বাংলাট্রিবিউন:
আবারও সংকটে পড়েছে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম। দলটির নির্বাহী সভাপতি মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাসকে তার পদ থেকে ‘গঠনতান্ত্রিকভাবে’ সরিয়ে দেওয়ায় এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে। নতুন কমিটি গঠনের ১৯ মাসের মাথায় মাওলানা ওয়াক্কাসকে কেন্দ্র করে এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো অস্থিরতা তৈরি হলো বিএনপি-জোটের শরিক এই দলটিতে। এই অস্থিরতার কারণে শেষ পর্যন্ত দলটি দু’ভাগ হতে পারে বলে জমিয়তের নির্ভরশীল একাধিক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
জমিয়তের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার সূত্রে জানা গেছে, গত ২২ জুলাই শনিবার রাজধানীর একটি মিলনায়তনে শুরা মজলিস ও বার্ষিক কাউন্সিল ডাকে জমিয়ত। এতে ১৩ টি সাংগঠনিক জেলার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এই কাউন্সিল ডাকার পেছনে ভূমিকা রেখেছেন দলটির মহাসচিব মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী। এতে সভাপতিত্ব করেন প্রবীণ আলেম ও দলের সভাপতি শায়খ আব্দুল মোমিন। ওই কাউন্সিলেই গঠনতন্ত্র সংশোধন করে নির্বাহী সভাপতির পদটি বিলুপ্ত করা হয়। মুফতি ওয়াক্কাস ওই কাউন্সিলে অংশ নেননি। এছাড়া নতুন গঠনতন্ত্রে কৃষি, ছাত্র ও যুববিষয়ক সম্পাদক পদটিও বাতিল করা হয়েছে।
গঠনতন্ত্র দলটির নতুন গঠনতন্ত্রের তথ্য অনুযায়ী, ১১, ১২, ১৩ ডিসেম্বর ১৯৯১ সালের কাউন্সিল থেকেই নির্বাহী সভাপতির পদটি সৃষ্টি করা হয়েছিল। এরপর থেকে ক্রমান্বয়ে এই পদে দায়িত্ব পালন করেছেন মাওলানা শামসুদ্দীন কাসেমী, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, মাওলানা আশরাফ আলী বিশ্বনাথী, এরপর ফের মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, মাওলানা মোস্তফা আজাদ এবং সর্বশেষ ২০১৫ সালের ৭ নভেম্বর কাউন্সিলে মুহাম্মদ ওয়াক্কাস নির্বাহী সভাপতি হন। ওই কাউন্সিলের আগেও অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল জমিয়তে। মহাসচিব পদকে কেন্দ্র করে কাসেমী ও ওয়াক্কাসপন্থীরা ছিল মুখোমুখি। এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মত মুফতি ওয়াক্কাসকে কেন্দ্র দলে অস্থিরতা তৈরি হলো।
২০১৫ সালের কাউন্সিলের পর ২০১৬ সালের মে মাসের দিকে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে জমিয়ত। এরপর এক বছরের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও গঠনতন্ত্রের নির্বাহী সভাপতির পদটি বাতিল করার বিষয়টি গোপন রাখা হয়। এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটি (মজলিসে আমেলা) গঠনতন্ত্রের খসড়া এবং সংশোধন বিষয়ে দুটি বৈঠক করে। চলতি বছরের ২২ জুলাই শুরার অধিবেশনে গঠনতন্ত্র পাস হয়।
জমিয়তের একাধিক নেতা নাম প্রকাশে অনিচ্ছা প্রকাশ করে জানান, দলের আমির শায়খ আবদুল মোমিন বার্ধক্যের কারণে পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়েছে মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমীর তত্ত্বাবধানে। তাকে সহযোগিতা করেছেন সহ সভাপতি মাওলানা আবদুল রব ইউসূফী, মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব, মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দিসহ কয়েকজন নেতা। এদের মধ্যে মাওলানা আবদুর রব ইউসূফীকে তার আগের দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের দু’ভাগ হওয়ার পেছনে দায়ী করা হয়। জমিয়তের বিরোধেও তার ভূমিকা রয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
