বাংলা ট্রিবিউন

চলতি বছরের ৩০ জুনের মধ্যে ৯ কোটি স্মার্ট কার্ড ছাপিয়ে তা ভোটারদের মাঝে বিতরণের কথা ছিল। কিন্তু এ সময়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রার ১৪ শতাংশের চেয়ে কম কার্ড ছাপানো হয়েছে। আর বিতরণ করা হয়েছে তিন শতাংশেরও কম। এ অবস্থায় ৮৬ শতাংশ ছাপানো বাকি থাকতেই গত সপ্তাহ থেকে স্মার্ট কার্ড ছাপানো বন্ধ রয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী সময়মতো কার্ড ছাপানো ও বিতরণ না হওয়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ফ্রান্সের অবার্থুর টেকনোলোজিস (ওটি)-কে দায়ী করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এজন্য ইসির আইডিইএ (আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর ইন-হ্যান্সিং একসেস টু সার্ভিসেস) প্রকল্প ওই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে। ইসি ও আইডিইএ প্রকল্প সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি ও বিতরণের লক্ষ্যে ২০১৫ সালের ১৪ জানুয়ারি ইসির সঙ্গে ফ্রান্সের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অবার্থুর সঙ্গে ৮১৬ কোটি টাকার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী ২০১৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে দেশের ৯ কোটি ভোটারের জন্য স্মার্ট কার্ড তৈরি ও বিতরণের কথা ছিল। এরপর ওই চুক্তির মেয়াদ ২০১৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। চুক্তির আড়াই বছরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি মাত্র ২৫ লাখ ৭০ হাজার নাগরিকের হাতে স্মার্ট কার্ড পৌঁছাতে পেরেছে। যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ২ দশমিক ৮৬শতাংশ। আর চুক্তির বর্ধিত মেয়াদ পর্যন্ত প্রস্তুত হয়েছে ১ কোটি ২৪ লাখ ১০ হাজার কার্ড। যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ। অবশ্য কার্ড ছাপানো না হলেও ফ্রান্স থেকে এ পর্যন্ত ব্ল্যাংক কার্ড এসেছে ৬ কোটি ৬৩ লাখ ৬০ হাজার, যা লক্ষ্যমাত্রার ৭৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ। আরও ২৯ লাখ ৫০ হাজার কার্ড পাইপলাইনে রয়েছে।

জানা গেছে, গত ৩ জুলাই ইসি সচিবকে দেওয়া এক চিঠিতে আইডিইএ প্রকল্পের পরিচালক স্মার্ট কার্ডের অগ্রগতির তথ্য তুলে ধরেন। এতে উল্লেখ করা হয়, থানা ও উপজেলা পর্যায়ে ১ কোটি ৯ লাখ ৮০ হাজার কার্ড পৌঁছানো হলেও বিতরণ করা হয়নি।

সূত্রে জানা গেছে, কার্ড ছাপানো ও বিতরণের সিংহভাগ বাকি থাকলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৫১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি বিল নিয়েছে। আরও কমবেশি ৩০ মিলিয়ন ডলার পাওনা রয়েছে। বর্তমানে ওই টাকা পরিশোধ বন্ধ রয়েছে। বাকি ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাজই করেনি প্রতিষ্ঠানটি। এ পরিস্থিতিতে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে ইসি। শিগগরিই ইসি থেকে এ সংক্রান্ত ঘোষণা আসতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে।

ইসি ও আইডিইএ প্রকল্পের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ‘৯ কোটি মানুষের হাতে কার্ড তুলে দিতে চুক্তির মেয়াদ আরও ৬ মাস বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছিল ওটি। ইসির পক্ষ থেকে এতে এক প্রকার সম্মতিও ছিল। প্রকল্পের স্বার্থে ডিসেম্বর পর্যন্ত চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর জন্য দুই পক্ষ বিভিন্ন ধরনের সমঝোতামূলক পদক্ষেপ নেয়। কার্ড প্রক্রিয়াকরণে ৮টি অতিরিক্ত মেশিন আমদানি, নতুন ওয়ার্কিং প্ল্যান তৈরিসহ ওই কোম্পানিকে দেওয়া হয় কয়েকটি শর্ত। কিন্তু প্রাথমিক ধাপের শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় সেই প্রক্রিয়াও ভেস্তে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে ইসি। ইতোমধ্যে কোম্পানির কিছু বিলও আটকে দেওয়া হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইডিইএ প্রকল্পের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ‘কার্ড উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকেই ওই কোম্পানির কাছে জিম্মি ছিলাম আমরা। কোম্পানিটি চুক্তি অনুযায়ী মেশিন আনলেও ডকুমেন্ট হস্তান্তর করেনি। কার্ড প্রক্রিয়াকরণের বিষয়ে প্রকল্পের সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণও দেয়নি। বর্তমানে ওই যন্ত্রপাতি ওবার্থুর টেকনোলজির ব্যবসায়িক অংশীদার টাইগার আইটির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এর বাইরে প্রকল্পের আওতায় ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্কসহ অন্যান্য উপখাতের কার্যক্রমেও গতি নেই।’

