মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ :
ইসলাম একটি স্বাশ্বত ধর্ম। মহান আল্লাহ্ তায়ালার একমাত্র মনোনীত ধর্ম। আল্লাহ তায়ালা মানুষ সৃষ্টি করেছেন, পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য। আদম সন্তানদেরকে আল্লাহ তায়ালা উঁচু মর্যাদা দেয়ার কথা বলেছেন। পবিত্র কুরআনে তিনি বলেন; ‘আমি আদম সন্তানদেরকে (মানবজাতিকে)উঁচু মর্যাদায় সমাসীন করেছি। (ওলকদ কর্রমনা বনি আদমা)। আর মানুষ হলো: সৃস্টির সেরা ‘জীব’। ‘(আশরাফুল মাখলাকুত)। আবার এ মানুষের স্বভাব-চরিত্র বিশ্লেষণ করে সূরা তীনে আল্লাহ তায়ালা ‘মানুষ’কে চিত্রিত করেছেন এভাবে যে, ‘নিশ্চয়ই আমি মানুষ সৃষ্টি করেছি, উত্তম আকৃতি দিয়ে। আর সে মানুষই ইতরের চেয়ে ইতরতম হয়ে গেছে’। (লকদ খলাকনাল ইনসানা ফি আহসানী তকবিম। সুম্মা রদদনাহু আসফলা সাফিলীন)। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ করেছেন, ‘মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান খুঁজে পাওয়ার বিধান হিসেবে’। আর মহানবী হযরত মুহাম্মদ(দ:)-কে আল্লাহ তায়ালা মানব জাতির জন্য আশীর্বাদ এবং পথ প্রদর্শক হিসেবে এ পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে (মানব জাতিকে) উদ্দেশ্য করে বলেন; ‘তোমাদের জন্য তোমাদের আল্লাহ্‘র রসূলের (জীবনে) মাঝে উত্তম শিক্ষণীয় ও অনুসরণীয় আদর্শ নিহীত রয়েছে’। (লকদ কানা ফি রসূরূলুল্লাহি উসওয়াতুন হাসনা)। আবার মা আয়েশা মহানবীর চরিত্র সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাব দেন এভাবে যে, “তাঁর চরিত্র হলো কুরআন।” (হুলুকুহুল কুরআন।) এছাড়া, যুগে যুগে মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দেয়ার জন্য অন্তত: একজন করে পথ প্রদর্শক পাঠিয়েছিলেন, মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ্ তায়ালা।(লিকুল্লে কউমীন হাদ)। সৃষ্টির আদিকাল হতে মানুষ শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার ছোঁয়া পেয়ে পেয়ে এ যুগে এসে পৌঁছেছে। এ নিবন্ধে আমরা সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে আধুনিক ও ইসলামী দৃষ্টি-ভঙ্গির আলোকে বিশ্লেষণপূর্বক একটি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরার প্রয়াস চালাব। আর এক্ষেত্রে অন-লাইনে পাওয়া বিভিন্ন উৎস এবং তথ্যের সন্নিবেশ ঘটানো হবে।
আধুনিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য কী?
সংস্কৃতি হলো; ভাষা, ধর্ম, খাদ্যভ্যাস, ব্যক্তিগত ও সামাজিক আচার-ব্যবহার, সংগীত, শিল্পকলা নির্বিশেষে কোন বিশেষ মানব গোষ্ঠীর নিকট হতে প্রাপ্ত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও জ্ঞান। আর ঐতিহ্য হলো; পূর্বসূরিদের নিকট হতে উত্তরাধিকারসূত্রে আমরা যা কিছু পেয়েছি, তা। এক কথায় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বলতে বুঝাবে; আমরা অতীত হতে যা কিছু পেয়েছি বা গ্রহণ করেছি, তাই। তবে সংস্কৃতি পাই আমরা, মানব জাতির কাছ থেকে। আর ঐতিহ্য আমরা পাই, মানব জাতি এবং প্রকৃতির কাছ থেকে সম্মিলিতরূপে। আর সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দু‘টি রূপ আছে। কতগুলো জিনিষ দৃশ্যমান বা মানব সৃষ্ট ও কতগুলো অদৃশ বা প্রকৃতি প্রদত্ত্ব। দৃশ্যমান সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহ্যের