মামুনুর রশিদ :
আমাদের চারপাশে বসবাস করছে কিছু মানুষরূপী অমানুষ।গৃহস্থালির কাজে সহায়তাকারী ছোট শিশুদের ওপর যারা হরহামেশাই চালাচ্ছে অমানবিক নির্যাতন। এরা সমাজের খুব উঁচু-উঁচু পদেই আছেন। অনেক নাম ডাক রয়েছে সমাজে তাদের।সেলিব্রেটি থেকে রাজনৈতিক নেতা কেউ বাদ নেই এই তালিকায়। কোথাও নিরাপদ নয় গৃহকর্মে সহায়ক এই শিশুরা। কিছুদিন আগের কথা, ক্রিকেটার সাহাদাতের স্ত্রীর হাতে চরম নির্যাতনের শিকার শিশুকে রাস্তায় পেয়ে প্রতিবেশীরা হাসপাতালে নিয়ে যায়। মামলা হলে গ্রেপ্তার হন সাহাদাত ও তার স্ত্রী।সে সময় গণমাধ্যমে খবর বের হয় সর্বোচ্চ চৌদ্দ বছরের জেল হতে পারে এ অপরাধে।কিন্তু কিছুই হয়নি।কিছুদিন পরই জামিনে বের হয়ে যায় অপরাধী।আঘাতের ঘা হয়তো তখনো শুকোয়নি নির্যাতিত শিশুটির। তিক্ত হলেও সত্য, আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেঁচে যান এসব বিকৃত মননের বিত্তশালী।কিন্তু অভাবী পরিবার থেকে আসা এই শিশুরা কেউ হারিয়ে ফেলে চোখ।কেউ আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলে হাত বা পায়ের কিছু অংশ চিরতরে হারিয়ে ফেলে।কারো পিঠে জ্বলন্ত লোহার ছেঁক দিয়ে দাগ বসিয়ে দেওয়া হয়।ঘটনার পর ঘটনা ঘটে যায় কিন্তু শেষ হয় না মানুষরূপী অমানুষদের পাশবিকতা। মাঝেমাঝেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখতে পাই লম্বা ট্রেন ভ্রমণ কিংবা গাড়িতে কোথাও যাওয়ার সময় সিট নেওয়া হয় না এই অবহেলিত গৃহকর্মীদের জন্য।মানুষ হাঁটার রাস্তায় কোন রকমে বসে আর দাঁড়িয়ে যেতে হয় শিশুটিকে এই দীর্ঘ পথ। কয়েকদিন আগেই খবরের কাগজে আসে এক গৃহকর্মী শিশু ডিম ভাজতে ভুল করায় দুচোখে আঘাত করে গৃহকর্ত্রী।ফেনীতে সেদিন এক রাজনৈতিক নেতার বউ গৃহকর্মে সহায়ক এক শিশুকে পিঠ থেঁতলে দিয়েছে গরম পানি দিয়ে।সেসব পাশবিক দৃশ্য দেখলে একজন স্বাভাবিক মানবতাবোধ সম্পন্ন মানুষ অশ্রু আটকাতে পারবেনা।মানবিকতায় চরমভাবে আঘাত করে এমন সব নির্মমতার অমানবিক দৃশ্য। এতসব ঘটনা দেখতে দেখতে আজ বাকরুদ্ধ আমরা।কতটা ঘটনার প্রতিবাদ করা যায়?একটা দুটা? দশটা বিশটা?কিন্তু সমাজপতিদের মাঝে ছড়িয়ে পড়া এই মহামারি অমানবিকতাকে এভাবে কি সমাজচ্যুত করা যাবে সহজে?সামাজিক মূল্যবোধ আজ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে বুঝা মুশকিল! পরম দয়ার আধার বলে আমরা যে নারীকুলকে পরিচয় দিয়ে থাকি সেসব নারীর হাতেই ইদানিং অমানবিক অত্যাচারের শিকার হচ্ছে সুবিধাবঞ্চিত এসব গৃহকর্মী শিশু।এই বয়সে যাদের কাঁধে ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা, সেই শিশুরাই আজ গৃহকর্মে নিযুক্ত হয়ে চরম নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, তাদের আজ ঘরের কোণে আটকে থাকতে হচ্ছে। সামান্য অনুভূতি সম্পন্ন ব্যক্তির কাছেও এইসব নির্যাতন মামবতার চরম লঙ্ঘন।আইনের চোখে তো অব্যশই দণ্ডনীয় অপরাধ।দরিদ্র পরিবারের এসব শিশুকে গৃহস্থালির কাজে সহায়তার জন্য দিয়ে দেওয়া হয় কখনো সামান্য বেতনে আবার কখনো নিছক তিনবেলা খাবারের বিনিময়ে। শিশুর প্রতি এই অত্যাচার সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ও মানবতাবোধের অভাবকেই বারবার দেখিয়ে দিচ্ছে। এই অবক্ষয়ের হাত থেকে অচিরেই আমাদের সমাজকে উদ্ধার করা না গেলে জাতি হিসেবে আমাদের অবস্থান কোথায় গিয়ে ঠেকে, তা কল্পনা করতেও কষ্ট লাগে! আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ ও মানবতার যথার্থ চর্চাই পারে আসন্ন সামাজিক আপদ থেকে আমাদের দূরে রাখতে। তাই আসুন, আমরা সবাই স্ব-স্ব অবস্থান থেকে আরো সচেতন হই এবং রুখে দাঁড়াই চিত্তহীন বিত্তশালীদের চলমান গৃহকর্মী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে। জয়তু, মানবতা! জয়তু মনুষ্য জীবন!
লেখক : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম।