এম.আর মাহমুদ :
এক সময় গ্রামের প্রবীণদের কাছে শোনা যেত ‘চোরের ভিটায় দালান উঠে না’। বর্তমানে চুরির ধরণ পাল্টে যাওয়ায় চোরের ভিটা দালান উঠছে। এক সময় চোরেরা রাতের আঁধারে অপেক্ষাকৃত অর্থশালী পরিবারের বাড়ির নিচে গর্ত খনন করে গৃহে প্রবেশ করে টাকা-পয়সা, গয়না, হাড়ি-পাতিল, মূল্যবান কাপড়-চোপড় চুরি করত। চুরির মাল বিক্রি করে যে অর্থ অর্জন করত তা দিয়ে সংসার চালাতো। আবার ধরা পড়লে কপালে জুটত গণধোলায়। সে সময় সমাজপতিরা এসব চোরকে থানায় সোপর্দ করত না। কিন্তু এখন সে প্রকৃতির চুরি তেমন একটা নেই বললেই চলে। সিরাজ-উদ-দৌলা নাটকের একটি ডায়ালগ দিয়ে বলতে হয় ‘উপায় নেই গোলাম হোসেন’। এখন চোরের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চোরকে অনেকে সমীহ করে। কারণ চোরেরও মানসম্মান আছে।
প্রসঙ্গক্রমে একটি গল্প না বললে হয় না ‘এক রাজ বাড়িতে চোর ঢুকে সমস্ত মালামাল একপাশে মওজুত করে রাখে। এমন সময় রাণী ঘুম থেকে জেগে রাজাকে বলল তুমি ঘোড়ার মত উপোড় হয়ে শুয়ে থাক। আমি তোমার উপর চড়ব। রাজা রাণীর কথা রাখতে গিয়ে একই কায়দায় শুয়ে রইল। আর রাণী রাজার পিঠের উপর উঠে বসল। কিছুক্ষণ পর রাজা বুঝতে পারল তার বাড়িতে চোর ঢুকেছে। তখন রাজা বলল এত রাতে বাড়িতে কে রে? চোর বেচেরা বলে বসল, আমি চোর। তখন রাজা চোরের কাছে জানতে চাইল, কি কি চুরি করেছ। চোর অকপটে বলে বসল, আমি আপনার বাড়ির অর্ধেক মূল্যবান সম্পদ চুরি করেছি। তবে কিছুই নেব না। আমি চলে যাব। রাজা জানতে চাইল এত কষ্ট করে বাড়ির মালামাল চুরি করেছ, নেবে না কেন? চোর বলল হুজুর যে রাজা রাণীর কথা মত ঘোড়ার মত শুয়ে আর রাণী রাজার পিঠে চড়ে। আমি সে রাজার মাল চুরি করি না। চোরেরও মান সম্মান আছে।
প্রসঙ্গক্রমে বলতে হচ্ছে আজ থেকে ৪০ বছর আগে যখন দক্ষিণ কাকারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। তখন আমার শ্রদ্ধাভাজন প্রিয় শিক্ষক লোকমান আলী খাঁন সাহেবের কাছ থেকে প্রথম গরুর রচনাটি শিখেছি। যা কিছু কিছু স্মরণ আছে আবার কিছু কিছু ভুলে গেছি। এক সময় গরু দিয়ে মানুষ চাষাবাদ করত। অগ্রহায়ণ মাসে ধান মাড়াইয়ের কাজে গরু ব্যবহার হত। এখন কিন্তু কলের লাঙলের কারণে গরু দিয়ে চাষাবাদ ও ধান মাড়াইয়ের কাজ হয় না। ফলে গরু অনেকটা সুখেই আছে। পথে-ঘাটে, বিলে-জঙ্গলে বেশুমার গবাদি পশুর পাল দেখা যেত। এখন তেমন একটা দেখাই যায় না। হতদরিদ্র লোকজন লাভের আশায় গরু-ছাগল, মহিষ-ভেড়া লালন পালন করে। মানুষের প্রয়োজনে এসব গবাদি পশু বিক্রি হয়। এখন কিন্তু গবাদি পশুর মূল্যও আকাশ ছোঁয়া। সে কারণে দেশেই হরহামেশা গবাদি পশু চুরি হচ্ছে। আগেও গবাদি পশু চুরি হত না তা নয়। তবে চোরেরা গবাদি পশু চুরি করে চেনা-অচেনা পথ দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যেত। কিন্তু এখন আধুনিকতার সৌভাগ্যের কারণে গরু চুরির কাজে ব্যবহার হচ্ছে ম্যাজিক, মাইক্রো, হাইয়েস, নোহা ও মিনি ট্রাক। আগের মত হতদরিদ্র চোরেরা এসব গবাদি পশু চুরি করে না। এখন যারা গবাদি পশু চুরি করায়, তারা সমাজের ‘হোয়াইট কালার ক্রিমিন্যাল’। তাদেরকে কেউ চোর হিসেবে সন্দেহও করবে না। কথা-বার্তা, চলন-বলন, বাড়ি ঘরের জৌলস দেখলে মনে হবে তারা যেন সমাজসেবক ‘আলালের ঘরের দুলাল’। আধুনিক পদ্ধতিতে গবাদি পশু চুরির পর নির্ধারিত আস্তানায় পৌঁছার পর পরই এসব গবাদি পশু জবাই করে চামড়া ছাটাইয়ের পর শিং ফেলে দিয়ে সহজেই আলামত নষ্ট করে দেয়। কারো পক্ষে এসব গবাদি পশুর মালিকানা নির্ধারণ করা কঠিন। কারণ দেশে এখনও গবাদি পশুর মাংস ডিএনএ টেস্ট করে সনাক্ত করার পদ্ধতি আবিষ্কার হয়নি।
