দিব্যেন্দু দ্বীপ :
ফরহাদ মজহার কি সেরকম কেউ যাঁর “হলে ভালো হয়” টাইপের সামান্য প্রয়োজনীয় কোনো ওষুধ কেনার জন্য ভোর পাঁচটায় নিজেই বের হতে হয়? এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?

বাদ দিলাম ফরহাদ মজাহারের মত একজন বয়স্ক বিখ্যাত মানুষের কথা, আপনার আমার মত অখ্যাত কোনো লোকও কি ভোর পাঁচটায় “অপ্রয়োজনীয়” এরকম কোনো ওষুধ কিনতে বাইরে বের হবে? এত ভোরে তো আমরা বাস কাউন্টারও ত্যাগ করতে চাই না ঢাকা শহরের বাস্তবতা মেনে।

গভীর রাতে দরকার হলেও ওনার ওষুধ কিনে এনে দেয়ার মত কোনো লোক বাসায় নেই -এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? বা উনি ফোন করলে প্রয়োজনে ওনার জন্য ওষুধের কার্টন পৌঁছাবে না, তাও কি বিশ্বাস করা যায়? ভোর পাঁচটায় কি ঢাকা শহরে ওষুধের দোকান খুব একটা খোলা থাকে? ঢাকা শহরে এ সময় কয়টা ওষুধের দোকান খোলা থাকে খুব ব্যস্ত হাসপাতাল এলাকা না হলে?

পৃথিবীতে নাস্তিক (নির্দিষ্ট কোনো ধর্মে অবিশ্বাস যদি নাস্তিকতা হয়, তাহলে সম্ভবত নাস্তিক আছে বর্তমান পৃথিবীতে ঘরে ঘরে) বলে কিছু নেই মনে করি, ধর্ম বিশ্বাস না থাকলেও কোথাও না কোথাও সমর্পণ মানুষের থাকেই। তাই আস্তিক-নাস্তিক নিয়ে কোনো কথা নয়। অর্থাৎ, ফরহাদ মজহার নাস্তিক বা আস্তিক -এ ধরনের কোনো কথা বলতে চাই না। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই একজন সুস্থ মানুষ, মানবিক মানুষ, ভালো মানুষ কি সাম্প্রদায়িকতা এবং জঙ্গিবাদের পক্ষ নিতে পারে?

মার্কসবাদের সাথে ধর্ম মিলিয়ে রাজনীতি করলে তাতে ধর্ম বাঁচে, নাকি মার্কসবাদ বাঁচে, নাকি উভয়ই মরে? উনি এই কাজটা করে দেশকে ঠিক কোন তরিকায় নিতে চেয়েছেন? একটা আদর্শের দিশা তো খুঁজতে হবে ওনার মত বিদগ্ধ মানুষের কাজের মাঝে। কোনো রূপরেখা তো তাঁর কাজে খুঁজে পাওয়া যায় না মানুষের জন্যে, যায় কি?

বাট্রান্ড রাসেলের মতে, কোনো আদর্শের পক্ষ না নেয়াটাই অনেক বড় আদর্শ, কিন্তু উনি তো তা করেননি, উনি সুস্পষ্টভাবে পক্ষ নিয়েছেন। কোন পক্ষ নিয়েছেন, আলোর পক্ষ, নাকি অন্ধকারের পক্ষ? সভ্যতা এবং অগ্রগতির প্রশ্নে আলো-অন্ধকারের বাইরে আর কোনো পক্ষ আছে কি? গড় ভালো-মন্দ হিসেবে, পাল্লার ডানে বামে তাকিয়ে আমাদের একটা পক্ষ বেছে নিতে হয়, কিছু ভালো কিছু মন্দ বিবেচনায় নিয়ে পক্ষ নেয়াটা কি একজন বিদগ্ধ মানুষের কাজ হতে পারে?

উনি কি কোনোদিন দেখতে গিয়েছেন, বা জেনেছেন, বা এ বিষয়ে কোনো কথা বলেছেন যে মাদ্রসায় কারা পড়ে, তারা কী পড়ে, কী খায়, কীভাবে থাকে, পড়াশুনা শেষে তাদের অধিকাংশের কী হয়? তাহলে মাদ্রসার ছাত্রদের নিয়ে যারা রাজনীতি করছে তাদের পক্ষ নিলে কীভাবে নিপীড়িত মানুষের পক্ষ নেয়া হয়? প্রশ্নটা আসছে, কারণ, বিবিসি বাংলায় দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, বাম-ডান নয়, তিনি শুধু নিপীড়িত মানুষের পক্ষে।

দেশের একজন নাগরিক হিসেবে জানা দরকার, উনি আসলে কী চান? যদি সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর দিতে না পারেন, তাহলে বলব, দয়া করে উস্কানি দেয়া বন্ধ করেন, বাংলাদেশের “সহজ-সরল-অশিক্ষিত” মানুষ আপনাদের বিশ্বাস করে, তাই আপনাদের মত মানুষের কথায় তারা লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে দিতে পারে। তাই ভেবেচিন্তে কথা বলবেন একটু।

