“আরবে দেখেছি জীবন্ত ইসলামকে”(খন্ড-১১)
মহসীন শেখ॥
বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ(স.) এর রওজা মোবারক জিয়ারত এবং সালাম আদায় করতে যাওয়ার সুবাধে দেখা হয়েছে মদিনার বিভিন্ন গুরুপূর্ণ ইসলামের নিদর্শন। সুবাহানাল্লাহ। পবিত্র মদিনা শহরের ঠিক উত্তর-পূর্ব দিকে ঐতিহাসিক ওহুদ পাহাড় অবস্থিত। মসজিদে নববি হতে এর দূরত্ব মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। এই ওহুদ প্রান্তরেই বিধর্মীরা নির্মমভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দন্ত মোবারক শহীদ করে। এই রণক্ষেত্রে নবীজির চাচা মহাবীর হজরত হামজা (রা.) এবং হজরত আকিল ইবনে উমাইয়া (রা.)সহ সত্তরজন সাহাবা শহীদ হয়েছিলেন। পবিত্র মদিনা যাত্রার সুযোগে দেখেছি ইসলামের মহান সেবক ও সৈনিক হযরত হজরত আমির হামজা (রা.) ও হজরত আকিল (রা.)কে একই কবরে দাফন করা হয়। এখানে একটি মসজিদ আছে। সেখানে নিয়ামানুযায়ী হযরত আমির হামজা(র.) সহ সকল শহীদানদের মাজার জিয়ারত করেছি।
মদিনা মুসলমানদের প্রাণের ভূমি। মদিনা হলো নবীজি (সা.)-এর শহর; শান্তির নগর। সেখানে রয়েছে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বহু নিদর্শণ রাসুলে কারিম (সা.) বলেন, যে আমার রওজা জিয়ারত করল, তার জন্য আমার শাফায়াত ওয়াজিব হয়ে গেল। (সহিহ মুসলিম)। তিনি আরও বলেন, যে হজ করল কিন্তু আমার রওজা জিয়ারত করল না; সে আমার প্রতি জুলুম করল। (তিরমিজি) ফকিহগণের মতে, হাজির জন্য মদিনা শরিফ জিয়ারত করা সুন্নত।
পবিত্র মদিনায় প্রতিটি মুসলমান নর-নারীকে অন্তত একবার সফর করা প্রয়োজন বলে মনে করছি। গত ২১ মে মদিনায় ঐতিহাসিক বিভিন্ন স্থান দর্শনের পাশাপাশি স্ব-স্ত্রীক জিয়ারত করেছি হযরত মুহাম্মদ(স.) এর চাচা এবং ইসলামের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হযরত আমির হামজা(রা.) পবিত্র কবর। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ কবরটি জিয়ারত করতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা লাখ লাখ মুসলমান নর নারীর সমাগম ঘটে প্রতিদিনই। অন্যান্যদের মতো আমরা যথাযত শ্রদ্ধার সাথে মহান সৈনিকের কবরটি দেখেছি এবং জিয়ারত করেছি। কবরের একপাশে উহুদ ও অন্য পাশে রয়েছে রোমা পাহাড়। প্রচন্ড গরম উপেক্ষা করে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি পাহাড় দেখার পাশাপাশি ইসলামের মহান সেবকের কবর জিয়ারত করছেন মুসলিমরা।
সূত্রমতে, ইসলাম-পূর্ব যুগে মদিনার নাম ছিল ইয়াস্রিব। রাসুলে কারিম(সা.)-এর হিজরতের পর এই শহরের নাম হয় মদিনাতুন্নবী বা নবীর শহর। সংক্ষেপে এখন বলা হয় মদিনা। মদিনা শরিফ রাসুলুল্লাহ(সা.)-এর আশ্রয়ভূমি; প্রেম, ধৈর্য ও আতœত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তস্থান এবং সত্যনিষ্ঠা ও কর্তব্যপরায়ণতার অদ্বিতীয় কর্মক্ষেত্র। মদিনাবাসীর ব্যবহার অতি মধুর, তাঁদের বাক্যালাপ অতি মিষ্ট এবং তাঁদের সঙ্গ অতি পবিত্র। সর্বদা সতর্ক থাকবেন যেন মদিনা শরিফে কোনোরূপ বেয়াদবি না হয়। মদিনাবাসীকে সব সময় ইজ্জত ও সম্মান প্রদর্শন করবেন।