ইসি সূত্রে জানা গেছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের চুক্তি লঙ্ঘনের বিষয়ে সম্প্রতি কমিশনের সামনে একটি প্রেজেন্টেশন তুলে ধরেন আইডিইএ প্রকল্পের কর্মকর্তারা। এতে যেসব অনুচ্ছেদে চুক্তি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে, তার বিবরণ দেওয়া হয়েছে। কার্ড প্রক্রিয়াকরণের সব পর্যায়ে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা থাকলেও তা এখনও বাস্তবায়ন করেনি ওটি। কার্ড প্রক্রিয়াকরণে মেশিনারিজের পারফরমেন্সও ভালো ছিল না। এমন তথ্য তুলে ধরে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লক্ষ্যমাত্রা পূরণে প্রতিদিন ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬৬৬টি কার্ড প্রক্রিয়াকরণ করা। কিন্তু বাস্তবে গড়ে ৪৫ হাজার কার্ড প্রক্রিয়াকরণ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে আরও কয়েকটি অনুচ্ছেদ লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়েছে এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।

ইসি সূত্রে জানা গেছে, ওটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হলে মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির মাধ্যমে স্মার্ট কার্ড উৎপাদনের বিষয়ে আলোচনা চলছে। প্রকল্পের আওতায় কেনা ১০টি মেশিনেই এসব কার্ড প্রক্রিয়াকরণ করা হবে। সেক্ষেত্রে রাজস্ব খাত থেকে ব্যয় বহন করার চিন্তা করা হচ্ছে।

এদিকে আগামী ডিসেম্বরে মূল প্রকল্প আইডিইএ-এর মেয়াদ শেষ হচ্ছে। ওই সময়ের পর এ প্রকল্পের মেয়াদ আর বাড়বে না বলে ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।

এ সব বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত কমিটির প্রধান ও নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী বৃহস্পতিবার বলেন, ‘সম্ভবত এক সপ্তাহের মতো কার্ড উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘তাদের সঙ্গে এই মুহূর্তে আমাদের কোনও চুক্তি না থাকায় আমরাই উৎপাদন বন্ধ রেখেছি। দেশের স্বার্থে ওই কোম্পানিকে আমাদের ডাটাবেজে প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’

জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত কমিটির প্রধান আরও বলেন, ‘সময়মতো কার্ড ডেলিভারি দিতে ব্যর্থ হওয়ায় চুক্তির মেয়াদ হয়তো বাড়াব না। তাদের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবিসহ অন্যান্য আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ কোম্পানির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটির এক সভায় শর্তসাপেক্ষে মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু তারা যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেগুলো বাস্তবায়ন করেনি। উল্টো ইসিকে বিভিন্ন শর্ত দিয়েছে। তাই প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটির সভায় চুক্তির মেয়াদ না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’

এর আগে জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগের (এনআইডি) মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘সময়মতো তারা সব কার্ড কেন দেয়নি, তার ব্যাখ্যা দিতে হবে। তার আলোকে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, ‘২৮ মাসে মাত্র ১২ দশমিক ৪০ শতাংশ কাজ করেছে। ২৮ মাসে এ কোম্পানি কী কাজ করেছে, তার কৈফিয়ত চেয়েছি। তাদের বলেছি, এ জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।’

নির্বাচন কমিশনের সদ্য বিদায়ী সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ গত ২৩ জুলাই বলেন, ‘গত ৩০ জুন চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে। তারা চুক্তি অনুযায়ী কার্ড উৎপাদন ও সরবরাহ করতে ব্যর্থ হওয়ায় ইসি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার চিন্তা করছে।’ একইসঙ্গে বিদেশি প্রতিষ্ঠান বাদ দিয়ে সেনা বাহিনী নিয়ন্ত্রিত মেশিন টুলস্ ফ্যাক্টরির মাধ্যমে কার্ড ছাপানোর চিন্তা চলছে বলেও তিনি জানিয়েছিলেন।