“আরবে দেখেছি জীবন্ত ইসলামকে”-(খন্ড-১২)

মহসীন শেখ:

পবিত্র মদিনা সফরে দেখার সুযোগ হলো ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উহুদ যুদ্ধের অন্যতম নিদর্শন ঐতিহাসিক উহুদ ও রোমা পাহাড়। যে পাহাড়ে উহুদের যুদ্ধে স্বয়ং রাসূল (সা.) এই যুদ্ধে আহত হন এবং গুজব ছড়িয়ে পড়ে তিনি নিহত হয়েছেন। এই যুদ্ধে মুসলমানদের ৭৩ জন মুজাহিদ শহীদ হন। অপরপক্ষে শত্রু পক্ষের নিহত হয় ২৩ জন।

মদিনা নগরীর উত্তর দিকজুড়ে বিস্তৃত বিখ্যাত ওহুদ পাহাড়। মাথা উঁচু করে থাকা ওহুদকে মদিনা শহর থেকেও দেখা যায়। এই সেই বিখ্যাত পাহাড় যার পাদদেশে মক্কার কাফেরদের সাথে রাসূলের(সা:) যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ওহুদ পাহাড় নিয়ে হাদিসে বর্ণনা আছে। ওহুদের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সা: নিজে অংশ নেন।

সে সুবাধে গত ১১ মে স্বস্ত্রীক আমাকে পবিত্র মক্কা থেকে মদিনা সফরের সুযোগ ঐতিহাসিক এই পাহাড় দেখার সুযোগ হয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ।

উহুদ পর্বত সৌদি আরবের মদিনা শহরের উত্তরে অবস্থিত। এর উচ্চতা ১,০৭৭ মি (৩,৫৩৩ ফু)। মক্কার কুরাইশ ও মদিনার মুসলিমদের মধ্যকার উহুদের যুদ্ধ এই পর্বত সংলগ্ন স্থানে সংঘটিত হয়েছিল। সৌদি আরবের ঐতিহাসিক ওহুদ পাহাড়সৌদি আরবের ঐতিহাসিক ওহুদ পাহাড় মদিনা নগরীর উত্তর দিকজুড়ে বিস্তৃত বিখ্যাত ওহুদ পাহাড়। মাথা উঁচু করে থাকা ওহুদকে মদিনা শহর থেকেও দেখা যায়।

সূত্রমতে, ৬২৫ খৃষ্ট. হিজরীর তৃতীয় বর্ষে কুরাইশ দলপতি আবু সুফিয়ানের ৩০০০ সশস্ত্র সৈন্য ৩০০ উস্ট্রারোহী ও ২০০ অশ্বারোহী সহ মক্কা হইতে যুদ্ধাভিযান করে মদিনার ৫ মাইল পশ্চিমে উহুদ নামক স্থানে উপস্থিত হয়। এর প্রেক্ষিতে ১০০ জন বর্মধারী এবং প্রায় ৫০ জন তিরন্দাজসহ ১০০০ জন মুজাহিদ বাহিনী কুরাইশদের মোকাবেলা করার জন্য উহুদের দিকে অগ্রসর হন। পথিমধ্যে মোনাফেক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই তার ৩০০ জন অনুসারী নিয়ে পলায়ন করে। শেষ পর্যন্ত ৭০০ জন মুজাহিদ নিয়ে ৬২৫ খৃষ্ট. ২৩ মার্চ মুসলিম ও কাফেরদের মধ্যে একটি যুদ্ধ সংগঠিত হয়। উহুদ পাহাড়ের দক্ষিণে আইনায়েন পাহাড়। এই পাহাড়ে রাসূল (সা.) তীরন্দাজ বাহিনী সমাবেশ করেন এবং যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত তাদেরকে সেখানে অবস্থান করতে বলেন। কিন্তু যুদ্ধের প্রথমদিকে মুসলমানদের বিজয় অর্জিত হলে তীরন্দাজ বাহিনী গণিমত কুড়ানোর জন্য মাঠে নেমে যায়। এই সুযোগ টিকে কাফের নেতা খালিদ বিন ওয়ালিদ কাজে লাগায়। খালিদ বিন ওয়ালিদ পেছন দিক থেকে আক্রমন করে এবং মুসলমানদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। স্বয়ং রাসূল (সা.) এই যুদ্ধে আহত হন এবং গুজব ছড়িয়ে পড়ে তিনি নিহত হয়েছেন। এই যুদ্ধে মুসলমানদের ৭৩ জন মুজাহিদ শহীদ হন। অপরপক্ষে শত্রু পক্ষের নিহত হয় ২৩ জন।