উপাদানগুলো; যেমন-ভবন, স্মৃতি স্মারক বা সৌধ, ভূ-প্রকৃতি, গ্রন্থরাজি, শিল্পকর্ম, ও স্থাপত্য; প্রভৃতি। আর অদৃশ্য উপাদানগুলো; যেমন-লোক সংগীত, সনাতনী জিনিষপত্র, ভাষা, ও জ্ঞান; প্রভৃতি। দৃশ্যমান যা কিছু আছে, তা সভ্যতার অংশ হিসেবে মানব জাতির কল্যাণার্থে সংরক্ষণ করা আবশ্যক। এর মূল উপাদান হলো; সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, বৈজ্ঞানিক আবিস্কার ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, তা ঐতিহ্য এবং সম্পদ হিসেবে মানুষের জন্য উপকারি। আর অন্যান্য উপাদানসমূহ আমাদের আত্নিক ও নান্দনিক বিকাশে অপরিহার্য। আর ইসলাম উল্লেখিত বিষয়গুলোসহ অনেক উপাদানকে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য হিসেবে গ্রহন ও নিজেকে সমৃদ্ধতর করেছে। কারণ ইসলাম ইহকাল ও পরকাল উভয় কালের বিশ্বাসকে ধারণ করে এমন একটি ধর্ম এবং ইসলাম ঐশী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকেও ধারণ করে। অন্যান্য ধর্ম বিশ্বাস ইহকাল কেন্দ্রিক ও মানব রচিত ধর্ম বিশ্বাসকে ধারণ করে থাকে।
ইসলামী সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য:
ইসলাম ধর্ম প্রচারের প্রাক্কালে আরব সমাজ ছিল; অনৈতিক, অশ্লিল, বেহায়াপনা, অনাচার, অবিচার, হানাহানি, নারী নির্যাতনসহ সকল প্রকার র্ববরতায় পূর্ণ। এ সময়কালকে ইসলামে আইয়ামে জাহেলিয়া বা অন্ধকার যুগ হিসেবে অভিহিত করা হয়। ঠিক এসময় মহানবী হযরত মুহাম্মদ (দ:)-এর আবির্ভার ঘটে। আরবদের সকল প্রকার বর্ববরতার মাঝে আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মদকে (দ:) সম্পূর্ণ সৎ, চরিত্রবান, আল-আমিন বা বিশ্বাসভাজন, সত্যান্বেষী, স্বাতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মহামানব রূপে (সাধারণ জীবন-যাপনকারি মানুষ হওয়া সত্বেও) নবুয়তের গুরু দায়িত্ব অর্পন করেন। নবুয়তের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে মহানবী (দ:) মানুষের মাঝে সুন্দর সুন্দর যুক্তিপূর্ণ ভাষা এবং বুদ্ধিমত্তা বা হেকমত দিয়ে আল্লাহর পথে মানবজাতিকে অন্ধকার হতে আলোর পথে আহবান জানাতে শুরু করেন। অনেকেই তখন তাঁকে শত্রু গণ্য করতে শুরু করে এবং তাঁকে নানা রকম প্রলোভন দেখিয়ে এবং ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে ইসলাম প্রচার হতে নিবৃত করার অপপ্রয়াস চালায়। তাই, প্রথম তিন বছর মহানবী (দ:) হযরত আবু বকর (র:), হযরত আলী (র:), প্রিয় নবীর সহধর্মীনী উম্মুল মু‘মিনীন খদিজা (র:) প্রমুখ ক্ষুদ্র একটি দল নিয়ে নিরবে-নিবৃতে, কিন্তু বুদ্ধিমত্তা ও সূক্ষাতি সূক্ষ কৌশলাদি অবলম্বন করে অন্ধকার যুগের মানুষদেরকে আলোর পথে আহবান জানান। তিনি; কখনো ব্যবসায়ি, কখনো নেতা হিসেবে, কখনো বা আত্নীয় সেজে, আবার কখনো বা সমাজ সেবক সেজে অথবা প্রভাবশালী সমাজবেত্তা আব্দুল মোতালেবের নাতীরূপে মানুষের মাঝে আল্লাহর নবী ও ধর্ম প্রচারক হিসেবে কাজ করতে থাকেন। এসময় তাঁর নানা কৌশল অবলম্বনের ফসল হিসেবে হযরত ওমর (র:)-এর মত শক্তিশালী মানুষ, হযরত ওসমানের (রহ:) মত ধনী ও ত্যাগী মানুষ, হযরত হামজার (রহ:)মত শক্তিমত্তার অধিকারী কিছু মানুষসহ আল্লাহ তায়ালার পথে জানবাজি রেখে মানুষকে ইসলামের পথে নিয়ে আসার জন্য যখন একটি শক্তিশালী টিম তৈরি হল, তখন মহানবী স্ব-মহিমায় আবর্ভুত হন। বদরের যুদ্ধ, ওহুদের যুদ্ধ, খন্দকের যুদ্ধের মত বড় বড় সামরিক শক্তি-সামর্থ্য প্রয়োগ করে ও আল্লাহ তায়ালার সরাসরি সহায়তায় মানুষ দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করতে শুরু করে। মহানবী (র:), ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়ে পবিত্র ওফাত বরণ করেন। কিন্তু তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি সাহাবীগণ (খোলাফায়ে রাশেদীন) ইসলামের বিজয়-কেতন সমুন্নত রাখেন অনেক দিন। মহানবীর উম্মতগণ সেই ধারা অক্ষুন্ন রাখতে গিয়ে কিছুটা আদর্শ-বিশ্বাস হতে বিচ্যুত হলেও, এখনো ইসলামী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধরে রেখে তা যুগ যুগান্তর সমৃদ্ধ করে চলেছেন। বিশেষত: মধ্যযুগের প্রথমার্ধে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি, সমর নীতি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে আধুনিক সভ্যতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ইসলাম ও মুসলমানরা অনন্য অবদান রেখে গেছেন। যাহোক, আমরা এখানে ইসলামী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে আলোকপাত করছি। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (দ:) আল্লাহ্ তায়ালা প্রদত্ত্ব উত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, কুরানিক শক্তি এবং যোগ্য সঙ্গী-সাথীদের দিয়ে সন্মুখ সমরে নেতৃত্ব দিয়ে আরব জাতিকে অন্ধকার হতে পুরোপুরি আলোর পথে নিয়ে আসতে সক্ষম হন। সে সুবাধে আরব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে যথাযথ মার্জিত এবং খোদায়ী রংয়ে রঙ্গিন করে তোলেন, তিনি। যত সব কুসংস্কার, কূপমন্ডকতা, অপসংস্কৃতি, ওকাজ শহরের কবি-সাহিত্যিকদের অশ্লিলতা-বেহায়পনা মেলার অবসান ঘটে। শুরু হয়, বিশুদ্ধ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও সভ্যতার চর্চা। আর সংরক্ষণ ও সংস্কার সাধন করা হয় কাবা ঘরসহ অতীত সব ঐতিহ্য। আর আরব সমাজের যেসব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগত উপাদান ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক নয়, এমন সব জিনিষ ইসলামের নিজস্ব সম্পদে রূপান্তরিত হয়। মহানবীর (দ:) জীবদ্দশায় এবং তৎপরবর্তী ২৩০/২৪০ বছর অন্তত: ইসলামী শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য পৃথিবীর অর্ধেক দেশে দাপটের সাথে বিস্তার লাভ করেছে। পাশপাশি, অন্যদের ভাল দিকগুলোও ইসলাম নিজের মধ্যে ধারণ করে নিয়েছে। ইসলামী খেলাফতে মঙ্গোলীয় এবং ইউরোপীয় শাসক গোষ্ঠী তাদের আধিপত্য ও সাম্রাজ্য বিস্তার এবং ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠাকল্পে পৃথিবীব্যাপী প্রভাব-বলয় গড়ে তুলে। সে সাথে তারা ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও বিকাশের ক্ষেত্রে নগ্নভাবে হস্তক্ষেপ করে। স্পেন, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং এশীয় দেশগুলোতে মুসলমানদের মাঝে কিছু বশংবদ রাজা-বাদশা, আমির-ওমরাহ, খলিফা তৈরি করে ইসলামকে বিতর্কিত করার প্রয়াস চালায়। কিন্তু তারা যতই চেষ্টা করুক না কেন, ইসলাম, কুরআন, সুন্নাহ, শরিয়াহ প্রভৃতির রক্ষক, সংরক্ষক এবং এর প্রসার-প্রচার ঘটানোর দায়িত্ব স্বয়ং মহাশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালার নিজের হাতে রেখে দিয়েছেন। তাই, এর ক্ষতি তো তারা করতে পারে নি, বরং ইসলাম তাদের ভাল দিকগুলো গ্রহণ করে নিয়ে আজ বিশ্ব্ সভ্যতায় স্ব-মহিমায় প্রতিষ্ঠিত। যাহোক, প্রাশ্চাত্য শক্তিগুলো, ইসলামী সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বর্তমানে পূণরায় ধ্বংস করার জন্য ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করছে। ইরাক, মিশর, সিরিয়া, তিউনিশিয়া, লিবিয়াসহ মুসলিম ঐতিহ্যবাহী দেশগুলোকে তছনছ করে দিয়েছে তারা, ইতোমধ্যে। সম্প্রতি কাতারকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে রুশ-মার্কিন দুই শক্তিই দু‘দিকে টানাটানি করছে। হয়ত মুসলমানরা অনেক বেশি পাপাচার ও ভুলভ্রান্তি করেছে, বিধায় আল্লাহ্ তায়ালা এসব দেশের শাসক গোষ্ঠীকে কিছুটা শিক্ষা দেয়ার জন্য এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে দিয়েছেন। কিন্তু আল্লাহর নবীর (দ:) পদ-ধুলি পড়েছে, এমন দেশগুলোতে দুনিয়ার কোন শক্তি ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে তাদেরকে নি:শেষ করতে পারবে না। এসব দেশে বরং আল্লামা ইকবাল-এর সেই বিশ্ব বিখ্যাত উক্তিরই প্রতিফলন ঘটবে। তিনি বলেন, ‘ইসলাম কারবালার মত প্রত্যেক বিধ্বংসী ঘটনার পর নতুন করে পূণরুজ্জীবিত হয়ে থাকে।(ইসলাম জিন্দাহ হোতা হেয়, হার কারবালাকে বা‘দ)। যাহোক, ইরাক, মিশর, সিরিয়াকে কেন্দ্র করে এ পর্যন্ত অনেকবার উত্থান-পতনের ঘটনা ঘটেছে। তারা পূনরায় সে ধ্বংসস্তুপের নীচ হতে ওপরে উঠে এসেছে এবং সভ্যতাকে বিনির্মাণ করে গেছে। ইসলামী সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য বিষয়ে ২০০১ সালের ৩০-৩১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত কাতারের রাজধানী দোহায় আলেম-ওলেমাগণ, এক সম্মেলনে মিলিত হয়েছিলেন। আরব লীগ এবং মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক একটি শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংগঠন-ারে সহযোগিতায় ইউনেস্কো এ সম্মেলনে উপস্থাপিত ইসলামী পন্ডিতগণের প্রবন্ধসমূহ ২০০৫ সালে প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করে। এ সম্মেলনে বিদগ্ধ ইসলামী ব্যাক্ত্ত্বিগণ আধুনিক ও ইসলামী সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যসমূহ তুলনামূলকভাবে গভীরভাবে আলোচনা-পর্যালোচনা করেন। সম্মেলন শেষে তাঁরা সংক্ষিপ্ত একটি সম্মিলিত বিবৃতি দেন। সেই বিবৃতিটি ইসলামী সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের অনন্য স্মারক। তা এখানে তুলে ধরছি।
১. ইসলাম অন্যদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে স্বীকৃতি দেয়। ‘গ্রীক ও বর্বর’ এবং ‘রোমান ও বর্বর’; এভাবে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে তা বিভক্ত করা হয় না। এক্ষেত্রে পবিত্র কুরআনের সূরা কাফিরুনের নিন্মোক্ত ৬ নং আয়াতটি লক্ষ্য করা যেতে পারে;
“তোমাদের ধর্ম তোমাদের, আমার ধর্ম আমার”।
আর মদীনা সনদে উল্লেখিত এ সংক্রান্ত বক্তব্যটিও এখানে বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে;
“ইহুদীদের জন্য তাদের ধর্ম। আর মুসলমানগণ তাদের ধর্ম মেনে চলবে।”
২. পবিত্র কুরআনের নিন্মোক্ত আয়াতগুলোকে সভ্যতার সহাবস্থানের স্ব-পক্ষে সমার্থক হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
“তোমরা আল্লাহ তায়ালাকে ভয় কর ও তাঁর প্রতি তোমাদের কর্তব্য পালনে (প্রার্থনা আদায়) যত্নশীল হও এবং সত্য কথা বলো।” (সূরা আহজাব, আয়াত নং-৭০)
