কমছে মূল্যবোধ, বাড়ছে হত্যাকান্ড

প্রকাশ: ১১ জুলাই, ২০১৭ ১১:৫১ , আপডেট: ১২ জুলাই, ২০১৭ ০৮:৩৪

পড়া যাবে: [rt_reading_time] মিনিটে


ঘাতকদের ছুরিকাঘাতে নিহত মাদরাসা শিক্ষক সাইফুল ইসলাম

এইচ. এম. রুস্তম আলী, ঈদগাঁও
সমাজের সর্বত্র যেভাবে অবক্ষয় চলছে তাতে শুধু সাধারণ মানুষ নয়, হতাশা আর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে সমাজের বিশিষ্ট বর্গের মধ্যেও। সমাজের অবক্ষয়ের যে বীভৎস রূপ প্রতিদিন প্রকাশ পাচ্ছে তাতে এ আতঙ্ক স্বাভাবিক। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ পাচ্ছে না গ্রামগঞ্জের অসংখ্য ঘটনা। সদরের চৌফলদন্ডীর ঘটনা উল্লেখ করে অনেকেই মন্তব্য করেছেন, মনে হয় বেশিদিন আর এ সমাজে টিকে থাকা যাবে না। ক্রমেই বসবাস অযোগ্য হয়ে উঠছে সমাজ। অপরাধীদের দৌরাত্ম্যে দিনদিন সংকুচিত হচ্ছে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা। অনেক কিছু থেকেই গুটিয়ে আনতে হচ্ছে নিজেদের। কোথাও যেন আর আস্থা নেই, নিরাপত্তা নেই। শুধু কি তাই? যাদের এসব দমন করার দায়িত্ব তারাই দেখা যাচ্ছে অপরাধীদের হয়ে কথা বলছে, সাফাই গাইছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব কিভাবে মেনে নেয়া যায় বলে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন অনেকে। সামাজিক অবক্ষয় আর জেলার নানা প্রান্তে তার ভয়ঙ্কর বহিঃপ্রকাশে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে আজ ভীতি আর আতঙ্ক। অনেকে ভুগছেন নিরাপত্তাহীনতায়। এ থেকে মুক্তির উপায় কি জানতে চাইলে অনেকে বলেছেন দেশের শাসন কাজ পরিচালনার দায়িত্বে যারা রয়েছেন সবচেয়ে বড় দায়িত্ব তাদের। চৌফলদন্ডী ইউনিয়নের জনপ্রিয় সাবেক এক চেয়ারম্যান বলেন ১৯৯৫ সালে ভচক্ষ্যা হত্যার পর থেকে এ পর্যন্ত ১৬/১৭টি খুনের ঘটনার বেশিরভাগ অভিযুক্ত ব্যক্তি শাস্তি পায়নি। অনেকে খুন করে বিদেশে পালিয়ে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে আছে। ফলে অন্যায়কে ন্যায় হিসাবে মেনে নেয়ার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে আমাদের সমাজে। অন্যায় অপরাধ সহনীয় হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। অনিয়মই নিয়ম হিসাবে মেনে নিচ্ছে সবাই। সর্বত্র প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা লক্ষ্যণীয়। ফলে অনেকেই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে চায়। কারণ ক্ষমতার কাছাকাছি থাকলে নিরাপত্তা লাভ করা যায়। এর বাইরে বিপুল জনগোষ্ঠি বিশেষ করে গরীব মানুষের নিরাপত্তা আর থাকছে না। তাদের বিপদে পাশে দাড়ায় না কেউ। নতুন মহাল ওসমান কর্তৃক ছৈয়দ করিমের খুনের ঘটনায় তাই হয়েছে। এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতিফলন মাত্র। এলাকাবাসী বলছেন যেসব ভয়ঙ্কর আর মর্মান্তিক ঘটনা আমরা এবং আমাদের ছেলেমেয়েরা দিনের পর দিন দেখছি তা আর সহ্য করার মত নয়। ১০ জুন সৎ ভাইয়ের পরিকল্পনায় সৎ ভাই ঘাতকের ছুরিকাঘাতে খুন হয়। ৯ জুলাই পাওনা টাকা ফেরত দেয়ার কথা বলে দেনাদার তার নিজ বাড়ীতে ডেকে নিয়ে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে একই এলাকার সৌদি প্রবাসী যুবক ছৈয়দ করিমকে। এ খুনের ঘটনা গুলো ঘটেছে মাত্র একমাসের ব্যবধানে। চৌফলদন্ডীর নতুন মহাল এলাকায় ২টি হত্যাকান্ডের ধরণ দেখে পুলিশ বলছে এগুলো পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। আর এ দুটির খুনের পেছনে প্রতিটি ব্যাকগ্রাউন্ড ও প্রায় অভিন্ন। সব হত্যার পেছনে রয়েছে পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, সামাজিক অস্থিরতা ও অর্থ সম্পত্তির বিরোধ। শুধুই হত্যাকান্ড নয়, বৃহত্তর ঈদগাঁওসহ জেলার প্রতিটি কোন না কোন স্থানে প্রতিদিন এ রকম হত্যাকান্ড ঘটেই চলছে। পারিবারিক ও সামাজিক সহিংসতা দিনদিন বেড়েই চলছে আশঙ্কাজনক হারে। এলাকার মুরব্বী ও সচেতন ব্যক্তিদের মতে একে অপরের প্রতি সৌহার্দ্য পূর্ণ আচরণ ক্রমেই উঠে যাচ্ছে সমাজ ও পরিবার থেকে। মানুষের মূল্যবোধের জাগ্রত বাতিটি ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে। আকাশ-সংস্কৃতি আর ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারণে একে অপরের সাথে যোগাযোগও কমিয়ে দিয়েছে। শ্রদ্ধা, ¯েœহ, মায়া-ভালবাসাগুলো ক্রমশঃ কমে যাচ্ছে। এতে করে প্রতিনিয়ত বাড়ছে সামাজিক অস্থিরতা খুন খারাবী। মানুষ নৈতিক মূল্যবোধ হারিয়ে ধীরে ধীরে ক্রোধ সংযম করতে না পেরে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। পারিবারিক কলহ, মাদক, পরকিয়া, প্রেম, দাম্পত্য সমস্যা, ঋণগ্রস্থ, শারীরিক ও আর্থিক অক্ষমতা, সমাজে প্রভাবশালী হওয়া, জমি-জমার বিরোধকে কেন্দ্র করেই অধিকাংশ খুনের ঘটনা ঘটছে। পাশাপাশি সামাজিক অস্থিরতার কারণে জীবনে বাড়ছে হতাশা। মানসিক বিষন্নতা, আর্থিক দৈন্য। নিঃস্ব এসব হত্যাকান্ডের শিকার হচ্ছে শিশুরাও। অকারণে হিংসা-বিদ্বেষ বেড়ে গিয়ে পারিবারিক ও সামাজিক খুনের ঘটনা বাড়ছে অহরহ। এসব কলঙ্কময় অধ্যায় থেকে পরিত্রাণের উপায় হচ্ছে সামাজিক, পারিবারিক মূল্যবোধ এবং ধর্মীয় অনুশাসন বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই বলে মনে করেন সুশীল সমাজের লোকজন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত একমাসের ব্যবধানে একই এলাকায় একই কায়দায় খুন হয়েছে ২ জন। এর মধ্যে ১০ জুন রাতে নতুন মহাল বাজার থেকে বাড়ী ফেরার পথে স্থানীয় রহমানিয়া মাদ্রাসা এলাকায় পৌছলে পূর্ব থেকে উৎপেতে থাকা খুনী মাদ্রাসা শিক্ষক সাইফুলকে উপর্যুপরী ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

