ডেস্ক নিউজ:
সফল মানুষেরা তাদের কর্মের প্রতিদান কখনোই খোঁজেন না। এখানেই হয়তো তাদের সাফল্যের মূলমন্ত্র নিহিত। ‘ব্রিটিশ বাংলাদেশি পাওয়ার অ্যান্ড ইন্সপিরেশন’ মূলত যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশি কমিউনিটির একটি উদ্যোগ। বিশ্বজুড়ে বাংলার কৃতী সন্তানেরা নিজেদের দৃপ্ত পদচ্ছাপ রেখে এগিয়ে চলেছে দিগ্বিজয়ীর মতো। এই পদচারণা পরবর্তী প্রজন্মকে এগিয়ে দেবে হয়তো বহুদূর, আর সেই সঙ্গে বাংলাদেশের নামও উজ্জ্বল করবে বিশ্বের মানচিত্রে। এমনই সাফল্যমণ্ডিত মানুষদের নিয়ে ব্রিটিশ বাংলাদেশি পাওয়ার অ্যান্ড ইন্সপিরেশনের কর্মকাণ্ড পরিচালিত। ১০০ জন সবচেয়ে প্রভাবশালী বাংলাদেশির তালিকা তারা প্রথম প্রকাশ করে ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে। এই তালিকা প্রকাশের মাধ্যমে তারা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিদের কঠোর পরিশ্রম ও উদ্যোগকে স্বাগত জানায় এবং উদযাপন করে। এই তালিকায় তারা স্থান দেয় সেইসব ব্যক্তি ও উদ্যোক্তাকে যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত রেখেছেন। যে ব্যক্তি ও উদ্যোক্তারা শুধু নিজ প্রয়োজনে নয়, বরং দেশের স্বার্থে নিজেদের কর্মজীবন পরিচালনা করেন; তাদেরকেই এই তালিকায় ঠাঁই দেওয়া হয়। কর্মের মধ্য দিয়ে তারা যেমন নিজেদের উন্নয়ন সাধন করেছেন, তেমনি দেশকেও তুলে ধরেছেন বিশ্ব দরবারে গৌরবের সঙ্গে। নিজ অবস্থান থেকে দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন এমন ব্যক্তিত্বও উপস্থিত আছেন এই তালিকায়। অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে, কেন এই তালিকা তৈরি করা। ব্রিটিশ বাংলাদেশি পাওয়ার অ্যান্ড ইন্সপিরেশন তালিকা তৈরিকারী কমিউনিটির উত্তর একটাই—অনুপ্রেরণা। তারা অনুপ্রেরণায় বিশ্বাসী এবং তাদের মতে, আজকের এই উদ্যোগী মানুষগুলোর গল্প থেকেই তৈরি হবে ভবিষ্যত্ প্রজন্ম, প্রবীণদের সফল পদচ্ছাপ ধরেই এগিয়ে যাবে নবীনদের উদ্যোগী ধ্যান-ধারণা। মূল উদ্দেশ্য হলো—বর্তমান তরুণ প্রজন্মের কাছে একটি সুন্দর আদর্শ তুলে ধরা, যা অনুসরণ করে তারা এগিয়ে যেতে পারে। ২০১৬ সালে পঞ্চমবারের মতো করা হয়েছে এই তালিকা। প্রতিবারের মতো এবারও দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সফল বাংলাদেশিদেরকেই বেছে নেওয়া হয়েছে তালিকার জন্য। নিচে এমনই কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ যারা সাফল্যের পিছনে ছোটেননি, বরং সাফল্য যাদের পিছনে ছুটেছে; তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হলো।
১. মুহাম্মদ ইউনূস
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদ। তিনি বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ ধারণার প্রবর্তক। এছাড়াও অধ্যাপক ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একজন শিক্ষক ছিলেন। মুহাম্মদ ইউনূস ও তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে ২০০৬ সালে সামাজিক ও আর্থিক উন্নয়নের জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করে। ড. ইউনূস বিশ্ব খাদ্য পুরস্কারসহ অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছেন। গরিবের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গ্রামীণ ব্যাংকের সাফল্যে উন্নত বিশ্ব অর্থাত্ যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশ সেই উন্নয়নের মডেল ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ হয়। ড. ইউনূস ২০১৪ সালে ইউনূস সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন। এখান থেকেই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে আগ্রহী করে তুলছেন।
২. জাওয়াদ করিম
