আবু সুফিয়ান সম্রাট

ক্রিকেট থেকে শুরু করে রাজনীতি পর্যন্ত পাকিস্তানের ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ তকমার চেয়ে জুতসই কোনো উপাখ্যান খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। দেশটি স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডকে অস্বাভাবিক করে কখনো আমাদের করে কিংকর্তব্যবিমূঢ়, আবার কখনো কখনো অনিশ্চয়তাকে জয় করে বিশ্ববাসীকে অতিমাত্রায় বিস্মিত করে। যা হোক, ২৮ জুলাই পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক দুর্নীতির দায়ে নওয়াজ শরিফের প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল থাকার অযোগ্যতার রায় এবং পরবর্তী সময়ে নওয়াজের পদত্যাগ পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সংকট ও সম্ভাবনার দ্বিমুখী রাস্তা খুলে দিয়েছে।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকেই পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর সরাসরি হস্তক্ষেপ কিংবা পরোক্ষ দাপট নতুন কোনো ঘটনা নয়। সেনাবাহিনী রাজনৈতিক ফায়দার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে সহযোগিতা করাসহ অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্ব তৈরি করে পাকিস্তানের রাজনৈতিক মেরুকরণকে সব সময়ই গভীরতর করেছে। প্রাদেশিক অসমতাকে কাজে লাগিয়ে সেনাবাহিনী সব সময়ই পাঞ্জাবকেন্দ্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সমুন্নত রাখতে যা করতে হয়, তার সবটুকুই করেছে। এই প্রক্রিয়ার ফসল নওয়াজ শরিফ নিজেও। ১৯৮০-র দশকে জেনারেল জিয়ার সামরিক সরকার বেনজির ভুট্টোকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করার জন্য নওয়াজ শরিফকে বিভিন্ন উপায়ে সহযোগিতা করতে থাকে। ফলে নওয়াজ শরিফ পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী থেকে ১৯৯০ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব লাভ করেন। তাঁর এই শাসনামলে নওয়াজ শরিফ ও তাঁর পুরো পরিবার রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যবসাকে সম্প্রসারিত করে সম্পদের পাহাড় গড়ে। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে ১৯৯৩ সালেও নওয়াজকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত হতে হয়।

প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে অপসারণ বা পদত্যাগ পাকিস্তানের রাজনীতিতে নতুন কোনো বিষয় নয়। ৭০ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে নওয়াজসহ ১৮ জন প্রধানমন্ত্রীর কেউই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। শুধু নওয়াজকেই তৃতীয়বারের মতো এই অভিজ্ঞতার শিকার হতে হলো। তবে নওয়াজ দৃশ্যত দুর্নীতির দোষে দুষ্ট হয়ে প্রধানমন্ত্রিত্ব হারালেও কৌশলগত কিছু বিষয় এর পেছনে কাজ করেছে। ভারতের সঙ্গে নওয়াজের দহরম-মহরম সেনাবাহিনী বরাবরই বাঁকা চোখে দেখেছে। আবার আইএসআইকে কূটনীতির কৌশল হিসেবে জঙ্গিবাদের সঙ্গে ব্যবহারে নওয়াজের অনীহা ভালোভাবে নেয়নি পাকিস্তানের অগণতান্ত্রিক শক্তিগুলো। তাই অনেকেই নওয়াজকে তাঁরই দুর্বল নীতির বলি মনে করছেন। ফলে বিচার বিভাগীয় ক্যুর একটা উৎকট গন্ধ রয়েই যায়। তারপরও পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটে এই পরিবর্তন কিছুটা হলেও ইতিবাচকতাকে ধারণ করে। তাহলে এখন প্রশ্ন, আদালত কর্তৃক নওয়াজের প্রধানমন্ত্রিত্বকে অবৈধ ঘোষণা এবং পরবর্তী সময়ে নওয়াজের পদত্যাগ পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে কি নতুন মাত্রা যোগ করবে? যোগ করলেও পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের গণতান্ত্রিক কাঠামোর দুর্বলতাকে কি তা সারাতে পারবে? চিরায়ত সামরিক বাহিনীর শক্তি বনাম ক্রমবর্ধমান বিচার বিভাগের সার্বভৌমত্ব কি নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণকে উসকে দেবে? সব হিসাব-নিকাশকে পেছনে ফেলে নওয়াজ কি আবার রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন করবেন?

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তানের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো, বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্য কোনো বার্তা বহন করে?