“আমার বান্দাদেরকে যা উত্তম তাই বলতে বলো। নিশ্চয়ই শয়তান তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উস্কানি দেয়। শয়তান তো মানুষের প্রকাশ্য শত্রু।” (সূরা বনি ইসরাইল; আয়াত নং ৫৩)
“তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহবান করো বুদ্ধি দিয়ে এবং সদুপদেশ দিয়ে ও তাদের সাথে যুক্তি-তর্ক করবে উত্তম পন্থায়।” (সূরা নাহাল; আয়াত নং-১৫৩)
“তোমরা আহলে কিতাবের অনুসারিদের সাথে বিনয়ের সাথে তর্ক-বিতর্ক করবে, তবে তারা সীমালংঘন করলে, তাদের ছাড় দেয়া যাবে না।” (সূরা আন-কাবুত; আয়াত নং-৪৬)
“হে নবী বল, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী হতে কে তোমাদেরকে রিযিক প্রদান করেন? বল, আল্লাহ্। হয় আমরা না হয় তোমরা সৎ পথে স্থিত আছ অথবা বিভ্রান্তিতে পতিত।” সূরা সাবা; আয়াত নং-২৪)
৩. যেসব বিষয় সকল ধর্মে গ্রহনযোগ্য এবং ভাল তা ইসলামও মেনে নেয়। পবিত্র কুরআনের নিন্মোক্ত আয়াতসমূহে আমরা তাই দেখতে পাই;
“ এসো সে কথায় যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে এক।” (সূরা আল-ইমরান; াায়াত নং-৬৪)
“আমাদের প্রতি ও তোমাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে আমরা বিশ্বাস করি এবং আমাদের ও তোমাদের প্রভু এক “ (সূরা আন-কাবুত; আয়াত নং-৪৬)
“আল্লাহ আমাদের প্রতিপালক ও তোমাদেরও প্রতিপালক। আমাদের কর্ম আমাদের এবং তোমাদের কর্ম তোমাদের; আমাদের ও তোমাদের মধ্যে বিবাদ-বিসম্বাদ নেই। ”(সূরা শূরা; আয়াত নং-১৫)
৪. একের বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে অপরের জন্য উন্মুক্ত রাখা সংক্রান্ত পবিত্র কুরআনের আয়াতসমূহ আমরা দেখতে পারি:
“ হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সে ব্যাক্তিই বেশি মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে অধিক খোদাভীরু।” (সূরা হুজরাত; আয়াত নং-১৩)
“যারা তাগুতের পূজা হতে দূরে থাকে এবং আল্লাহ্ অভিমুখি হয়, তাদের জন্য আছে সুসংবাদ। অতএব সুসংবাদ দাও আমার বান্দাদেরকে যারা মনোযোগ সহকারে কথা শুনে এবং তার মধ্যে যা উত্তম তা গ্রহণ করে। এদেরকে আল্লাহ সৎ পথে পরিচালিত করেন এবং তারাই বোধশক্তিসম্পন্ন।” (সূরা জুমার; আয়াত নং-১৭ ও ১৮)
“তোমাদের নিকট কোন যুক্তি আছে কী, থাকলে আমার নিকট তা পেশ করো।”
পবিত্র হাদীস শরীফে মহানবী (দ:) বলেন, বিশ্বাসীদের বা মু‘মিনদের জন্য উপদেশ হলো; “তোমরা ভাল কিছু যেখানেই পাও, তাই গ্রহণ করো।” (তিরমিজী ও ইবনে মাজা)
৫. ‘অন্যকে স্বীকার করে নেয়া মানে মতভিন্নতাকে গ্রহণ করে নেয়া্’ এ ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআনের নিন্মোক্ত বাণীগুলো স্মরনীয়;
“তারা মতভেদ করতেই থাকত।” (সূরা হুদ; আয়াত নং-১৮)
“তিনি তাদেরকে এজন্য সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা হুদ; আয়াত নং-১৯)
“ইচ্ছা করলে আল্লাহ্ তোমাদেরকে এক জাতি করতে পারতেন।” সূরা মায়িদা; আয়াত নং-৪৮)
“তোমার প্রতিপালক চাইলে সমস্ত মানুষকে এক জাতিতে পরিণত করতে পারতেন।’’ (সূরা হুদ; আয়াত নং-১৮)
“তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করলে পৃথিবীতে যারা আছে তারা সকলেই অবশ্যই ঈমান আনত; তবে কী তুমি মু‘মিন হবার জন্য মানুষের উপর জোর জবদস্তি করবে?” (সূরা ইউনুস; আয়াত নং-৯৯)