বেশ কয়েক বছর আগে (ঘটনার সাল তারিখ আমার জানা নেই) বন্যার পানিতে তার কবর খুলে গিয়েছিল। সেখানে সৌদি সরকার তাদের লাশকে দাফন করার জন্য বড় বড় কিছু আলেমকে দাওয়াত করেছিলেন দাফন অনুষ্ঠানে। উক্ত আলেমদের মধ্যে একজন দাওয়াত পেয়েছিলেন তার নাম “মাহমুদ আস সাওয়াফ”। তিনি এগুলো অন্যদের কাছে বর্ণনা করেছিলেন যে, আমরা যাদেরকে দাফন করেছি তাদের মধ্যে ছিল হযরত হামজাহ (রাঃ)এর লাশ। তার শরীর ছিল ক্ষত-বিক্ষত; নাক ও কান ছিল কর্তিত। পেট ছিল চেরা। তার একটি হাত ছিল পেটের উপর।
তিনি বলেন: আমরা যখন তার হাত নাড়াচাড়া করলাম দেখলাম যে, ক্ষতস্থান থেকে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। আর রক্ত প্রবাহিত হওয়ার সময় তার থেকে সুগন্ধি ছড়িয়ে পড়ছিল। এ ঘটনাটি অত্যধিক প্রসিদ্ধ একটা ঘটনা।
এ ঘটনা আল্লাহ তায়ালার সেই বাণীর সত্যায়ন করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন:-
وَلاَ تَقُولُواْ لِمَنْ يُقْتَلُ فِي سَبيلِ اللّهِ أَمْوَاتٌ بَلْ أَحْيَاء وَلَكِن لاَّ تَشْعُرُون। অর্থাৎ, আল্লাহর রাস্তায় যারা শহীদ হয় তাদেরকে তোমরা মৃত বলিওনা; বরং, তারা জীবিত। অথচ, তোমরা তা উপলব্ধি করতে পার না। (সুরা আল বাকারা: ১৫৪)
আবু জাহেল ছিল ইসলাম ও বিশ্বনবী(সা.)’র ঘোর শত্রু। একদিন সে মহানবী (সা.)কে মারাতœক ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ করে ও হয়রানি করে। সেদিনি রাসূল (সা.)’র চাচা হযরত হামজা (রা.) ওই ঘটনার কথা শুনতে পান। সাহসিকতার জন্য খ্যাত বীর হামজা এ ঘটনার শাস্তি হিসেবে সবার সামনে আবু জাহেলকে অপদস্ত করেন। বংশগত বা গোত্রীয় দাপট থাকা সত্ত্বেও আবু জাহেল এ ব্যাপারে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে সক্ষম হয়নি। হযরত হামজা তখন পর্যন্ত ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেননি। অবশ্য তিনি সব সময়ই ভাতিজার প্রচারিত ধর্ম নিয়ে ভাবতেন। এ ঘটনার পর তিনি মহানবী (সা.)’র কাছে যান ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। সেই থেকে জীবনের শেষ পর্যন্ত তথা ওহুদ যুদ্ধে শাহাদত লাভের আগ পর্যন্ত হযরত হামজা (রা.) ছিলেন ইসলামের এক মহান ও অক্লান্ত সেবক এবং সৈনিক। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই নাজিল হয়েছিল সুরা আনআমের ১২২ নম্বর আয়াত। এ আয়াতে এমন এক ব্যক্তির দিকে ইশারা করা হয়েছে যার অন্তর ঈমানের আলোতে প্রোজ্জ্বোল। আর তাঁর বিপরীত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হিসেবে আবুজাহলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে যে কুফর ও বিভ্রান্তির অতল-অন্ধকারে ডুবে আছে। এই আয়াতে বলা হয়েছে:
“আর যে মৃত ছিল এরপর আমি তাকে জীবিত করেছি এবং তাকে এমন একটি আলো দিয়েছি, যা নিয়ে সে মানুষের মধ্যে চলাফেরা করে। সে কি ঐ ব্যক্তির সমতুল্য হতে পারে, যে অন্ধকারে রয়েছে-সেখান থেকে বের হতে পারছে না? এমনিভাবে কাফেরদের দৃষ্টিতে তাদের নোংরা কাজকর্মকে সুশোভিত করে দেয়া হয়েছে।”
কুরআন কুফরকে মৃত্যু এবং সত্য ও ঈমানকে জীবনের সঙ্গে তুলনা করেছে। এর অর্থ যে ঈমান আনে সে আসলে আল্লাহর অনুগ্রহে মৃত অবস্থা থেকে জীবিত হল। অন্য কথায় কুরআনের দৃষ্টিতে ঈমান কেবলই শুস্ক ও অগভীর কোনো বিশ্বাস নয়, বরং আতœ বা জীবনের মত কোনো বিষয় যা ঈমানহীন কোনো ব্যক্তির মধ্যে ফুঁকে দেয়া হলে সেই ব্যক্তি প্রকৃত জীবনের অধিকারী হয়।
সুরা আনআমের বিশেষ আয়াত সৃষ্টিকূলের মধ্যে মহান আল্লাহর হেকমাত ও প্রাজ্ঞতা তুলে ধরে। এ ধরনের আয়াত কখনও মহান আল্লাহর বিশেষ কিছু গুণের কথা বলে এবং নানা বিষয় বা সৃষ্টি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর নজিরবিহীন ক্ষমতার কথাও তুলে ধরে। এর সুরার ৫৯ নম্বর আয়াতে মহান প্রভু বলছেন, “কেবল তাঁর কাছেই অদৃশ্য জগতের চাবি রয়েছে। এগুলো তিনি ছাড়া কেউ জানে না। স্থলে ও পানিতে যা আছে, তিনিই জানেন। তাঁর অজান্তে গাছের কোন পাতাও ঝরে না। কোন শস্য কণা মৃত্তিকার অন্ধকার অংশে পড়ে না এবং এমন কোন আর্দ্র ও শুকনো জিনিসের অস্তিত্ব নেই যার সবই তাঁর প্রকাশ্য গ্রন্থে বা জ্ঞানের আওতায় রেকর্ড হয়নি।”
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা যায় মহান আল্লাহ শত-সহস্র কোটি জীবনের নড়াচড়া, সমস্ত গাছের পাতার কাঁপন, ফুলে কলি ফুটে ওঠার সময়, মরুতে, সমতলে ও পাহাড়ে বায়ু প্রবাহের বিষয়ে এবং প্রত্যেক মানুষের কোষের সংখ্যা ও রক্তে গন্ডকাজের মাত্রার নিখুঁত তথ্য জানেন। শরতের দমকা হাওয়ায় কখন গাছের কয়টি পাতা ঝরে পড়বে তাও তিনি জানেন। মহান আল্লাহর অশেষ ও পরিপূর্ণ জ্ঞানের এ এক অতি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। পবিত্র কুরআনে সুরা আনআমের ৯৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন: “নিশ্চয় আল্লাহই বীজ ও আঁটি থেকে অঙ্কুর সৃষ্টিকারী; তিনি জীবিতকে মৃত থেকে বের করেন ও মৃতকে জীবিত থেকে বের করেন। তিনিই বা এই হলেন তোমাদের প্রভু বা আল্লাহ, তবুও তোমরা সত্য থেকে কিভাবে বিভ্রান্ত হচ্ছ?”
একবার হযরত মুসা (আ.) আল্লাহর কাছে নিবেদন করেন, হে আল্লাহ! আমাকে তোমার ধনাগার বা ধন-স¤পদের গুদাম দেখিয়ে দাও! মুসাকে জানিয়ে দেয়া হলো যে, “হে মুসা! আমার ধনাগার হলো এটা যে, যে জিনিসকে বলবো হয়ে যাও, তা তৎক্ষণাৎই হয়ে যায়।”
মহানবী (সা.) বলেছেন, ” যখন তোমরা কেউ দেখ যে, কেউ অন্যায়, অবিচার ও পাপাচার করে চলেছে অথচ আল্লাহ তাকে অঢেল নিয়ামত দান করেছেন, তখন বুঝে নিও যে আল্লাহ তার রশিটা বেশি লম্বা বা দীর্ঘ করে দিয়েছেন, আর আল্লাহ এক টানেই এদের গুটিয়ে ফেলবেন।”
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক সকালের কক্সবাজার। মোবাইল:- ০১৬১৯০৭০৫১৩
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।