যে সকল “বাম-প্রগতিশীল” জনাব মজহারের পক্ষ নিচ্ছেন, নিয়ে থাকেন (অপহরণ বিষয়ে বলছি না) তারা কি এ কারণে পক্ষ নেন যে তিনি মার্কসবাদী, নাকি আপনাদের প্রতি ওনার অকুণ্ঠ সমর্থন আছে বলে? নাকি “ইসলামীক বাম রাজনীতি” নামক কোনো তত্ত্ব তিনি আপনাদের মত অনেক মানুষের মধ্যে ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছেন?

বাম রাজনীতির ফলাফল হিসেবে বিপ্লবের সম্ভাবনা বা বাস্তবতা বা প্রয়োজনীয়তা আর আছে কিনা সেটি ভিন্ন আলোচনা, কিন্তু বিশ্ব পুঁজিবাদ বাম রাজনীতিকে ভয় পায় এখনো, সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, আছে কি?

একথা কি ভাবার সুযোগ একেবারেই নেই যে জনাব মজহার আসলে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী চক্রেরই একজন লোক, যাঁর দায়িত্ব ছিল- বাংলাদেশে বাম রাজনীতির সমূহ সম্ভাবনা নস্যাৎ করার জন্য মার্কসবাদী রাজনীতির সাথে ধর্ম মিশিয়ে একটি তত্ত্ব দাঁড় করানো, যাতে বামধারার রাজনীতির মূল দর্শনটা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিই দিনশেষে লাভবান হয়? আর একথা খুবই প্রতিষ্ঠিত যে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সাথে পুঁজিবাদের কোনো বিরোধ তো নেইই বরং সম্পর্ক তাদের লাইলী-মজনুর মত।

কয়েকটি নাম এক ঝটকায় বলা যায়, যাঁদের সুস্পষ্টভাবে ফরহাদ মজহারের উত্তরসুরী হিসেবে চিহ্নিত করা চলে, তা তাদের ভাবশিষ্য বা লাভশিষ্য যেভাবেই বলি না কেন। ফলে ব্যক্তি ফরহাদ মজহার কোনো বিষয় নয়, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, তিনি বাংলাদেশের সমাজ এবং রাজনীতির যে ক্ষতিটা তাত্ত্বিকভাবে করেছেন তা কি কোনোভাবে তাকে অপহরণ করে শোধরানো যাবে? আবার তাকে অপহরণ করার মত কাণ্ডজ্ঞানহীন কি বর্তমান সরকার, বা সরকারের ঘনিষ্ট কোনো মহল, যে সরকার জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে ভীষণ জটিল পরিস্থতি মোকাবেলা করে বর্তমানে টিকে আছে বলে মনে হয়?

শেষ প্রশ্ন- তাত্ত্বিকভাবে তাঁর (তাদের) উদ্দেশ্যটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার কাজটি কে বা কারা করবে এদেশে, চমৎকারভাবে তা কেউ করছে কি? ন্যারেটিভ-পাল্টা ন্যারেটিভের মধ্য দিয়ে, আরেকটু বৈজ্ঞানিকভাবে বললে, থিসিস-এন্টি থিসিসের মধ্য দিয়ে একটি সমাজের প্রত্যাশিত অগ্রগতি হয়, তাই জনাব ফরহাদ মজহারকে গালি দেয়ার প্রয়োজন নেই, অপহরণ করার তো প্রশ্নই আসে না, দরকার তাঁকে তাত্ত্বিকভাবে মোকাবেলা করা। তবে তিনি যদি গণমাধ্যমে এসে সমাজে দাঙ্গা বাধানোর মত কোনো কথা বলেন, তাহলে তাকে আইনানুগভাবে থামানো বা তাঁর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয় কি?

উল্লেখ্য, ফরহাদ মজহার ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্মেসি বিষয়ে পড়াশুনা শেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। সেখানে (নিউইয়র্কে) কাজকর্মের পাশাপাশি রাজনৈতিক অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশুনা করেন। এরপর দেশে ফিরে ১৯৮৭ সালে ‘উবিনিগ’ নামক এনজিও প্রতিষ্ঠা করেন। পাশাপাশি প্রবর্তনা নামে পোশাকের শো রুমও করেন। ষাটের দশকের কবি হিসেবে যেমন তাঁর খ্যাতি রয়েছে, পাশাপাশি বর্তমানে তিনি উগ্রবাদী রাজনীতির সাথে তাত্ত্বিকভাবে জড়িত থাকার অভিযোগেও সমালোচিত।

লেখক
প্রাক্তন শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ব্যাংকার (রিজাইনড)
বর্তমানে তিনি Q&C Research ফার্মের প্রধান নির্বাহী