৬. ইসলামের দৃষ্টিতে অন্য জাতির সংস্কৃতি-ঐতিহ্যে ধর্মীয় মূল্য আছে, বক্তব্যটির সমর্থনে আমরা কুরআন শরীফের এ আয়াতগুলোর দৃষ্টি দিতে পারি;
“তোমাদের পূর্বে বহু বিধি-বিধান গত হয়েছে, সুতরাং তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করো এবং দেখো মিথ্যাশ্রয়ীদের কী পরিণাম বরণ করতে হয়েছে?” সূরা আল-ইমরান; আয়াত নং-১৪৭)
“পূর্বে যারা অতীত হয়ে গেছে তাদের ব্যাপারে এটাই ছিল আল্লাহর রীতি।” (সূরা আহজাব; আয়াত নং-৬২)
“তারা কী পৃথিবী ভ্রমণ করে না? তা হলে দেখত যে, তাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কিরূপ হয়েছিল? শক্তিতে তারা ছিল এদের অপেক্ষা প্রবল, তারা জমি চাষ করত, তারা তা আবাদ করত, এদের আবাদ করা অপেক্ষা অধিক। তাদের নিকট এসেছিল তাদের রাসূরগণ সুস্পষ্ট নিদর্শনসহ; বস্তুত আল্লাহ এমন নন যে, তাদের প্রতি জুলুম করেন, তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি জুলুম কছিল্।” সূরা রুম; আয়াত নং-৯)
“আমি ধ্বংস করেছি কত জনপদ যেগুলির বাসিন্দা ছিল অত্যাচারি। এসব জনপদ তাদের ঘরের ছাদসহ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল এবং কত কূপ পরিত্যাক্ত হয়েছিল ও কত সুদৃঢ় প্রাসাদও। তারা কী দেশ ভ্রমণ করে নি? তা হলে তারা জ্ঞানবৃদ্ধিসম্পন্ন হৃদয় ও শ্রুতিশক্তিসম্পন্ন শ্রবণের অধিকারি হতে পারত। বস্তুত চক্ষু তো অন্ধ নয়, বরং অন্ধ হচ্ছে বক্ষস্থিত হৃদয়।” (সূরা আল-হজ্ব; আয়াত নং-৪৫ ও ৪৬)
“বল, তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করো এবং অনুধাবন করে, কীভাবে তিনি সৃষ্টি আরম্ভ করেছেন। অত:পর আল্লাহ্ সৃষ্টি করেছেন, পরবর্তী সৃষ্টি। আল্লাহ তো সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।” (সূরা আন-কাবুত; আয়াত নং-২০)
উপসংহার: উপরে ইসলামী সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে আধুনকি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রেক্ষাপটে তুলে ধরা হয়েছে। ইসলামের মূল উৎস পবিত্র কুরআন শরীফ। আর আধুনিকতার মূল উৎস ইজাগতিকতা। জাতি. ধর্ম, বর্ণ, বংশ, গোত্র, মানব সমাজ, প্রকৃতি, মানব নির্মীত শিল্পকর্ম ও স্থাপত্য, বিধানবলী, আচার-আচরণ, পোষাক-আশাক, ভাষা চর্চা, সংগীত চর্চা, শারিরীক বিভিন্ন ক্রিড়া-কর্ম, রাষ্ট্র ব্যবস্থা; প্রভৃতি ইহজাগতিক উপাদান নির্ভর যা কিছু তাই আধুনিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। আর ইসলাম এসব উপাদানকে অস্বীকার করে না। তা বরং পুরোপুরি ইসলাম নিজের করে নিয়েছে। তবে কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক এবং খোদভীরু মানুষদের অনুসরণীয় ও মেনে চলা রীতি-নীতি এবং উত্তারাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত উপাদানগুলোকেই শুধু ইসলাম গ্রহণ করে। আর যা কিছু বস্তুবাদীতায় আচ্ছন্ন এবং অশোভন-অশ্লিল, অনৈসলামিক বা কুরআন-সুন্নাহ পরিপন্থী তা ইসলাম গ্রহণ করে না। আবার আধুনিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ইসলাম ধর্ম এবং মুসলামানদের অনুসরণীয় এবং অনুকরণীয়, এমন অনেক কিছু আধুনিকতা অস্বীকার করে। মূলত: ইসলামী ও আধুনিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য পরস্পরের পুরিপুরক, সাংঘর্ষিক নয়।

মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ্
সহকারি উপজেলা শিক্ষা অফিসার
মহেশখালী, কক্সবাজার।