গত বৃহস্পতিবার ভোরে চকরিয়া থানা পুলিশ চকরিয়া-বদরখালী সড়ক হয়ে একটি মাইক্রো ভর্তি করে যাওয়ার পথে খোদারকুম এলাকায় মাইক্রোবাসটি জব্ধ করার চেষ্টা করলে চোরের দল বেপরোয়া গতিতে মাইক্রো চালিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। এ সময় দায়িত্বরত পুলিশ এক রাউন্ড পিস্তলের গুলি বর্ষণ করে গাড়িটি আটকাতে সমর্থ হয়। পরে পুলিশ গাড়ির দরজা খুলে ৪টি গরু উদ্ধার করে। পুলিশের ভাষ্য মতে গরুগুলো যাচ্ছিল সাহারবিল ইউনিয়নের কোরালখালী এলাকার এক গরু চোরের আস্তানায়। ওখানে পৌঁছলেই গরুগুলো জবাই করে মাংস হোটেলে পৌঁছে যেত। তবে বেরসিক পুলিশের কারণে প্রভাবশালী গরু চোরদের হাত থেকে ৪টি গরু রক্ষা পেয়েছে। ৪টি গরু সহ মাইক্রোটি জব্ধ হলেও চোরের দল কৌশলে পালিয়ে গেছে।
চোরের পালের গোদারা সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। তারা বড় বড় নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের আশ্রয় প্রশ্রয়ে থাকে। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার ভাষায় বলতে হয় ‘বড় চোর বড় বীর থাকে তার উঁচু শির’। তাদের ক্ষেত্রে অবস্থা অনেকটা এমনই। মূলত বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের মোদি বাবু সীমান্ত হয়ে গরু পাচার বন্ধ করে দেয়ায় গরুর মাংসের সংকট দেখা দিয়েছে। এ কারণে গরুর মাংসের চাহিদা ও দাম দু’টিই বেড়েছে। চকরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বখতিয়ার উদ্দিন চৌধুরীর অভিমত, হোয়াইট কালার ক্রিমিন্যালরা গরু চুরিতে সরাসরি অংশগ্রহণ করে না। তারা কিছু হতদরিদ্র কামলাকে ব্যবহার করে। পরে গরু সহ ধরা না পড়ায় গরু চোরের দলপতিরা বার বার রক্ষা পাচ্ছে। গরু চতুষ্পদ জন্তু। লেজ, কান, মুখ, শিং, পা সবই আছে শুধু কথা বলতে পারে না। ঘাস খেয়ে বেঁচে থাকে। বেশিরভাগ গরুর মালিক লালিত গরুগুলো সন্তানের মত আদর-যতœ করে লালন পালন করে। কিন্তু নিষ্ঠুর চোরের কবল থেকে বাঁচাতে পারছে না। তাদের আতনাদ শোনার কেউ নেই। সামনে ঈদুল আযহা ও ভাদ্র মাস। এ সময়ে গরু চুরি বেড়ে যায়। ফলে অনেক মালিক নিজ বাড়িতে গরু ছাগল নিয়ে বসবাস করছে। ভাদ্র মাসে গরু হারালে কি যে কষ্ট হয় তা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।
গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক ভাদ্র মাসে গরু হারিয়ে মাঠে-ঘাটে খোঁজাখুঁজি করে যখন বাড়িতে ফিরছিল, তখন ছেলে জানতে চাইল বাবা কোত্থেকে আসছ? বাবা জবাব দিল, শালা বেশি কথা বলিস না। কৃষকের স্ত্রী দৌঁড়ে এসে স্বামীর কাছে জানতে চাইল, আমার ছোট ভাই আসছে নাকি? তখন কৃষক বলে বসল, মা বেশি কথা বলিস না। এসব কথা শুনে স্ত্রী বলল কি রে তুমি পাগল হয়েছ নাকি? তুমি ছেলে শালা, স্ত্রীকে মা ডাকছ কেন? এমন সময় গরু হারানো কৃষক জবাব দিল, হারামজাদী বেশি কথা বলিস না, ভাদ্র মাসে গরু হারালে বা চুরি করে নিয়ে গেলে মাঠে-ঘাটে খুঁজতে গিয়ে এমন অবস্থায় হয়েছে।
অতএব, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে অনুরোধ গবাদি পশু চুরিতে যারা জড়িত, যারা নাটের গুরু তাদের ছাড় দেয়া যথাযথ হবে না। সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গবাদি পশু লালন পালনকারীদের সহজ শর্তে ব্যাংক থেকে ঋণ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু গবাদি পশু চুরি না থামলে এ ঘোষণা কোন কাজে আসবে না। অতএব, মন্তব্যই নি®প্রয়োজন।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।