গঠনতন্ত্র মুফতি ওয়াক্কাসের ঘনিষ্ঠ একাধিক নেতা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, নির্বাহী সভাপতির পদ বাদ দিয়ে মূলত মাওলানা ওয়াক্কাসকে ক্ষমতাহীন করা হয়েছে। এখন তাকে দলের সহ-সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। তবে ওয়াক্কাস এই দায়িত্ব গ্রহণ করবেন না বলে সূত্রের দাবি। এক্ষেত্রে জমিয়তের দু’ভাগ হওয়ার শঙ্কাও রয়েছে। তবে জমিয়ত দু’ভাগ হলেও মুফতি ওয়াক্কাস বিএনপি-জোট ছাড়বেন না বলে মনে করেন তার অনুসারী তিন নেতা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জমিয়তের নির্বাহী সভাপতি মুফতি ওয়াক্কাস ‘নির্বাহী সভাপতির পদটি’ বাতিলের পেছনে মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমীকে দায়ী করেন। বুধবার (২৬ জুলাই) দুপুরে বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘কাসেমী সাহেব করছেন। কারণ, মুফতি সাহেব (নিজেকেই সম্মোধন করে ) থাকলে তো মর্যাদা থাকছে না। নির্বাহী সভাপতির পদটি না থাকলে খাতাপত্রে মর্যাদা বেড়ে যাবে। কিন্তু আমাকে কাউন্সিলেই তিন বছরের জন্য নির্বাহী সভাপতি করেছিল। এখন তারাই বলতে পারবে কেন এই সংশোধনী।’
এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে ফোন করা হলেও মাওলানা কাসেমীকে পাওয়া যায়নি।
পরে কাসেমীপন্থী জমিয়ত নেতা মাওলানা আবদুর রব ইউসূফী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গঠনতন্ত্র সংশোধন করা হয়েছে আলোচনার ভিত্তিতে। আর একটা পদ থাকলেই কী, না থাকলেই কী? মজলিসে আমেলা দু’বার অনুমোদনের পর কাউন্সিলে পাস হয়েছে।’
জমিয়তসূত্র জানায়, ২২ জুলাই কাউন্সিলে সংশোধিত গঠনতন্ত্র নিয়ে আলোচনা করেন সাবেক সংসদ সদস্য শাহীনুর পাশা চৌধুরী, উবায়দুল্লাহ ফারুক, জুনায়েদ আল হাবিব, আবদুল মালেক চৌধুরীসহ অনেকে। এর মধ্যে আবদুল মালেক চৌধুরী গঠনতন্ত্র থেকে নির্বাহী সভাপতির পদটি বাতিলের বিরোধীতা করেন এবং এ নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন। এসময় তার উদ্দেশে তেড়ে আসেন কাসেমীপন্থী ছাত্র জমিয়তের সভাপতি মাওলানা নাসির উদ্দিন খান। পরে মাওলানা জুনায়েদ আলী হাবীবের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। তিনি জোরালো ভাষায় বক্তব্য দেন কাউন্সিলে। এরপর গঠনতন্ত্রের আলোচনায় শাহীনুর পাশা চৌধুরী অংশ নেন। তিনি আবদুল মালেকের বক্তব্য অযৌক্তিক নয় বলে মন্তব্য করে দল থেকে কাউকে বাদ দেওয়ার বিরোধিতা করেন।
সূত্রের দাবি, কাউন্সিলে কণ্ঠভোটে গঠনতন্ত্র পড়া হয়। সহ সভাপতি জহিরুল হক ভূঁইয়া গঠনতন্ত্রের ভূমিকা পড়েন। এরপর কিছু অংশ পড়ে শোনান মুঞ্জরুল ইসলাম আফেন্দি।
মুফতি ওয়াক্কাস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাৎসরিক কাউন্সিল হয়েছে। মুখে-মুখে দাওয়াত দিয়েছে। ৮-১০ জায়গা থেকে লোকজন এসেছেন। এ বিষয়টি নিয়ে দলে ব্যাপক চাঞ্চল্য হচ্ছে।’
২২ জুলাই অনুষ্ঠিত হয় মজলিসে শুরা ও বার্ষিক কাউন্সিল এ বিষয়ে মাওলানা আবদুর রব ইউসূফী বলেন, ‘গঠনতন্ত্রের প্রয়োজনেই এতদিন একজন সহসভাপতি থেকে নির্বাহী সভাপতি করা হয়। নতুন সংশোধিত গঠনতন্ত্রে এই ধারাটি (নির্বাহী সভাপতি পদ) নেই। আর মুফতি ওয়াক্কাসকে তো দল থেকে বাদ দেওয়া হয়নি। এটি মজলিসে আমেলার পরবর্তী বৈঠকে ঠিক হবে, গঠনতান্ত্রিকভাবে তার পদ কী হবে।’
গঠনতন্ত্র সংশোধনের বিষয়ে জানতে চাইলে মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব বলেন, ‘নির্বাহী সভাপতির পদটি আগেও ছিল না। সভাপতির নাজুবিয়্যাতের কারণে পদটি সৃষ্টি করা হয়েছিল। গঠনতন্ত্র সংশোধন হয়েছে কাউন্সিলে ১০২ সদস্য বিশিষ্ট শুরার সামনে।’
