হয়। বেশ কয়েকবার মোটরসাইকেল যোগে মেরিন ড্রাইভ সড়ক, এল,জি,ই,ডি সড়ক, আবার কখনো সৈকতের ভেজা বালির উপর দিয়ে দুই পাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যতম আকর্ষণ সবুজ পাহাড় ও সমুদ্র সৈকতের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে দেখতে টেকনাফ যাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সেখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য এতই সুন্দর যে, মনে হয় পৃথিবীর ভিতরেই অভিনব পৃথিবী। তবে মেরিন ড্রাইভ সড়ক উদ্বোধনের আগের দিন আমার সহধর্মিণীসহ বাচ্চাদের অনুরোধে ইনানী যাওয়ার পথে হিমছড়ি পাথরটেক নামের মেরিন ড্রাইভ সড়কের পূর্বপার্শ্বে নির্মাণাধীন বিশাল বিল্ডিং দেখে আমার ছোট মেয়ে সারারা ছিদ্দিক (০৫) হঠাৎ বললো, আব্বু এই বিল্ডিংটা বানাইছে কে? এইটার জন্য’তো আমি পাহাড় দেখতে পাচ্ছিনা। আগে যাওয়ার সময়তো এটা ছিলনা, সবুজ গাছ গুলো দেখতে আমার খুব ভাল লাগতো। আব্বু তুমি একটু বিল্ডিংটা সরাইতে বলনা। এই পাঁচ বছরের শিশুর অনুভূতির চমৎকার প্রশ্ন গুলির কোন সদউত্তর আমার কাছে ছিলনা। শুধু এইটুকু বলে তাকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম, আম্মু আমার কাছে’তো এটা সরানোর ক্ষমতা নেই। সামনে কিছুদূর যাওয়ার পর রাস্তার দুই পাশে প্রধানমন্ত্রীর ছবি দেখে এবার মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করলো, আম্মু সবখানে শেখ হাসিনার ছবি কেন? উত্তরে মা বললো, শেখ হাসিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী তাই। সাথে আমি একটু যোগ করে বললাম, বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী বিশাল ক্ষমতার মালীক। তিনি চাইলে নির্বাহী ক্ষমতাবলে একদিনেই ঐ বিল্ডিংটা ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ দিতে পারে। আমার কথা শেষ হতে নাহতেই অল্প বয়সের শিশু সন্তান আচমকা পাহাড় সমান বায়না ধরে বসলো, বললো আব্বু কালকে প্রধানমন্ত্রী আসলে আমাকে সেখানে নিয়ে যাবে? উত্তরে আমি বললাম কেন আম্মু। অবুঝ শিশু নির্ভয়ে বলে ফেলল, প্রধানমন্ত্রীর সাথে হেন্ডসিপ করব, আর বলব এখানে যেন কোন বিল্ডিং না হয়। সারারার মতো প্রত্যেক শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষৎ, তাদের আবার ভয় কিসের। এখানে ছোট্ট শিশু সারারার অনুভূতি থেকে আমরা কি শিক্ষা পেলাম। শিক্ষা একটাই, প্রকৃতির সমন্বয় ছাড়া পর্যটন শিল্প মুল্যহীন। শুধু সাগর দিয়ে পর্যটন শিল্প হয়, ভ্রমনের পুরোপুরি আনন্দ পাওয়া যায়না। পরিপূর্ণ আনন্দ পেতে হলে প্রয়োজন প্রকৃতির সমাহার। যেমন- পাহাড়, পর্বত, গাছ-পালা, নদী-নালা, সাগর-মহাসাগর ইত্যাদি। যা কক্সবাজারে সবই বিদ্যমান। সুতরাং আমাদের পর্যটন শিল্প হতে হবে প্রকৃতি নির্ভর। পাঁচ বছরের শিশু সারার প্রথম প্রশ্নটি আমাকে করা হলেও সেইদিন প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার কারণে গাড়ী চলাচল বন্ধ থাকায় তার আশা পূরণ করতে পারিনি, তাই আমি দুঃখিত। সারারার দ্বিতীয় চাওয়াটি ছিল, প্রধানমন্ত্রীর সাথে হেন্ডসিপ করা, এবং সমুদ্রের কিনারায় পাহাড়ের তলদেশে যেন আর কোন ধরণের উঁচু ভবন নাহয়, সে বিষয়ে নিজেই প্রধানমন্ত্রীকে অবগত করা। যা সবুজ বেষ্টণীর মনোমুগ্ধকর দৃশ্যকে আড়াল করে রাখে। আমি বাবা হয়ে সারারাকে সেই সুযোগ করে দিতে ব্যর্থ হয়েছি। যা আজকের লেখার মাধ্যমে পাঠকের কাছে তুলে ধরে বাবার দায়িত্ব পালন করেছি মাত্র। এখন দেখার অপেক্ষায় সারারার অনুভূতি কতটুকু বাস্তবে পরিনত হয়, নাকি অর্থ-বিত্তের কাল থাবায় আড়াল হয়ে যায় প্রকৃতির অনবদ্য সৃষ্টি সবুজ বেষ্টনী। এখানে অনেকেই বলতে পারেন পারিবারিক ভ্রমন কাহিনীর সাথে পর্যটনের সম্পর্ক কি। আমি বলব সম্পর্ক অবশ্যই আছে। প্রকৃতি প্রেমী শিশু সারারার অনুভূতি থেকে শিক্ষা না পেলে হয়তো আজকের প্রবন্ধটি লেখার সাহস পেতাম না। আমাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মত পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু কক্সবাজারে প্রকৃতি নিয়েই পর্যটন শিল্প গড়ে উঠেছে, এ বিষয়ে কারো দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ নেই। প্রকৃতির টানেই ভ্রমন পিপাসুরা বেড়াতে আসে কক্সবাজারে। অতএব, প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের বিকল্প নেই। কথাটি আগেও অনেকবার বলেছি, প্রকৃতির সৌন্দর্য্য ধ্বংস করে বহুতল নির্মাণাধীন বিল্ডিং দেখে আবারও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। ইতিমধ্যেই কক্সবাজারে অসখ্য বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে। যার মধ্যে বেশ কয়েকটি বিদেশী পর্যটকের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। যা পর্যটকদের আবাসন সুবিধা নিশ্চিত হওয়ার পরও বছরে কয়েকটি বিশেষ দিন ছাড়া সারাবছরই বেশীরভাগ আবাসিক হোটেলের কক্ষ খালী থাকে। এসব হোটেল নির্মাণে হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। সৈকত আবাসিক এলাকায় প্রায় তিন’শর মতো হোটেল-মোটেল, গেষ্ট হাউজ থাকা সত্ত্বেও অভ্যান্তরীণ সড়ক সংস্কার ও প্রয়োজনীয় পয়নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হয় নাই। উপসড়ক গুলোর অবস্থা এতই নাজুক যে, সামান্য বৃষ্টি হলেই হাঁটু পর্যন্ত কাপড় তুলা ছাড়া বিকল্প উপায় থাকেনা। এতে করে পর্যটকরা বেড়ানো’তো দুরের কথা, হোটেল থেকেও বের হতে পারেনা। তখন তারা এক ধরণের ক্ষোভ ও হতাশায় ভোগে। তাছাড়া বাচ্চাদের খেলার মাঠসহ রাস্তার দু’পাশের ড্রেন ও খালী জায়গা গুলো অবৈধ দখলে চলে যাচ্ছে। বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক, এবং আগামী প্রজন্ম ও পর্যটন শিল্পের জন্য মোটেও সুসংবাদ নয়। এছাড়া কলাতলী থেকে শহরে যাতায়তের জন্য একটিমাত্র প্রধান সড়ক। অনেক সময় ভিআইপি নামের সুবিধাভোগিরাও কক্সবাজারে বেড়াতে আসে। তাঁদেরকে নিরাপত্তা দিতে গিয়ে দীর্ঘ সময় প্রধান সড়কটি বন্ধ করে দেয় আইন শৃংঙ্খলা বাহিনী। তখন পর্যটকরা স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেনা। বিধায় ভ্রমনকারীদের বেড়ানোর স্বাদটুকু অনেকটা মলিন হয়ে যায়। কারণ অধিকাংশ পর্যটকই কর্ম-ব্যস্ততার কারণে এখানে ২/১ দিনের বেশী থাকতে পারেনা। তাছাড়া বিকল্প সড়ক না থাকায় প্রায় সময় জানজট লেগেই থাকে। সুতরাং আমাদেরকে জরুরী ভিত্তিতে বিকল্প সড়কের ব্যবস্থা করতে হবে। এখানে উন্নয়ন কতৃপক্ষকে অবগত করতে চাই। সৈকত আবাসিক এলাকার পূর্বপার্শ্বের পাহাড় লাগোয়া সড়কটি সম্প্রসারণ ও সংস্কার করে গাড়ী চলাচলের ব্যবস্থা করা হলে জানজট অনেকটা নিরসন হবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে কিছুনা কিছু প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, কিন্তু প্রত্যেক দেশের রাষ্ট্র নায়কেরা সঠিক পরিকল্পনার অভাবে প্রাকৃতিক সম্পদের সুফল ভোগ করতে পারেনা। তবে অনেক দেশ ইতিমধ্যেই প্রাকৃতিক সম্পদকে পুঁজি করে সফলতা অর্জন করেছে। কক্সবাজারে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রচার-প্রচারণার অভাবে পর্যটন শিল্পের প্রত্যাশিত সুফল আমরা পাইনি। কক্সবাজার পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন শুধু জেলার উন্নয়ন নয়, সারা দেশের উন্নয়ন অর্থাৎ জাতীয় উন্নয়ন। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর কক্সবাজার জেলাটি যতই উন্নত হবে বাংলাদেশ ততই এগিয়ে যাবে। মেরিন ড্রাইভ সড়কের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণ কাজ শেষ করতে দীর্ঘ ২৬ বছর সময় লেগেছে। কাজ শুরু হওয়ার পর কিছু অযোগ্য লোকদের কারণে প্রকল্পটির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। আবার পর্যাপ্ত বরাদ্ধ না পাওয়ায় ধীরগতিতে চলে। তবে সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরে যোগাযোগ মন্ত্রী ওবাইদুল কাদেরের মাধ্যমে কাজটি সম্পন্ন করেছেন। এতে করে দেরীতে হলেও পর্যটন শিল্প একধাপ এগিয়ে গেছে। অবশ্য সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের সাথে সমন্বয় করে মেরিন ড্রাইভ সড়কের কাজটি শেষ করার পিছনে দক্ষ সৈনিকরা প্রশংসার দাবিদার। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আবারও প্রমাণ করল, তারা শুধু জাতিসংঘ শান্তি কমিশনে শুনামের সাথে কাজ করেনা। দেশের উন্নয়নেও তাদের ভুমিকা অপরিসীম। বিশেষ করে ধন্যবাদ জানাতে হয়, দেশে-বিদেশে কর্মরত শ্রমিক ভাই-বোনদের। যাদের ঘামের টাকায় বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে আলোকিত। পর্যটন শিল্পের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, অন্যান্য জেলার সাথে কক্সবাজারের যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত খারাপ। রাজধানী ঢাকা থেকে সড়ক পথে পর্যটন শহরে আসতে ১০ থেকে ১২ ঘন্টা সময় লাগে। তাছাড়া চকরিয়া মাতামুহুরী নদীর ব্রিজটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, যেকোন সময় দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। এসব সমস্যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত সাবরাং তারকা নামে বিলাস বহুল হোটেল নির্মাণ করে হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা মোটেও বাস্তব সম্মত পদক্ষেপ বলে আমার মনে হয়না। বিশেষ করে বিদেশী পর্যটকদের কাছে বিলাস বহুল ভবনের চেয়ে উম্মুক্ত ন্যাচারাল জোনের গুরুত্ব অনেক বেশী। বাস্তবতার আলোকে দেখা যায়। বিদেশী পর্যটকরা তারকা মানের হোটেলে ঘুমানোর চেয়ে (রেজুর ব্রিজের পাশে) মারমেড ক্যাফের লতা-পাতা দিয়ে তৈরী ছোট ছোট ঘরে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। অতএব, দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত এলাকা জুড়েই এক্সক্লুসিভ টুরিষ্ট জোনের পরিবর্তে, এক্সক্লুসিভ ন্যাচারাল টুরিষ্ট জোন ঘোষণা দেওয়ার দাবী জানাচ্ছি। অর্থ্যাৎ দরিয়া নগর থেকে টেকনাফ শেষ সিমানা পর্যন্ত কোন ধরণের উঁচু ভবন করা যাবেনা। কারণ ইতিমধ্যেই বেশ কয়েক ডজন তারকা মানের বিলাস বহুল হোটেল কক্সবাজারে গড়ে উঠেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি সাবরাং এক্সক্লুসিভ হোটেল নির্মাণের বরাদ্ধকৃত টাকা অপচয় নাকরে, যেসব এলাকায় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বিলাস বহুল হোটেল গড়ে উঠেছে। ঐসব এলাকার রাস্তা-ঘাট সংস্কারসহ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কটি চার লেনে রুপান্তর করা হলে নিঃসন্দেহে পর্যটকের সংখ্যা বাড়বে। এতে করে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতিও বাস্তবায়ন হবে। সবচেয়ে হতাশার বিষয় হচ্ছে, দীর্ঘ নয় বছর অতিবাহিত হলেও কক্সবাজার রেল লাইনের জায়গা বেচা-কেনা এখনো শেষ হয়নি। প্রকল্পের বাজেট বাড়তে বাড়তে সাধারণ মানুষের হিসাবের বাইরে চলে গেছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, টেকনাফ জালিয়ার দ্বীপ নদীর উপর ঝুলন্ত ব্রিজ নির্মাণসহ নাফ ট্যুরিজম পার্ক করার পরিকল্পনা অত্যন্ত যুগউপযোগী সিদ্ধান্ত। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের বিনোদনের নতুন দিগন্ত উম্মোচন হবে। যাই হউক, কক্সবাজার নিয়ে যতবেশী আলোচনা বা গবেষণা হবে ততবেশী ভাল ফলাফল বেরিয়ে আসবে। এটাই আমার প্রত্যাশা। আমি আবারও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, সাবরাং চাষ যোগ্য কৃষি জমিসহ প্রায় ১ হাজার ১৬৫ একর বিচ দখল করে এক্সক্লুসিভ টুরিস্ট জোনের অজুহাতে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হলে, আমরা লাভের চেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হব বেশী। প্রকৃতির অনবদ্য সৃষ্টির চেহারাই নষ্ট হয়ে যাবে, পাল্টে যাবে সৈকতের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। এসব