কামাল আহমেদ
একটা দীর্ঘ বিরতির পর আমাদের সংবাদপত্রজগতের সম্পাদকবৃন্দ এবং সাংবাদিকনেতারা অভিন্ন সুরে সরব হয়েছেন। রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে ঐকমত্য যে দেশে বিরল একটি বিষয়ে পরিণত হয়েছে, সেখানে এ ধরনের ঐকমত্য আশা জাগায়। বিশেষ করে, ঐকমত্যটি যখন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সুরক্ষার প্রশ্নে।
সংবাদপত্রের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে সম্পাদক পরিষদ গত বৃহস্পতিবার (২০ জুলাই) এক সভায় মিলিত হয়ে যেসব প্রস্তাব গ্রহণ করেছে, তাতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি হুমকি সৃষ্টিকারী কিছু আইন এবং নতুন আইনের প্রস্তাব সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। বিদ্যমান তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের বহুল সমালোচিত এবং নিবর্তনমূলক বিধি ৫৭ ধারা পুরোপুরি প্রত্যাহারের জন্য তাঁরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ওই একই দিনে ভিন্ন আরেকটি আয়োজনে রাজনৈতিক বিভাজনের দুই পারে থাকা সাংবাদিকনেতারাও অভিন্ন ভাষায় বলেছেন যে ৫৭ ধারার আতঙ্কে সংবাদ প্রকাশে স্বনিয়ন্ত্রণ বা সেলফ সেন্সরশিপ বেড়েছে। সম্পাদক ও সাংবাদিকদের এই উদ্বেগ ও আহ্বানের যথার্থতা প্রমাণিত হয় দুই দিক দিয়ে—প্রথমত, ৫৭ ধারা সম্পর্কে মন্ত্রীদের সাম্প্রতিক বক্তব্য-বিবৃতির অসংলগ্নতায় এবং দ্বিতীয়ত, এই আইনের অব্যাহত অপপ্রয়োগে।
সরকারের পক্ষ থেকে প্রথমে বলা হয়েছিল, ৫৭ ধারার হয়রানিমূলক অপব্যবহার বন্ধে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে। পরে বলা হয়েছে, ডিজিটাল জগৎ বা অনলাইনের অপরাধ মোকাবিলায় পূর্ণাঙ্গ একটি নতুন আইন প্রয়োজন এবং সেই বিবেচনায় সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তৈরি করবে, যাতে ৫৭ ধারা প্রতিস্থাপন করা হবে। সেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে খসড়া প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ১৯ নম্বর ধারায় বিদ্যমান আইসিটি আইনের ৫৭ ধারাটিই প্রায় হুবহু বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু সাজার মেয়াদ এবং জামিনযোগ্যতার প্রশ্নে। ৫৭ ধারায় সন্ত্রস্ত গণমাধ্যমের পক্ষে সম্পাদকবৃন্দ প্রস্তাবিত নতুন আইন সম্পর্কে যে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তাকে আর তাই উপেক্ষা করার কোনো অবকাশ নেই। আইনমন্ত্রী এটি বাতিলের আশ্বাস দেওয়ার পর তথ্যমন্ত্রী যখন সংসদে ৫৭ ধারার পক্ষে সাফাই দেন, তখন বরং উদ্বেগ বাড়ে।
আমরা স্মরণ করতে পারি, সাংবাদিক প্রবীর শিকদারকে থানায় ডেকে নিয়ে ৫৭ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ঢাকা থেকে ফরিদপুরে নিয়ে যাওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে সৃষ্ট সমালোচনা ও প্রতিবাদের মুখে সরকারের একাধিক মন্ত্রী বিতর্কিত আইনটি সংশোধনের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন। সেটি ছিল ২০১৫ সালের আগস্ট মাস। কিন্তু বোধগম্য কারণেই সরকার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেয়নি। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা মাঠপর্যায়ে প্রতিপক্ষকে হেনস্তা করার হাতিয়ার হিসেবে আইনটিকে খুবই কার্যকর বিবেচনা করে দেশের নানা প্রান্তে তার অপপ্রয়োগ চালিয়ে যান। সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এমনকি স্কুলের ছাত্রও বাদ যায়নি। চাঁদপুরে প্রথম আলোর সংবাদদাতার বিরুদ্ধে কয়েক মাসের ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের মতো এই ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের মতো পুলিশের কাছেও আইনটি খুবই পছন্দের হাতিয়ার। সুতরাং, কথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত থেকে শুরু করে মানহানির অভিযোগ, সবকিছুর প্রতিকার চাইতে ব্যবহৃত হচ্ছে ৫৭ ধারা। মানহানির সংজ্ঞাও পুরোপুরি বদলে গেছে। কার সম্মানহানিতে কে মামলা করতে পারেন, তার বাছবিচার না করেই নেতানেত্রীর মানহানির অভিযোগ আনছেন তাঁর ভক্ত নামধারীরা। এমনকি একজন বিচারকও একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা করেছেন। মন্ত্রীরা ৫৭ ধারা বিলোপ করা হবে বলার পরও ওই আইনের অপপ্রয়োগের কারণে মামলার সংখ্যা কয়েক ডজন ছাড়িয়ে যাবে এবং যাঁদের বিরুদ্ধে এসব মামলা, সেই তালিকায় সাংবাদিকেরাই সবচেয়ে বেশি।
সম্পাদক পরিষদের বিবৃতিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ার ১৫(৫) ধারা সম্পর্কিত বক্তব্যটিও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনো দেশেই ইতিহাস হচ্ছে মুক্তচর্চার বিষয়। কিন্তু ওই ধারায় স্বাধীনতার ইতিহাস সম্পর্কে সরকারি ভাষ্যের বিপরীত যেকোনো কিছুকেই ‘ডিজিটাল সন্ত্রাসী অপরাধ’ বিবেচনার বিধান স্পষ্টতই নিয়ন্ত্রণমূলক এবং মুক্তচিন্তার পরিপন্থী। দেশের সমৃদ্ধ ইতিহাস নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনার সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য তাঁদের আহ্বান তাই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে।
সম্পাদক পরিষদ আরও যে বিষয়টিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, সেটি অনলাইন গণমাধ্যম-বিষয়ক নীতিমালা। ওই নীতিমালায়ও বিদ্যমান ৫৭ ধারাসহ তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অন্যান্য আইনের ধারাগুলো প্রযোজ্য হবে বলে জানানো হয়েছে। যার মানে দাঁড়াবে, ৫৭ ধারা অথবা ভবিষ্যতের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৯ ধারার খড়্গ ঠিকই বহাল থাকবে। সম্পাদক ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কথিত মানহানি মামলার অপব্যবহারের যে হিড়িক আমরা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখেছি, তা রীতিমতো আতঙ্কজনক। প্রথম সারির প্রায় সব জাতীয় পত্রিকারই একজন না একজন সাংবাদিককে কথিত মানহানির দায়ে এই ধারায় মামলায় পড়তে হয়েছে। এগুলো হয়েছে সাধারণ ফৌজদারি আইনের ৫০১ বা ৫০২ ধারার আরও অগুনতি মামলার বাইরে। অথচ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মানহানির অভিযোগকে ফৌজদারি অপরাধ গণ্য না করে দেওয়ানি বিরোধে রূপান্তরের দাবি দীর্ঘদিনের। বলা হয়ে থাকে, কোনো সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা হলে সরকারের উচ্চপর্যায়ের অনুমতি ছাড়া তাঁকে গ্রেপ্তারের ‘নিয়ম’ নেই। বরগুনা সদরের ইউএনওর কয়েক ঘণ্টার হাজতবাস নিয়ে শোরগোল ওঠায় বিষয়টি আবারও সামনে এসেছে। কিন্তু কোনো সম্পাদকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তাঁর কিন্তু রেহাই নেই।
সংবিধানপ্রদত্ত মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা সৃষ্টির যেকোনো চেষ্টাই নিন্দনীয়। সরকারের পক্ষ থেকে প্রায়ই দাবি করা হয়, তারা অবাধ তথ্যপ্রবাহ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তারা প্রমাণ হিসেবে তাদের শাসনামলে যতগুলো বেসরকারি টেলিভিশন ও রেডিওর লাইসেন্স দিয়েছে, সেগুলো এবং প্রকাশিত সংবাদপত্রের সংখ্যার কথা বলে। কিন্তু একমাত্র সংখ্যা দিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মাত্রা প্রমাণ করা যায় না। ক্ষমতাসীনেরা যেসব কথা শুনতে পছন্দ করেন, শুধু সে কথাগুলো প্রচারের জন্য ডজন-ডজন পত্রিকা বা টেলিভিশন থাকতেই পারে। কিন্তু যেসব কথা বা সমালোচনা তাঁদের কাছে অপ্রিয়, সেগুলো প্রচারের কোনো সুযোগ না থাকলে তাকে গণতন্ত্র বলা চলে না। সমালোচনার স্বাধীনতা নিশ্চিত করাই হচ্ছে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দায়িত্ব। স্পষ্টতই সরকারের বিদ্যমান আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা এবং প্রস্তাবিত আইনগুলো শুধু সমালোচনার পরিপন্থীই নয়, বরং তার পথে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকও।
গণমাধ্যমের ওপর সরকারের খবরদারি, ভীতি প্রদর্শন, হয়রানি ও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় উদ্বেগ জানিয়ে এর আগেও ২০১৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সম্পাদক পরিষদ একটি বিবৃতি দিয়েছিল (প্রচারমাধ্যমের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে, প্রথম আলো, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫)। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, পরদিনই সরকারের পক্ষ থেকে তথ্য মন্ত্রণালয় একটি পাল্টাবিবৃতি দিয়ে সম্পাদক পরিষদের উদ্বেগকে বাস্তবতাবিবর্জিত, সত্যের অপলাপ, পক্ষপাতমূলক, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও দুর্ভাগ্যজনক বলে অভিহিত করেছিল (সম্পাদক পরিষদের বক্তব্য পক্ষপাতমূলক, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, প্রথম আলো, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫)। ওই বিবৃতিতে যুক্তি দেওয়া হয়, বর্তমান সরকারের আমলে গণমাধ্যম সবচেয়ে বেশি সম্প্রসারিত ও বিকাশ লাভ করেছে। তাতে আরও বলা হয় যে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার মতো কোনো আইন এ মুহূর্তে দেশে নেই।
এবারও সরকারের পক্ষ থেকে একই ধরনের আরও একটি বিবৃতি দেওয়া হলে বিস্মিত হব না। তবে, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু শুক্রবার সন্ধ্যায় বিবিসিকে বলেছেন, ‘সাইবার অপরাধ দমনের জন্য আইনের প্রয়োজন। তাতে মতপ্রকাশে বাধা সৃষ্টি করবে—এমন কিছু থাকবে না। ধর্ম নিয়ে ফেসবুকে উসকানি দিয়ে রামুতে দাঙ্গা বাধিয়ে দেওয়া হয়েছে—তো সেই লোকটাকে ধরবে না? আইনটা যাতে কোনোভাবেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ না হয়, সেটা দেখেই আইনটা তৈরি হবে।’ তিনি সম্পাদক পরিষদের উদ্বেগ বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্যে সংশয় দূর হয় না। এর আগেও আশ্বাস শুনেছি। কিন্তু মামলা ও হয়রানি বন্ধ হয়নি। বাস্তবতা হচ্ছে, ২০১৫ সালেও ওই ৫৭ ধারা ছিল এবং তার অপপ্রয়োগ হয়েছে, ২০১৭-তেও তা বহাল আছে। এখন বরং আইনটির অপপ্রয়োগ বেড়েছে। আশার কথা, সাংবাদিকদের মধ্যে এবার এই বিষয়ে ঐক্যের সুর উচ্চারিত হয়েছে। সবাই বলেছেন ৫৭ ধারা আর নয় , নতুন মোড়কেও নয়। এখন এই ঐক্যকে আরও সংহত করা দরকার। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়েই ৫৭ ধারার মতো হয়রানিমূলক আইনের অবসান ঘটানো সম্ভব।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।