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, মুফতি ওয়াক্কাস টানা ২৪ বছর জমিয়তের মহাসচিব ছিলেন। ১৯৯১, ৯৬, ২০০০, ২০০৩, ২০০৫, ২০০৮, ২০১২ সালের কাউন্সিলগুলোয় মহাসচিব হন। এরপর ২০১৫ সালের ৭ নভেম্বরের কাউন্সিলে তাকে নির্বাহী সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ওই বছর মহাসচিব নির্বাচিত হন নূর হোসাইন কাসেমী।
ওয়াক্কাসপন্থী একজন আলেম বলেন, মুফতি ওয়াক্কাস দীর্ঘদিন মহাসচিব ছিলেন। তিন বারের অভিজ্ঞ সংসদ সদস্য ও সাবেক ধর্মমন্ত্রী হওয়ায় রাজনৈতিকভাবে দলের মধ্যে তিনি সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞ। আগামী নির্বাচনেও যশোরে তার সংসদীয় আসনে বিএনপি-জোটের মনোনয়ন প্রায় নিশ্চিত। এক্ষেত্রে নূর হোসাইন কাসেমীর কোনও জনভিত্তি নেই এমনকি রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাও। তবে তিনি নির্বাচনের আগে ইসলামী ঐক্যজোটের নেতৃত্বাধীন একটি জোটে যেতে পারেন। সেক্ষেত্রে বিএনপি-জোট ছাড়তে পারে কাসেমীপন্থী জমিয়ত। যদিও জোটে এখনও থাকায় চাপ তৈরি করতে বিএনপির কাছে ৫০ আসন দাবির প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা।
দু’ভাগ হতে পারে জমিয়ত
মুফতি ওয়াক্কাসের ঘনিষ্ঠ একনেতা জানান, গত ৪ বছর ধরে বঞ্চনার শিকার হয়ে আসছেন ওয়াক্কাসের ঘনিষ্ঠ ও কাছের নেতাকর্মীরা। এরকম অন্তত ২৫-৩০ নেতাকে পদবঞ্চিত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে জমিয়তের ওয়াক্কাস অংশটি আলাদা হয়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে আগামী ঈদুল আজহার মধ্যে দল গুছিয়ে ঈদের পর বা ঈদের আগে নতুন কমিটি ঘোষণা করবে। তবে এখনই এসব পরিকল্পনা প্রকাশ করতে ইচ্ছুক নন ওয়াক্কাসপন্থীরা। ঢাকার বাইরে থাকা মুফতি ওয়াক্কাস ফিরলেই এ নিয়ে তার অনুসারীদের বৈঠক হবে।
আরেকটি সূত্রের দাবি, নির্বাহী সভাপতির পদটি ফিরে না পেলে পাল্টা কমিটি ঘোষণা করতে পারেন মুফতি ওয়াক্কাস। গত বছরের বিরোধের সময় দলের সহসভাপতি হবিগঞ্জের মাওলানা তাফাজ্জুল হক, শায়খ নোমানের নাম সভাপতি হিসেবে প্রস্তুত ছিল তার অংশটির তরফে।
মুফতি ওয়াক্কাস বলেন, ‘আমি চিন্তা করছি, দেখি। আমি মিটিং ডাকবো। পরামর্শ করে দেখি কী হয়। বসতে হবে।’
জমিয়ত ছাড়বেন কিনা এমন প্রশ্নে মাওলানা ওয়াক্কাছ বলেন, ‘বের হয়ে যাবো কই, জমিয়ত থেকে কেন বের হবো। জমিয়ত ছাড়া কিছু করবো না।’
তিনি আরও বলেন, ‘যারা পুরনো কর্মী, ও নেতা তারা অনেকেই আমাকে মহব্বত করেন। সবাইকে ডেকে দেখি কী করা যায়। অতো বেশি চিন্তা করি না। বয়স হয়ে গেছে। রাজনৈতিক লাইনে আল্লাহ আমাকে অনেক দিয়েছেন। কিন্তু জমিয়তকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে দেওয়া তো ঠিক না।
বিএনপি জোট ছেড়ে বা নতুন ইসলামী জোটে যাবেন না বলেও মন্তব্য করেন তিনবারের সাবেক এই সংসদ সদস্য।
দলে বিভেদ তৈরি হচ্ছে এমন প্রশ্নে কাসেমীপন্থী জমিয়তের সহসভাপতি মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব বলেন,‘দলে কোনও বিভেদ নেই। দল আগের চেয়ে শক্তিশালী।’
এদিকে মুফতি ওয়াক্কাসের ঘনিষ্ঠ এক নেতা জানান, হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচি নির্ধারণ বিশেষত ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলাচত্বরে অবস্থানের বিরোধিতার কারণে নূর হোসাইন কাসেমী, জুনায়েদ আল হাবিব এবং আব্দুর রব ইউসুফীদের সঙ্গে মুফতী ওয়াক্কাসের বিরোধ হয়। তাদের যোগদানের পর প্রকট রূপ ধারণ করে।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।