প্রকল্প দিয়ে সুবিধাভোগীরা সাময়িক লাভবান হলেও, দীর্ঘ মেয়াদী পর্যটন শিল্প ও আগামী প্রজন্মের জন্য এটা হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। তাছাড়া প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করা পর্যটন শিল্পের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে, সর্বশেষ আমও যাবে ছালাও যাবে। আমাদের আরেক সমস্যা হচ্ছে, পাহাড় কাটা। ২০০৭ সাল থেকে পাহাড় কাটার কারণে মাটি ধসে অসখ্য মানুষ অকালে প্রাণ হারিয়েছে। প্রায় সকলেই শিকার করে প্রভাবশালীরাই পাহাড় কেটে ভূমি দখল করেছে এবং করছে। বাস্তবেও তাই ঘটছে। তাহলে প্রভাবশালী এরা কারা? এদের বিচার করাকি এদেশে পাপ। নাকি এরা আইনের উর্ধ্বে। বাপ-দাদার আমলে পাহাড়কে পৃথিবীর পেরেক বলা হতো। আজকাল পাহাড় খেকোদের কাছে এসব কথার বালাই নেই। গত কয়েকদিন আগে বিভিন্ন জেলায় পাহাড় ধসে প্রায় দেড়’শ মানুষ মারা গেছে, এই অনাকাক্সিক্ষত দুর্যোগ থেকে বাঁচতে হলে, প্রকৃতিকে বাঁচানোর বিকল্প নেই। প্রকৃতিকে আঘাত করলে প্রতিঘাত সহ্য করার ক্ষমতা আমাদের নেই। সুতরাং- টাকা কামানোর জন্য পাহাড় ও বনের গাছ কেটে প্রাকৃতিক পরিবেশকে আঘাত করে মানুষ হত্যা করার চেয়ে, ভিক্ষা করে খাওয়া অনেক শ্রেয়। সকলের মনে রাখা উচিৎ, পাপ কাউকে ছাড়েনা, ভবিষ্যতেও ছাড়বেনা। সবক্ষেত্রে ভাল কাজের প্রয়োজন হয়না, যদি খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে পারি। এবার মূল প্রসঙ্গে ফিরে যায়, প্রবন্ধটি লেখার কয়েকদিন আগে প্রকৃতির টানে স্বপরিবারে মেরিন ড্রাইভ সড়কের শেষ সিমানা সাবরাং বেড়ীবাঁধসহ টেকনাফের নতুন নির্মাণাধীন জেটি দেখতে গিয়েছিলাম। জেটিটি দেখতে খুব সুন্দর হলেও মাঝে মাঝে ফাটল দেখা দিয়েছে, বিষয়টি উদ্বেগজনক। এনিয়ে ঠিকাদারী প্রতিষ্টানটিকে আরও গবেষনার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনেকরি। তাছাড়া শাহপরীরদ্বীপ যাওয়ার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না হওয়ায় সম্ভব হয়নি। শাহপরীরদ্বীপে বসবাসরত বিজিবি, কোস্টগার্ড, পর্যটকসহ হাজার হাজার মানুষের যাতায়তের একমাত্র (টেকনাফ থেকে নয়াপাড়া হয়ে শাহপরীরদ্বীপ) সড়কটি জোয়ারের পানিতে বিলীন হয়ে গেছে। এই গুরুত্বপূর্ণ সড়কটি সংস্কার করা প্রয়োজন। বিষয়টি প্রায় দুইবছর আগেও “শাহপরীরদ্বীপে একদিন” শিরোনামে আমার ভ্রমন কাহিনীতে তুলে ধরেছিলাম। যা অত্যন্ত পাঠক প্রিয় ‘দৈনিক আমাদের কক্সবাজার’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সাম্প্রতিক পানি সম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ টেকনাফ সফরকালে শাহপরীর দ্বীপ বেড়ীবাঁধ নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু কত কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হবে সীমানা নির্ধারণ করে বিস্তারিত কিছু বলেননি। বিষয়টি যখন সরকারের নজরে এসেছে, এদেশের নাগরিক হিসাবে আমার পরামর্শ থাকবে। সাবরাং থেকে শাহপরীরদ্বীপ হয়ে নতুন জেটি পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ সড়কের মতো মজবুত করে নির্মাণ করা হলে, আমরা দুই দিকে লাভবান হব। একদিকে দ্বীপ অঞ্চলের মানুষসহ সকল যাতায়তকারীদের দুর্ভোগ লাঘব হবে। অন্যদিকে পর্যটন শিল্পের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধিসহ প্রতিবছর জোয়ারের পানিতে যে পরিমান সম্পদের ক্ষতি হয়, তা থেকেও রক্ষা পাবে। তাছাড়া কুতুবদিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় বেড়ীবাঁধ ভেঙ্গে সামান্য জোয়ারের পানিতে ক্ষতিগ্রন্থ হচ্ছে অসখ্য মানুষ। কক্সবাজার জেলায় সম্ভাবনা যেমন রয়েছে, তেমনি সমস্যাও কম নয়। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুম শুরু হলেই ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে কক্সবাজারের বেশীরভাগ এলাকা বন্যায় প্লাবিত হয়। তখন হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, ঘর-বাড়ী, ক্ষেত-খামারসহ অসখ্য সম্পদ পানিতে তলিয়ে যায়। এমনকি পানির ¯্রােতে ভেসে গিয়ে অনেকেই অকালে প্রাণ হারায়। গত কয়েক দশক ধরে কোন সরকারের আমলেই ভরাট হয়ে যাওয়া নদী-নালাসহ খাল খননের উদ্যোগ নিয়েছে কিনা আমার জানা নেই। বেশীরভাগ নদী প্রভাবশালীদের দখলে চলে গেছে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাঁকখালী নদী। অবৈধ দখলবাজদের উচ্ছেদ পূর্বক নদীগুলো খনন করে টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা হলে, প্রতিবছর বন্যায় কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ ক্ষতি হতোনা। গ্রামীন কৃষকের গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু, বাড়ীর চারপাশে শাক-সবজিসহ প্রয়োজনীয় সবকিছুই নিজেদের থাকতো। তখন বিদেশ থেকে চাউল আমদানি করে জনগণের করের টাকায় জমানো মুলধনের উপর আঘাত করতে হতোনা। চাল-ডালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য-দ্রব্য সাধারণ মানুষের ক্রয়-ক্ষমতার নাগালে থাকতো। এক কথায় বলতে গেলে দেশের মানুষ স্বস্তিতে থাকতো। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আগে, দেশের মানুষকে বাঁচিয়ে রাখাটাই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ সরকারকে শহর কেন্দ্রিক মনোভাব পরিহার করে গ্রামীন উন্নয়নের পথেই হাঁটতে হবে। পাশাপাশি নদী-নালাসহ রাস্তা-ঘাট দখলকারী যতই শক্তিশালী হোক’না কেন, এরা দেশদ্রোহিদের চেয়েও ভয়ানক, এদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে নদী-নালাসহ জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে সামান্য বৃষ্টি হলেই ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শহরে জলাবদ্ধতা অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়, সেখান থেকে শিক্ষা নিয়েই পর্যটন শহরকে রক্ষা করতে হবে। তাছাড়া সাগরের বুকচিরে জেগে উঠা একাধিক ছোট-বড় দ্বীপসহ কক্সবাজার জেলার অধিকাংশ উপকূলীয় এলাকা নি¤œাঞ্চল। প্রায় সময় ঘুর্ণিঝড়ের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে যায়। সাম্প্রতিক ঘুর্ণিঝড় মোরার আঘাতে কক্সবাজারসহ বিভিন্ন জেলায় প্রায় ২০ হাজার ঘর-বাড়ী বিধ্বস্ত হয়ে হাজার কোটি টাকার সম্পদ ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার লোকজন আত্মসম্মান থাকা সত্ত্বেও নিরুপায় হয়ে সরকারী-বেসরকারী সাহায্য নিতে বাধ্য হচ্ছে। সাহায্যের পরিমান যতই বেশী হোক না কেন, এক পুকুরের পানি দিয়ে অন্য পুকুর ভরেনা। সারাদেশের পাহাড়ী জনগোষ্টী ও উপকূলীয় এলাকার সমস্যা একদিনের নয়, দীর্ঘদিনের। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভবিষ্যতে এই সমস্যা বছর জুড়েই হতে পারে। এসব সমস্যা সমাধান না করে আমরা যতই ডিজিটেল সিটি, বা উড়াল সেতু, বা স্মার্ট ফোন ব্যবহার করিনা কেন, এসব ডিজিটেল সিটি, বা উড়াল সেতু দিয়ে দেশের বা দেশের মানুষের উন্নয়ন, প্রকৃত উন্নয়ন নয়। ডিজিটেল সিটির চেয়ে ডিজিটেল গ্রাম গড়াটাই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। গ্রাম অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ মাছ-লবন, চাল-ডাল, শাক-সবজিসহ বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য-দ্রব্য উৎপাদন করে। আর শহরের মানুষ এসব উৎপাদনের সাথে সম্পর্ক খুবই নগণ্য। সম্প্রতিক হাওর অঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় বেড়ীবাঁধ ভেঙ্গে ব্যাপক ফসলের ক্ষতি হয়েছে। এটি অপরিকল্পিত উন্নয়নের অংশ বললেও ভুল হবেনা। যার কারণে বিদেশ থেকে চাউল আমদানি করতে হচ্ছে। চালের দাম বৃদ্ধি নিয়ে হতাশা যেমন রয়েছে, তেমনি ভবিষ্যতে টাকা দিলেও চাল পাওয়া যাবে কিনা, এসব বিষয় নিয়ে চিন্তা করলে চোখে ঘুম আসেনা। বিশেষ করে খাদ্য-দ্রব্য আমদানি নির্ভর দেশ উন্নয়নশীল দেশ হতে পারেনা। আমদানি নির্ভরতা পুঁজিবাদীদের কাছে ভোগ-বিলাসিতা হলেও গরীব অসহায় মানুষের জন্য অশনি সংকেত। খাদ্য ঘাটতি শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপীও হতে পারে। তখন টাকা থাকলেও কোন দেশ চাল-ডাল বিক্রি করবে কিনা, এখনই ভেবে দেখার বিষয়। সুতরাং উৎপাদন করতে হলে, গ্রামীন মানুষকে বাঁচানোর বিকল্প নেই। গ্রামীন মানুষের জীবনমান উন্নয়নসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত সিটি শহরের উড়াল সেতু, বা ডিজিটেল সিটি যুগোপযোগী উন্নয়ন বলে পরিকল্পনাবিদরা মনে করলেও, অন্তত আমি বিশ্বাস করিনা। ভাত-মাছ, ডাল-লবন ছাড়া উড়াল সেতু দিয়ে মানুষের পেট ভরেনা। এছাড়া সেতুর নিচে খালী জায়গাগুলো এমনিতেই অকেজো হয়ে পড়ে। তবে দেশ খাদ্য-দ্রব্য উৎপাদনে স্বয়ং সম্পন্ন হয়ে গেলে ডিজিটেল সিটি, বা উড়াল সেতুর পরিকল্পনা অলোচনায় আসতে পারে। তাছাড়া কোটি কোটি টাকা খরচ করে উন্নয়ন মেলা, বা প্রচার মেলা করা বাস্তব সম্মত প্রচার বলে আমার মনে হয়না। সেগুলো খাতা-কলমে সীমাবদ্ধ থাকে। ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার লোকজন মেলা দেখতে আসেনা। এরা বাস্তব সমাধান চায়। একটি প্রবাদ বাক্য ভুলে গেলে চলবেনা, ‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’। দেশের মানুষ শান্তি থাকলে জনগণের আমানতের শতকোটি টাকা খরচ করে মেলা করতে হবেনা। এমনিতেই জনগণ নিজের মুল্যবান সম্পদ আমানত রাখবে, এবং যুগযুগ ধরে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। প্রতিবছর পানি উন্নয়ন বোর্ডের বরাদ্দকৃত অধিকাংশ টাকায় পানির নিচে চলে যায়। অথচ পরিকল্পিতভাবে টেকসই বেড়ীবাঁধ নির্মাণ করা হলে এক টাকাও অপচয় হতো না। হয়তো’বা এক বছরের জায়গায় দু’বছর সময় লাগতো। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন রয়েছে, তেমনি প্রাকৃতিক দুর্যোগও থাকবে। এই হচ্ছে প্রকৃতির নিয়ম। তাই বলে গ্রাম ছেড়ে শহর মুখী হওয়া বাস্তব সমাধান নয়। যেই কাজ একবার শুরু করব, সেই কাজ মজবুত করে শেষ করব। এটাই হতে হবে উন্নয়নের মূল লক্ষ্যে। জোড়াতালি দিয়ে দেশের উন্নয়ন হয় না, বরং টাকা অপচয় ও ভোগান্তি বাড়ে। অধিকাংশ উপকূলীয় এলাকায় উৎপাদন হয় লবন, চিংড়ি, সুটকিসহ অসখ্য মুল্যবান সম্পদ। যা দেশের চাহিদা মিঠিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হয়। এসব মুল্যবান সম্পদ ও উপকূলীয় এলাকার লোকজনকে রক্ষা করতে হলে, দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। আমার মতে বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণ করা স্থায়ী সমাধান নয়। সাইক্লোন সেন্টারে দুধের বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ঘুমানো’তো দুরের কথা, ঠিকমতো বসার জায়গাও পাওয়া যায় না। তাছাড়া দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের টাকা দিয়ে সাজানো বাড়ী-ঘর ছেড়ে সাইক্লোন সেন্টারে চলে যাওয়া সহজ কথা নয়। সুতরাং আমাদেরকে স্থায়ী সমাধানের পথে হাঁটতে হবে। উপকূলীয় এলাকায় কমপক্ষে ০১ (এক) হাজার পাঁচতলা (প্রতি ফ্লোরে চার ফ্ল্যাট বিশিষ্ট) পাকাবাড়ী নির্মাণ করে অন্তত ২০ হাজার পরিবারের স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া সৎ, দক্ষ প্রকৌশলীদের পরামর্শক্রমে নি¤œাঞ্চল এলাকায় প্রশস্ত টেকসই বেড়ীবাঁধ নির্মাণ করা একান্তই জরুরী। এই প্রকল্প দু’টি বাস্তবায়নে সর্বমোট কতটাকা খরচ হতে পারে, একটি স্বচ্ছ জরিপ চালানোর মাধ্যমে স্থায়ী সমাধানের পথ বেরিয়ে আসতে পারে। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় যারা ফ্ল্যাট বরাদ্দ পাবেন, (অর্থাৎ নি¤œাঞ্চল এলাকার ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার) তাদের নিজেদের হাত দিয়ে ভবন ও বেড়ীবাঁধ নির্মাণের টাকা খরচ করলে, এক টাকাও দূর্নীতি হবে না। সেক্ষেত্রে প্রতিটি পাঁচতলা ভবনের খরচ, ৫০ (পঞ্চাশ) লাখের কম-বেশী হতে পারে। একেকটি ভবনে ২০ পরিবার থাকতে পারবে। স্বচ্ছ লটারীর মাধ্যমে ফ্ল্যাট গুলো বরাদ্দ দিলে কোন সমস্যা হবে বলে আমার মনে হয়না। তবে চুক্তিতে উল্লেখ থাকতে হবে, যেকোন দুর্যোগের সময় উপরে-নিচে সবাই সমান সুযোগ-সুবিধা পাবে। প্রতিটি উপকূলীয় এলাকায় ২০ পরিবারের সদস্যদের সমন্বয় পূর্বক ৫০ (পঞ্চাশ) লাখ টাকা সহজ শর্তে লোণ দিয়ে পাকা বাড়ী নির্মাণ করার সুযোগ দিলে, এসব এলাকার মানুষ বারবার লেংটা হওয়া থেকে বেঁচে যাবে। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে এদের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য। তাছাড়া প্রতিবছর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়, বা সরকারের পক্ষ থেকে শতকোটি টাকার ত্রাণ বিতরণ করে সরকারী কোষাগার খালী করতে হবে না। এতে করে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার গুলোর সংসারেও স্বচ্ছতা ফিরে আসবে। তখন এরা ব্যাংকের লোণের টাকা ফেরত দিতে পারবে। এছাড়া বেড়ীবাঁধের এলাকা জুড়েই গাছ লাগিয়ে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তুলার দায়িত্বও নিরাপত্তার স্বার্থে নিজেরাই করে নেবে। আমাদের দেশে টাকার অভাব নেই। প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যায়। ব্যাংকের কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প থেকে হাজার কোটি টাকা দূর্নীতি হয়। বছরে কয়েক’শ কোটি টাকার মাদকদ্রব্য (অবৈধ পথে প্রতিবেশী দেশ থেকে) নিয়ে এসে দেশের যুব সমাজকে ধ্বংস করা হয়। প্রাণহীন পুতুল খেলায় শতকোটি টাকা খরচ করা হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্য, এসব টাকার ব্যপারে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের মাথা ব্যথা নেই। অনেকের থাকলেও দলীয় সুযোগ-সুবিধা হারানোর ভয়ে বলতে চায় না। এইসব টাকার অংক বিবেচনা করলে, দেশের জনস্বার্থে ব্যয় করা টাকার পরিমান খুবই সামান্য। এই জঘন্য অপরাধের সাথে যারা জড়িত, এরা কোন সাধারণ মানুষ নয়। মুখোশধারী বেইমান, অর্থাৎ দেশের শত্রু। এদেরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে যারা সহযোগিতা করে, এরাও এক শ্রেনীর দালাল। এসব অপরাধীদের হাত থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে বাচাঁতে পারলে, একটি পদ্মাসেতু বা একটি বেড়ীবাঁধ বা একটি গভীর সমুদ্র বন্দর বা শুধু এক হাজার পাঁচতলা ভবন নয়। দেশের টাকা দিয়ে আরও কয়েকটি পদ্মাসেতু বা বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা অসম্ভব কিছু নয়। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান মতে, দেশের ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনা করলে, সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারলে, বেশ কয়েকটি বড় সমস্যার সমাধান হবে, যেমন- ০১. প্রতিদিন হাজার হাজার বিদেশী লোকজন গভীর সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের সুবাদে কক্সবাজার যাতায়ত করবে। এদের মধ্যে অধিকাংশই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে মনোমুগ্ধকর দৃশ্য উপভোগ করতে ছুঠে আসবে পর্যটন শহরে। এতে করে বিশ্বব্যাপী পর্যটন শিল্পের প্রচার-প্রচারনা বৃদ্ধি পাবে। ০২. বন্দরের মালামাল পরিবহনের জন্য যেই মহাসড়কটি নির্মাণ করা হবে, সেটি উপকূলীয় এলাকার বেড়ীবাঁধের সাথে সমন্বয় করে করা হলে অধিকাংশ এলাকায় বেড়ীবাঁধের প্রয়োজন হবে না। এতে করে নি¤œাঞ্চল এলাকার লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাবে। ০৩. সড়কটি কক্সবাজার-চট্টগ্রাম-ঢাকা সংযুক্ত হলে, রাজধানী ঢাকার সাথে পর্যটন শহরের যাতায়ত সুবিধার পাশাপাশি সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা আধুনিকায়ন ও সহজ হবে। ০৪. বর্তমানে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের গভীরতা কম হওয়ায় বড় জাহাজগুলো নোঙর করতে পারেনা, ছোট জাহাজ দিয়ে বন্দরে মালামাল আনা-নেওয়া করা হয়। ফলে সময় যেমন বেশী লাগে, তেমনি খরচও কয়েক গুণ বেড়ে যায়। ইহাতে দেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ০৫. তেল-গ্যাসসহ অন্যান্য সমুদ্রসম্পদ আহরণ ও ব্যবহারের সুযোগ-সুবিধা বাড়বে। ০৬. সাগর-মহাসাগর প্রভাব বিস্তারে বিভিন্ন দেশের নৌবাহিনীর প্রতিযোগিতা ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান, যেকোন সময় দেশের সমুদ্র সিমানা নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়তে পারে। তখন বাংলাদেশের দক্ষ নৌবাহিনী বিকল্প নৌঘাঁটি হিসাবে বন্দরটি ব্যবহার করতে পারবে। ইহাতে বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রসীমা বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ হলে কি পরিমান বাংলাদেশ লাভবান হবে, সংক্ষিপ্ত লেখায় সঠিক পরিসংখ্যান তুলে ধরা সম্ভব নয়। বর্তমান সরকার পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ইতিমধ্যে বিমান বন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণসহ কয়েকটি প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। আরও কয়েকটি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। তার মধ্যে মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যূৎ কেন্দ্র নিয়ে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের তথ্য মতে অনেক তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। অদুর ভবিষ্যতে প্রাকৃতিক জীব-বৈচিত্র যেন হুমকির মুখে নাপড়ে, সেটি গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় রেখে পরিবেশ বান্ধব প্রকল্প বাস্তবায়ন করাটাই দেশের জন্য মঙ্গল। প্রত্যেক মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে পরিবেশের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। এখানে পরিবেশ বলতে মুলতঃ প্রাকৃতিক পরিবেশকেই বিবেচনা করা হচ্ছে। সকালের সূর্যোদয়, দুপুরের কাঠফাটা রোদ, রাতের মেঘমুক্ত আকাশে তারার মেলা, গরমের অস্বস্তি কিংবা শীতের পরশ, বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, শহুরে জীবনের কোলাহল, দূষণ প্রভৃতি হাজারো প্রাকৃতিক ঘটনা ও উপদানের সঙ্গে আমরা পরিচিত। এ সকল ঘটনা ও উপদান পরিবেশের সাথে সংশ্লিষ্ট। পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ট থেকে বায়ুমন্ডলের ওজোনস্তর পর্যন্ত বিস্তৃত পরিমন্ডলের সবকিছু নিয়ে পরিবেশ। জীবনের গতিময়তায় পরিবেশ কখনো আমাদের সহায়ক আবার কখনো প্রতিবন্ধক হিসাবে কাজ করে। চলমান সভ্যতার ধারাবাহিকতায় প্রকৃতি তথা পরিবেশ নানাভাবে আমাদের প্রভাবিত করেছে এবং করছে। মানুষও প্রকৃতিকে কম প্রভাবিত করেনি। বদলে দিয়েছে পরিবেশের অনেককিছু। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পরিবেশ সংশ্লিষ্ট ধ্যানধারণা ও অনুশীলন থেকে আমরা এমন অনেক কিছুই জানতে পেরেছি, পৃথিবী ক্রমশঃ উষ্ণ হয়ে যাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তন, ঝড়জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপ বৃদ্ধি, বিভিন্ন অঞ্চলে সুনামীর আঘাত, জীববৈচিত্র্যের অবক্ষয়, প্রজাতির বিলুপ্তি, বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি, পানি দূষণ, শব্দ দূষণ ইত্যাদির সাথে জনজীবনের সম্পৃক্তি নানাভাবেই আলোচিত। প্রাকৃতিক পরিবেশ মানুষের জীবনধারণ ও বসবাসের জন্য স্থান, আলো, বাতাস, পানি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদান সরবরাহ করে পরিবেশকে মানুষের বাসযোগ্য রাখে, এবং সম্পদের যোগান দেয়। বিধায় প্রাকৃতিক পরিবেশ আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
লেখক ঃ কলামিস্ট ও প্রতিষ্টাতা পরিচালক, দৈনিক কক্সবাজার বাণী
মোবাইল- ০১৫৫৮৩৬৩৩৪৩
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।