ইউটিউবের নাম শোনেননি, এমন কথা আজ অবান্তর। দৈনন্দিন জীবনে এর প্রয়োজনীয়তা ভাত-ডালের মতোই। জাওয়াদ করিম জনপ্রিয় ভিডিও ভাগাভাগি ওয়েবসাইট ইউটিউবের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। তার জন্ম তত্কালীন পূর্ব জার্মানিতে। পে-পালে চাকরি করার সময় তার সঙ্গে পরিচয় হয় চ্যাড হার্লি ও স্টিভ শ্যানের। এই তিনজন পরে একটি ভিডিও শেয়ারিং ওয়েবসাইট চালু করেন। গুগল যখন ওই ওয়েবসাইটটি কিনে নেয় তখন জাওয়াদ করিমকে ৬৪ মিলিয়ন ডলারের ১,৩৭,৩৩৪টি শেয়ার দেওয়া হয়। করিম পরবর্তী সময়ে এই টাকা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিজনেস আইডিয়া শুরু করতে ও এগিয়ে নিতে ব্যবহার করছেন। অনেক বাঙালিই হয়তো জানেন না, একজন বাংলাদেশি ইউটিউবের জন্মের সঙ্গে ছিলেন।
৩. স্যার ফজলে হাসান আবেদ
স্যার ফজলে হাসান আবেদ, কেসিএমজি একজন বাংলাদেশি সমাজকর্মী এবং বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি সংগঠন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান। সামাজিক উন্নয়নে তার অসামান্য ভূমিকার জন্য তিনি র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার, জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থার মাহবুবুল হক পুরস্কার ও গেটস ফাউন্ডেশনের বিশ্ব স্বাস্থ্য পুরস্কার লাভ করেছেন। দারিদ্র্য বিমোচন এবং দরিদ্রের ক্ষমতায়নে বিশেষ ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ ব্রিটিশ সরকার তাকে নাইটহুডে ভূষিত করেছে।
৪. সালমান খান
সালমান আমিন খান ‘খান একাডেমি’র প্রতিষ্ঠাতা। খান একাডেমি একটি উন্মুক্ত অনলাইনভিত্তিক ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। নিজ বাসার ছোট অফিস থেকে যাত্রা শুরু করে, বিস্তৃত ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়সমূহ, বিশেষত গণিত ও বিজ্ঞানের উপর ৬,৫০০-এর অধিক ভিডিও তৈরি করেছেন তিনি। ২০১২ সালে মার্কিন পত্রিকা টাইমের জরিপে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির বার্ষিক তালিকায় তার নাম ছিল। ২০১৬ সালের ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত, ইউটিউবে খান একাডেমির চ্যানেলটি ২,৪১৫,৪০৬-এর অধিক গ্রাহককে আকৃষ্ট করেছে এবং ভিডিওগুলো সব মিলিয়ে ৬৯৬ মিলিয়নের অধিক বার দেখা হয়েছে।
৫. করভি রাখশান্দ
জনপ্রিয় অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘জাগো ফাউন্ডেশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা করভি। মাত্র ৩০ বছর বয়সেই বনে গেছেন এত বৃহত্ একটি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা। ২০০৭ সালের এপ্রিল মাসে জাগো ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। ২০০৭ সালে প্রথম ১৭ জন শিক্ষার্থী নিয়ে রায়ের বাজারে বিনামূল্যে শিক্ষাদান করার জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে শিক্ষাদান ছাড়াও আরও অনেক ধরনের সামাজিক উন্নয়ন ও জনসেবামূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন তিনি।
৬. সারা হোসেন
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী সারা হোসেন। মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন বহু দিন ধরে। জোরপূর্বক উচ্ছেদের শিকার বস্তিবাসীদের আশ্রয় নিয়েও কাজ করছেন তিনি। এছাড়া নারী নিরাপত্তা ও আইনি ব্যবস্থার দুর্নীতি নিয়ে রিপোর্ট করার ফলে হয়রানির শিকার সাংবাদিকদের পক্ষেও তিনি সোচ্চার রয়েছেন সবসময়। বাংলাদেশের একজন আইনজীবী ও সুনাগরিক হিসেবে এই কাজগুলোকে নিজের কর্তব্য মনে করেন তিনি।
৭. সাকিব আল হাসান
২০০৬ সালের আগস্ট মাসে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে অভিষেক তার। সেই থেকে শুরু। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার তিনি। তার খেলার মান ও ধারাবাহিকতা তাকে নিয়ে গেছে এক নতুন উচ্চতায়, হয়েছেন দলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য একজন খেলোয়াড় ‘দ্য ওয়ান ম্যান আর্মি’। সাকিব ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে টেস্ট, ওডিআই ও টি-২০ প্রত্যেক ক্রিকেট সংস্করণে এক নম্বর অল-রাউন্ডার হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। সাকিব প্রথম বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবে একদিনের ক্রিকেটে ৪,০০০ রান করার গৌরব অর্জন করেছেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম এবং পৃথিবীর ২৮তম খেলোয়াড়, যিনি ২০১১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এক টেস্ট ম্যাচের এক ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়েছেন।
৮. ওমর ইশরাক
বিশ্বের চার নম্বর চিকিত্সাযন্ত্র নির্মাতা কোম্পানি মেডট্রনিকের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী ড. ওমর ইশরাক। জিই হেলথ কেয়ারের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সিইও এখন আছেন মেডট্রনিকে। মেডট্রনিক তখন লোকসান গুনছিল। পড়ে গিয়েছিল এর শেয়ার। ২০১১ সালে কোম্পানিটি নিয়ে আসে ড. ওমর ইশরাককে। ইশরাক তখন মেডট্রনিকের ধসে যাওয়ার মূল কারণগুলো খুঁজে বের করেন। এরমধ্যে একটি ছিল ‘ইনফুজ’ নামের চিকিত্সাযন্ত্র। এই যন্ত্র সুবিধার চেয়ে অসুবিধা করছিল বেশি। এর প্রতিকার খুঁজতে থাকলেন আর ঝুঁকলেন বিশ্ববাজারের দিকেও। সবমিলিয়ে ঝড়টা ভালোভাবেই সামলে নিলেন তিনি। এ বছর লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ বাংলাদেশি পাওয়ার অ্যান্ড ইন্সপিরেশনের তালিকায় বিশ্বের প্রভাবশালী ১০ বাংলাদেশির মধ্যে উঠে এসেছে তার নাম।
৯. সুমাইয়া কাজী
সুমাইয়া কাজী জন্মসূত্রে বাংলাদেশি একজন মার্কিন নাগরিক এবং বিখ্যাত নারী উদ্যোক্তা। তার পৈতৃক নিবাস ফেনী শহরে। তিনি লেখাপড়া শেষ করে সান মাইক্রোসিস্টেমস নামক একটি প্রতিষ্ঠানে সিনিয়র সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজার হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ওয়েবনির্ভর সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেন প্রফেশনালদের জন্য। তিনি সংবাদসংস্থা রয়টার্স এবং ক্লাউট কর্তৃক প্রকাশিত বিশ্বের সেরা প্রভাবশালী ৫০ উদ্যোক্তার তালিকায় ১৬ নম্বরে অবস্থান করছেন। সিলিকন ভ্যালি বিজনেস জার্নাল তাকে ‘ওমেন অব ইনফ্লুয়েন্স’ উপাধি দিয়েছে। এছাড়াও তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিজনেস উইক ম্যাগাজিন ও কালার লাইট ম্যাগাজিন থেকে ‘সেরা তরুণ উদ্যোক্তা’সহ বেশ কয়েকটি পুরস্কার অর্জন করেছেন। পেয়েছেন সিএনএনের ‘ইয়ং পারসন হু রকস’ এবং কালার লাইট ম্যাগাজিনের সেরা তরুণ উদ্যোক্তার পুরস্কার।
১০ . নিশাত মজুমদার
‘হিমালয় পার হওয়া’ বলতে সবাই বোঝায় দুঃসাধ্য ব্যাপার। সেই দুঃসাধ্য কাজটিই করে দেখিয়েছেন নিশাত মজুমদার। তিনি প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে ২০১২ সালের ১৯ মে শনিবার সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে এভারেস্ট শৃঙ্গ জয় করেন। ঢাকা ওয়াসায় হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত তিনি। পেশায় একজন অ্যাকাউনটেন্ট হলেও নিজের নেশাকে দমিয়ে রাখতে পারেননি। সারা বিশ্বের নারীদের সামনে তিনি একজন বড় মাপের আদর্শ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। হিমালয় জয় করার আগে বহুবার তিনি পর্বতারোহণ করেছেন প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে। তাই বলা যায়, এমন মানুষই তো সবার জন্য আদর্শ হবেন!
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।