উহুদের পাদদেশের নিকটেই ছোট্ট আকারের আরেকটি পাহাড়ের চূড়া। যেটির নাম জাবালে রোমান অর্থাৎ রোমান পাহাড়। এই পাহাড়ের ওপরই রাসূল সা: তাঁর ৪০ জন সাহাবিকে একটি সঙ্কীর্ণ গিরিপথ প্রহরায় নিয়োজিত রেখেছিলেন। তাদের মধ্যে ছিল তীরন্দাজ বাহিনীও। রাসূল(সা:) নির্দেশ দিয়েছিলেন কোনো অবস্থাতেই তারা যেন এই প্রহরা থেকে সরে না যান। এমনকি সম্মুখের বাহিনীর গোশত ছিঁড়ে খাওয়া দেখলেও তারা যেন এখানকার প্রতিরক্ষাকার্যক্রম থেকে নিবৃত্ত না হন। যুদ্ধের প্রথম দিকে কাফের বাহিনী পিছু হটতে থাকে। প্রবল বিক্রমে এগিয়ে যেতে থাকেন রাসূলের(সা:): সাহাবিরা। সঙ্কীর্ণ গিরিপথ প্রহরার দায়িত্ব ছিল আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়েরের নেতৃত্বে একদল সেনার। যুদ্ধে মুশরিকদের পরাজয় দেখে তারা আর স্থির থাকতে পারেননি। রাসূলের(সা:( কঠোর নির্দেশ উপেক্ষা করেন তারা।

ঐতিহাসিকেরা বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের তাঁর সাথে থাকা প্রহরারত বাহিনীকে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা নিষেধ উপেক্ষা করে পলায়নপর মুশরিকদের পিছু ধাওয়া করেন এবং নিজেদের অবস্থান ছেড়ে দেন। দূর থেকে খালিদ বিন ওয়ালিদ তা দেখে অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে সঙ্কীর্ণ গিরিপথ অতিক্রম করে পেছন থেকে মুসলিম বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে যুদ্ধের গতিপথ পাল্টে যায়। রাসূলের(সা:) বর্ম ভেদ করে তাঁর পবিত্র শরীরে তীর বিদ্ধ হয়। সাহাবিরা রা: রাসূলকে ঘিরে মানববর্ম তৈরি করেন। রাসূলের(সা:) দন্ত মোবারক শহীদ হয় এ যুদ্ধে। হজরত আবু বকর রা: হজরত ওমর ফারুক(রা:) প্রমুখ এ যুদ্ধে রাসূলের সা: সাথী ছিলেন। তৃতীয় হিজরিতে সংঘটিত এ যুদ্ধে মক্কার কুরাইশদের সংখ্যা ছিল তিন হাজার। সাথে ছিল অশ্বারোহী বাহিনী। আর মুসলমানদের সংখ্যা ছিল মাত্র সাত’শ। এর মধ্যে অশ্বারোহী বাহিনী ছিল অনুল্লেখযোগ্য। তা সত্ত্বেও মুসলিমরা যুদ্ধের প্রাথমিক অবস্থায় বিজয় লাভ করে। পরবর্তীতে নিজেদের মধ্যে বিশৃঙ্খলার কারণে তারা পরাজিত হয়। তবে কুরাইশরা বিজয়লাভের পরও দ্রুত যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করেছিল কেন তা আজো ঐতিহাসিকদের কাছে বিস্ময়কর।

হে আল্লাহ্- বিশ্বের সকল মুসলমানকে অন্তত একটিবার মক্কা মদিনার জীবন্ত ইসলামকে দেখার সুযোগ করে দাও। আমীন।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক সকালের কক্সবাজার। মোবাইল:- ০১৬১৯০৭০৫১৩