৯ জুলাই সকাল ১১টায় চৌফলদন্ডীর কালু ফকির পাড়া গ্রামে পাওনা টাকা ফেরত দেয়ার কথা বলে বাড়ীতে ডেকে নেয়। একসাথে নাস্তা পানি খাওয়ার পর খুনী ওসমান আমি টাকা নিয়ে আসি বলে ভেতরে যায়। হঠাৎ একটা ধারালো ছুরি নিয়ে এসে ছৈয়দ করিমকে ৭/৮টি ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ২০১৬ এর ১৫ জুন গভীর রাতে সদরের ইসলামাবাদে শাহ ফকির বাজারে প্রতিপক্ষের গুলিতে আবছার কামাল (৩৩) নিহত হন। আহত হয়েছিলেন আরো ২ জন। ১৬ জুন শনিবার রামু উপজেলার ঈদগড়ে প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত হন ডাঃ মহিউদ্দীন। ২০ জুন সোমবার কক্সবাজার শহরে আবাসিক এক হোটেলে সুইমিং পুলে গোসল করতে নেমে চৌফলদন্ডী ইউনিয়নের পশ্চিম পাড়া গ্রামের মোহাম্মদ দিদার মিয়ার ছেলে ফয়জুল হক সাগর (১৩) এর রহস্যজনক মৃত্যু হয়। তার বাবা একজন নৈশ প্রহরী। তিনি তার ছেলেকে ধরে নিয়ে গিয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছিল বলে অভিযোগ করেছিলেন। ২৩ জুন বৃহষ্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় সদর উপজেলার খুরুলিয়ায় ২ ভাইয়ের পিটুনীতে নিহত হন ছালামত উল্লাহ বাবুল (৪৫)। ৮জুলাই শুক্রবার সদর উপজেলার ঈদগাঁও ভোমরিয়াঘোনা এলাকায় পূর্ব পোকখালীর মৃত রাজা মিয়ার ছেলে শওকতের (২৪) গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুিলশ। এসব হত্যাকান্ডের বিষয়ে পুলিশের অপরাধ বিষয়ক এক তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, আমাদের সমাজ দিনদিন আধুনিকতার দিকে যাচ্ছে। সম্পর্ক জটিল থেকে জটিলতর হয়ে যাচ্ছে। সামাজিক ঐতিহ্য পরিবার থেকে সরে যাচ্ছে। নতুন নতুন বিষয় যোগ হচ্ছে। পরষ্পরের প্রতি বিশ^াস ও আস্থা কমে যাচ্ছে। এসবসহ বেশ কিছু কারণে খুনের ঘটনা ঘটছে। এ অবক্ষয় রোধ করতে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন বাড়াতে হবে। কক্সবাজার সরকারী কলেজের এক সমাজ বিজ্ঞান শিক্ষক বলেন বর্তমানে মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের দারুণ অবক্ষয় ঘটছে। পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন ভেঙ্গে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে পরষ্পরের মমতাবোধ।