গোলাম মাওলা রনি
প্রবাদটি বিদেশি কিন্তু সেটির তাৎপর্য সার্বজনীন। পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের ধুরন্ধর লোকজনের মতো আমাদের গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের বিভিন্ন সময়ের নাটের গুরুরা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী কিংবা অপছন্দের লোকদের সর্বনাশ করার জন্য প্রবাদটির অব্যর্থ প্রয়োগ চালিয়ে আসছেন সেই অনাদিকাল থেকে। ইংরেজি প্রবাদটির বাংলা রূপান্তর করলে অর্থটি মোটামুটি এমন দাঁড়ায় যে, ‘তুমি যদি কুকুরটিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারতে চাও তবে সবার আগে জানোয়ারটির জন্য একটি মন্দ ও নিন্দনীয় নাম ঠিক কর। তারপর সর্বশক্তি নিয়োগ করে বহুমুখী প্রচারে মন্দ ও নিন্দনীয় নামটিকে সাধারণ্যে প্রচলন ঘটাও, বিশ্বাসযোগ্য এবং জনপ্রিয় করে তোলো। ’ আপনি যদি স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট এবং শিরোনামের বিষয়গুলো বিবেচনা করেন, তবে বিদেশি প্রবাদটির সফল প্রয়োগের কুফল সহজেই অনুধাবন করতে পারবেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের পতন ঘটানোর অন্যতম নিয়ামক ছিল ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ। বহুল আলোচিত সেই দুর্ভিক্ষটি যতটা না প্রাকৃতিক, তার চেয়েও বেশি ছিল মনুষ্য সৃষ্ট। চারদিকে বিরূপ প্রচার-প্রপাগান্ডা, ফটকাবাজ, বাজিকর, মজুদদার, আড়তদার এবং চোরাকারবারীদের সম্মিলিত স্থল, স্থূল ও অন্তরীক্ষের চক্রান্তের ফলে দুর্ভিক্ষ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এরই মধ্যে একটি খবর প্রচারিত হয়—উত্তরবঙ্গে বাসন্তী নামের এক দরিদ্র মহিলা অভাব ও দুর্ভিক্ষের কবলে এতটাই বস্ত্রহীন হয়ে পড়েছেন যে, তিনি মাছ ধরার জাল পরে নিজের লজ্জা নিবারণ করে যাচ্ছেন। পত্রিকায় বাসন্তীর জালপরা ছবি ছাপা হলো এবং আমজনতা তা কোনোরূপ বিচার-বিবেচনা ছাড়াই বিশ্বাস করে তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। দ্বিতীয় ঘটনাটি ২০১৩ সালের। যুদ্ধাপরাধী বলে অভিযুক্ত জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে দেশের যুবসমাজ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে এলেন। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে লাখ লাখ তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীর সম্মিলন পুরো দেশের ভিত কাঁপিয়ে দিলো। তরুণদের সেই জাগরণকে অস্বীকার বা প্রতিহত করার শক্তি তখন কারও ছিল না। গণজাগরণ মঞ্চ নাম দিয়ে সম্পূর্ণ আনকোরা তরুণ নেতৃত্ব অতি অল্প সময়ের মধ্যে পুরো দেশের গণমতের একটি বিরাট অংশের ওপর প্রভাব বিস্তার করে ফেলল। ফলে পুরো শাহবাগ এলাকা যেন বাঙালির তীর্থকেন্দ্রে পরিণত হলো। সেখানে যাওয়া, সময় কাটানো কিংবা শাহবাগের পক্ষে কথাবার্তা বলা প্রগতি এবং আধুনিক কর্মকাণ্ডের গুজব ছড়িয়ে দিলো। ফলে নাক উঁচু মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের সেখানে যাওয়া বন্ধ হলো এবং গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে পড়ল। তৃতীয় ঘটনাটি হেফাজতের আমির বয়োবৃদ্ধ আলেম আল্লামা আহমদ শফীকে নিয়ে। গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক, ছাত্র এবং সমর্থকদের ২০১৩ সালের ৫ মে তারিখে স্মরণকালের বৃহত্তম সমাবেশ করে হেফাজতে ইসলাম নামের সম্পূর্ণ নতুন এবং অরাজনৈতিক একটি সংগঠন পুরো দেশ ও বিদেশ কাঁপিয়ে তোলে। সংগঠনটির নেতৃত্ব দেন আল্লামা আহমদ শফী। জাতীয় রাজনীতি, ধর্ম, সামাজিকতা এবং মানুষের দৈনন্দিন আলোচনায় হঠাৎ করেই জনাব শফী অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন। এরই মধ্যে তার বিরুদ্ধে ছড়িয়ে দেওয়া হয় তেঁতুল তত্ত্ব। কোনো একটি ওয়াজ মাহফিলে তিনি গতানুগতিক ওয়াজের ধারায় লোকজনকে জেনা-ব্যভিচার থেকে বেঁচে থাকার উপায় বলতে গিয়ে জেনার ভাব সৃষ্টিকারী পরিবেশ, প্রতিবেশ ইত্যাদি ব্যাখ্যা করছিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বললেন, পুরুষের কাছে নারীর আকর্ষণ তেঁতুলের মতো। তেঁতুল দেখলে যেমন মুখে লালা এসে যায়, তেমনি সক্ষম পুরুষের কাছে আকর্ষণীয় নারী লোভজাগানিয়া আকর্ষণ সৃষ্টি করে। এ কথাটিকে শফী-বিরোধীরা এমনভাবে প্রচার করতে থাকেন, যার কারণে হেফাজত এবং আল্লামা শফী উভয়েই মারাত্মক বিপর্যয়ে পড়ে ধীরে ধীরে ম্রিয়মাণ, নিষ্প্রভ এবং অকার্যকর হয়ে পড়েন। সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে ভিন্নমতের লেখক এবং ব্যতিক্রমী কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহারকে নিয়ে। সাম্প্রতিক সময়ে পুরো দেশ-বিদেশকে তোলপাড় করে দিয়ে খবর বের হয়, তিনি অপহূত হয়েছেন। প্রবল জনমত এবং দেশ-বিদেশের সংবাদ মাধ্যমের ব্যাপক প্রচারণার ফলে সরকারের ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি হয়। সৌভাগ্যক্রমে পুলিশ কর্তৃক ফরহাদ মজহার উদ্ধার হন ঘটনা ঘটার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। দেশবাসী হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন এবং অপহরণকারীদের খুঁজে বের করার জন্য নুতন দাবি জোরালো হতে থাকে। এরই মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হতে থাকে, ফরহাদ মজহারের ধর্ম সংক্রান্ত ভিন্নমত, কবিতার উপসর্গ, প্রেম, গুরুবাদ ইত্যাদি সম্পর্কে অতীতের কর্মকাণ্ড। তার গুরুবাদে প্রেম ও দেহতত্ত্ব এবং প্রেমভাজাতত্ত্ব এমনভাবে উপস্থাপনা করা শুরু হয়, যা শুনে লোকজন শুরু করে ছি ছি। তার পক্ষের প্রবল জনমত স্তিমিত হয়ে যায়। তার সমর্থনকারীরা নীরব হয়ে যেতে বাধ্য হন। আর এরই ফাঁকে অর্চনা নামের এক মহিলা আদালতে এসে ফরহাদ মজহার সম্পর্কে এমন সাক্ষ্য দিয়ে যান, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এ যাবৎকালে ঘটেনি। উপরোক্ত ঘটনাগুলো আমাদের চিন্তা এবং চেতনার জন্য যেমনি মারাত্মক ক্ষতিকর, তেমনি মন ও মননশীলতার জন্য আত্মহত্যার মতো পাপাচার বলে বিবেচিত। জাতীয় জীবনে প্রতারণা, ঠকবাজি ও অমানবিক ঘটনা যত বেশি ঘটবে, ততই আমরা বুদ্ধিহীন, অনুভূতিহীন এবং হৃদয়হীন হয়ে পড়ব। আমাদের বিবেক লোপ পাবে এবং জাতি হিসেবে আমরা মান-সম্মান হারাতে থাকব। আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, উপরোক্ত ঘটনাসমূহের নায়করা ব্যক্তি বিশেষ, মহল বিশেষ, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের ক্ষতি করতে পারেন বটে; কিন্তু নিজেরা কোনো দিন লাভের মুখ দেখতে পারেন না। তাদের কর্মকাণ্ডের পর তৃতীয় পক্ষ লাভবান হয়; যারা উদ্ভূত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে হঠাৎ করেই আলোচনা, ক্ষমতা বা সুযোগ-সুবিধার কেন্দ্রে চলে আসেন।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।