দুর্নীতির ফাঁদে পড়ে নওয়াজের প্রধানমন্ত্রিত্ব চলে গেলেও পাকিস্তানের ইতিহাস বলে অন্য কথা। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিগুলোর আনাড়ি আচরণের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সামরিক বাহিনী দীর্ঘদিন ধরেই পাকিস্তানের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তবে ২০১০ সালে সংবিধানের ১৮তম সংশোধনীর পর পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন হয়ে যায়।

এই সংশোধনীর মাধ্যমে অবৈধ পন্থায় ক্ষমতা দখলকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করায় সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের প্রশস্ত পথটি জীর্ণশীর্ণ হয়ে যায়।

তাই নওয়াজের পদত্যাগের ফলে সৃষ্ট সংকটের সমাধান অগণতান্ত্রিক উপায়ে হওয়ার সম্ভাবনা খুব একটা নেই।

আবার নওয়াজ পরিবারের দুর্নীতিকে জনসমক্ষে আনতে এবং বিচারপ্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ রাখার জন্য শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফসহ (পিটিআই) অন্যান্য রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চর্চার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করল। চিরায়ত হামলা-হাঙ্গামার পাকিস্তানে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন, পিটিআইয়ের গণতান্ত্রিক উপায়ে আইনি লড়াই এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগের সাহসী পদক্ষেপ পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।

তবে পাকিস্তানের রাজনৈতিক দুর্বলতাকে সারাতে হলে আইনসভাকে কার্যকর করাসহ আঞ্চলিক বিভাজন ও বৈষম্যকে দূর করতে হবে। এটা অবশ্য রাজনৈতিক শক্তিগুলোর গণতন্ত্রের সঠিক চর্চার ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল।

নওয়াজের এই পদত্যাগ যে পাকিস্তানের ভাগ্যে প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের জয় লিখে দেবে, তা অনুমান করা বেশ কঠিনই এখন পর্যন্ত। কারণ, আইনের শাসনকে সমুন্নত রাখতে বিচার বিভাগের এই সাহসী পদক্ষেপ যে অগণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলবে, তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়।

পাকিস্তানের বিচার বিভাগ দিনের পর দিন যে শক্তিশালী হচ্ছে, সে বিষয়ে ভিন্নমত পোষণের সুযোগ নেই। কারণ, সামরিক শাসকের অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কিংবা নির্বাচিত সরকারের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নির্যাতনকে বরণ করে নিয়েও গণতন্ত্রের পথে ছিলেন পাকিস্তানের বিচারক ও আইনজীবীরা। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পাকিস্তানকে আজ যে গণতন্ত্রের পথে রাখছে, তা সম্ভবত তাদেরই ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত। তাই সামরিক বাহিনী ও বিচার বিভাগ যে একটা মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছে, তা এড়ানোর সুযোগ নেই।

বিচার বিভাগ বনাম সামরিক বাহিনীর হিসাব-নিকাশের সঙ্গে আরও একটি হিসাবকে আমলে নিতে হবে পাকিস্তানকে। তা হলো নওয়াজের রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনের সুযোগ। কারণ, ২০১৩ সালের নির্বাচনে নওয়াজ সম্পদের অসম্পূর্ণ তালিকা মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দাখিল করেন। ফলে আইনি লড়াইয়ের ক্ষেত্রে এখনো রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়নি নওয়াজের জন্য। যে বিষয়টি নওয়াজের জন্য ফেরার রাস্তা খুলে দিতে পারে, তা হলো নওয়াজ যে সম্পদের হিসাব লুকিয়েছেন, তা পানামা পেপারসের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়; বরং ১৯৯৯ সালের পর থেকে নির্বাসনে থাকা অবস্থায় দুবাইয়ে তাঁর ছেলের কোম্পানির পরিচালক হিসেবে যে বেতন পেতেন, তারই হিসাব। তবে নওয়াজের রাজনীতিতে ফেরা নির্ভর করছে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক যোগ-বিয়োগের ওপর।

পাকিস্তানের বিচার বিভাগের এই রায় এবং প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য নিঃসন্দেহে একটি মাইলফলক। বাংলাদেশের কথাই ধরুন, ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে চলমান বিতর্কের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের এই ঘটনা নিঃসন্দেহে রসদ হিসেবে কাজ করতে পারে। কারণ, বিচার বিভাগ স্বাধীন হলে ক্ষমতার ভারসাম্য অর্জনে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে তা তাগিদ দেয়। ফলে রাজনৈতিক সংকটে তা গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। যা হোক, পাকিস্তানের এই রাজনৈতিক পরিবর্তন সব সংকট ও অগণতান্ত্রিক শক্তিকে পাশ কাটিয়ে জাতিটিকে গণতন্ত্রায়ণের পথেই রাখুক—এটাই প্রত্যাশা।

আবু সুফিয়ান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন ইতিহাসে সর্বোচ্চ স্বর্ণপদকজয়ী।
shamrat08du@yahoo.com